ঘুরে এলাম তানজানিয়া (৬ষ্ঠ কিস্তি- ওয়াহেরি জানজিবার)

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 8 July 2016, 03:54 PM
Updated : 8 July 2016, 03:54 PM

ওয়াহেরি জানজিবার

১৯ মে, ২০১৬ । ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম ভাংলেও চুপ চাপ শুয়ে থাকলাম। হোটেলে সকালের নাস্তা দিবে সাতটার পরে। তাই তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই। গতকাল সন্ধ্যায় হ্যান্সের সাথে দেখা হয়েছিল আর একবার। সে বলল, সেও নাকি আজকেই দারুস সালাম ফিরবে। তার ফেরি সকাল সাড়ে নয়টায়। প্রথম ফেরি সকাল সাড়ে সাতটায়। আমি গতকালই টিকেট বুক করার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যায় কিলিমানজারো ফেরির অফিসটি বন্ধছিল। তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সকাল সাড়ে নয়টার ফেরিতেই যাব। এতে হ্যান্স পরিবারের সাথে আরও কয়েকটি ঘন্টা কাটান যাবে।

ঘন্টাখানিক চুপ থেকে কাপড়চোপড় গোছালাম। এর পর প্রাকৃতিক কৃত্যাদি সেরে গেলাম হোটেলের ছাদে। এখানকার আবহাওয়া চমৎকার! সকাল সাতটায় নাস্তা বিতরণ শুরু হল। গতকাল আমাকে চাপাতি দিবে বলে ওরা জানিয়েছিল। কিন্তু চাপাতি বা পরোটার কোন খবর নেই। ফল দিল আগে। আনারস, পেঁপে আর তরমুজ। পাউরুটির সাথে জেলি ও মাখনও দিয়েছে। এক গ্লাস প্যাশন ফ্রুটের জুস দিল। প্যাশন ফ্রুটস হল ট্যাং। আমি এর নাম দিয়েছি মোহফল। ট্যাংগের মতোই স্বাদ খারাপ লাগে না।হোটেলের অতিথি মাত্র হ্যান্স পরিবার আমি ও অন্য একজন। অত্যন্ত ঘরোয়া পরিবেশ বলে মনে হচ্ছিল।

হোটেলের ভাড়া চুকিয়ে বোকচা পেটরা নিয়ে বের হলাম। হেঁটেই চললাম ফেরির বুকিং অফিসে। এবার চাইলাম ইকোনোমি ক্লাসের টিকিট করতে। এতে একদিকে আমার যেমন ১০ ডলার বেঁচে যাবে, অন্যদিকে ফেরির ছাদে বসে বসে সমুদ্রের অপার লীলা উপভোগ করতে পারব। কিন্তু বিদেশিদের জন্য এরা ভিআইপি ও বিজনেস ক্লাস ছাড়া অন্য ক্লাসের টিকিট দেয়া হয় না। তবে আমি চাইলে যে কোথাও, একমাত্র উপরের ক্লাস ছাড়া, বসতে পারি। আমার কাছে এটাও ব্যাটাদের চাল বলে মনে হল। বিদেশিদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি টাকা খসানোর একটি কৌশল।

টিকেট করে ইমিগ্রেশনে গেলাম। রীতি মত চেক আউট করে ওয়েটিং রুমে বসলাম। দেখা হল হ্যান্স পরিবারের সাথে। নেটবুকটা বের করে কয়েক পাতা লিখতেই ডাক পড়ল। ফেরি এসে গেছে। জেটিতে গিয়েই আমাদের ট্রলি ব্যাগগুলো লকারে নেয়া হল। অনেকটাই বেঁচে গেলাম। কারণ এখন মাত্র একটি কুইক রান ব্যাগ সাথে থাকায় আমার ফেরিতে চলাফেরা করা সুবিধা হবে।

রোদের তীব্রতা প্রচণ্ড। এর মাঝেই আমরা ফেরির ছাদে স্থান করে নিলাম। এবার সামনের দিকে। আমরা ভ্রমণ করব দক্ষিণ পশ্চিম দিকে। তাই ফেরির বাম দিকেই বসলাম। সামনের সারিতে হ্যান্স পরিবার বসল। আমি বসলাম দ্বিতীয় সারিতে। দেখি আমাদের সামনে এক কোণায় একটি লাইফ জ্যাকেটের উপর কুণ্ডলী পাকিয়ে এক মহিলা শুয়ে আছেন। তিনি হলেন স্থানীয় মেয়ে। তিনি জানেন এ ফেরির হালচাল । তাই আগে ভাগেই নিরাপদ স্থানটি দখল করেছেন।

ফেরি ছাড়ল সময় মতো। গত পরশু আসার সময় সাগর উত্তাল ছিল। কিন্তু আজকের সাগর আরো বেশি উত্তাল। গোটা ফেরি দুলতে থাকল ঢেউয়ের দোলায়। কোন স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। হ্যান্সসহ আমরা বসে পড়লাম একস্থানে। ফেরির দোলানিতে বমি বমি মনে হয়। সাগর ভ্রমণের এই কৃত্রিম বমি বমি ভাবকে বলে সি সিকনেস। একটু পরেই এক ভদ্রলোক পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে হাজির সবাইকে একটি করে ব্যাগ দিচ্ছে সে। আমার অবস্থাও ভাল ঠেকছে না। তাই আমিও একটি ব্যাগ নিলাম। হ্যান্স পরামর্শ দিল, সি সিকনেস দেখা দিলে ঝিম মেরে বসে না থেকে দাঁড়িয়ে দিগন্তের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করতে হয়। এতে সিকনেস করে আসে। আমি তার উপদেশ গ্রহণ করলাম। সমস্যা দূর হল।
দারুস সালাম বন্দরের লেগুন

সকাল এগারটায় দারুস সালামে পৌঁছিলাম। এবার দারুস সালাম বন্দরটা ভাল করে দেখার সুযোগ হল। আমাদের ফেরি যেখানে থামল সেটা ছিল একটি লেগুনের মতো। এখানে শুধু অভ্যন্তরীণ নৌযানগুলোই ভিড়ে। মূল বন্দর এখান থেকে অনেক দূরে। বন্দরের উপরেই গড়ে উঠেছে সুন্দর সুন্দর ভবন। একটি টুইন বিল্ডিং অত্যন্ত চমৎকার দেখাচ্ছিল। কাঁচের বহিরাবরণটা আনত সূর্যের আলোয় আরো বেশি ঝলমল করছিল। পানির মধ্যে কোন ময়লা নেই, আবর্জনা নেই। তবে দূর থেকে একটু আঁসটে গন্ধ আসছে। কারণ বন্দরের কাছেই হয়তো কোথাও ফিসারি ঘাট আছে। দারুস সালাম উপকুলে ভাল মাছ ধরা পড়ে।


ট্রাভেল এজেন্ট অফিসের বাটপাড়ি

দারুস সালামে পৌঁছে কি করব, কোথায় যাব এসব পরিকল্পনা আমার ছিল না। এখানে এক রাত্রি যাপন করে আমার যাওয়ার কথা কিলিমানজারো পাহাড়ের সন্নিকটের শহর মোসিতে। তাই ধান্ধার মধ্যে পড়লাম। আজই মোসি রওয়ানা দিব, না আগামীকাল? এসব চিন্তা করতে করতে একটি ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে গেলাম। তারা আমাকে বলল, বারটার দিকে মোসির উদ্দেশ্যে বাস ছাড়বে। আর আগামীকাল ছাড়বে সকাল ছয়টায়। আমি তাদের সেখানে বুকিং দিতে পারি। আমি কিলিমানজারো পাহাড় দেখার জন্য কোন প্যাকেজ টুর আছে কিনা জানতে চাইলাম। তারা আমাকে যা বলল, এতে আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না।

এ সময় মনে হল, দেখি রফিক ভাই উগান্ডা থেকে ফিরেছেন কি না। কিন্তু তিনি উগান্ডায় আছেন। তবে আমার ফোন ধরলেন। এ ভাই তানজানিয়ায় একটি ইনজিনিয়ারিং বিভাগে কনসালটেনসি করেন। মাসাইমারা ভ্রমণের সময় গিয়াস নামে আর এক ইনজিনিয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে তার নম্বর নিযেছিলাম। তিনি নাইরোবিতে রোড কন্সট্রাকশন এডভাইজার।

রফিক ভাই বললেন, তিনি সন্ধ্যে নাগাদ দারুস সালাম পৌঁছিতে পারেন। তবে তিনি আমাকে ব্র্যাকের তানজানিয়ার কান্ট্রি ডিরেকটর বারী ভাইয়ের নম্বর দিলেন। আমি বারি ভাইকে ফোনে পেলাম না। তবে আমার মনে হল, তিনি এখন ব্যস্ত, হয়তো পরে ধরবেন। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আজ দারুস সালামেই থাকব।

কিন্তু সমস্যা হল, এ ট্রাভেল এজেন্সির লোকজনদের নিয়ে। এখন চলছে পর্যটনের মন্দাকাল। খদ্দের কম। আমি তাদের একজন খদ্দের হতে হতেও হলাম না। তারা হতাশ হয়ে পড়ল। আমাকে বলল, তুমি আমাদের কাছ থেকে তথ্য নিলা। এখন তথ্যের দাম দাম দাও। পাঁচ ডলার ছাড়। আমি অনেকটা অবাকই হলাম। মনে মনে ভাবলাম, এখানে এতটা বাটপাড়ও আছে? আমি তাদের সাথে তর্ক করলাম। আমি তোমাদের প্যাকেজের খোঁজ খবর নিয়েছি। এটা তোমাদের পণ্য। বাজারে কোন পণ্যে দামাদামী করলে, গুনাগুণ জানতে চাইলে তো তা কেনার বাধ্যবাধকতা নেই। তোমার এখানে এসে পণ্যের দাম ও গুণাগুণ জানতে চাইলেই যে কনসালটেন্সি ফি দিতে হয়, এটা কোথা্ও লিখা নেই।

কিন্তু সে নাছোড় বান্দার মতো পীড়াপীড়ি করতে থাকল। আমি ভাবলাম, এখান থেকে ভাগি। কিন্তু সে আমার সামনে দাঁড়াল। বলল, পুলিশ ডাকি। পুলিশের কথা শুনে আমি বরং থুশিই হলাম। আমি নিজে পুলিশ সদস্য। এ পরিচয় দিলে স্থানীয় পুলিশ নিশ্চয়ই আমার বিষয়টা বুঝবেন এবং আমার পক্ষই নিবেন। আর কোন পর্যটন শহরে ট্রাভেল এজেন্টদের এমন বাটপাড়ি তো কোনভাবেই স্বীকৃত হতে পারে না। কিন্তু পুলিশ এলো না, আমাকে তারা আটকাতেও পারল না।

রাস্তা পার হয়ে টেক্সি ধরতে গেলাম। অনেক টেক্সিওয়ালা পাড়াপাড়ি শুরু করল। আমি বললাম, কোথাও যাব না। তবে একটু দূরে গিয়ে টেক্সিভাড়া করলাম। বেটারা বহু টাকা চাইল। কিন্তু আমি জানি এটা ১৫ হাজার শিলিং এর বেশি হবে না। তা্ই ১০ হাজার শিলিং দিতে চাইলাম। শেষ পর্ন্ত এগার হাজার শিলিং এ রফা হল।

হোটেল পার্ল প্যালেস-২

একটা ছোটখাট রঙচটা টেক্সিতে করে রওয়ানা দিলাম হোটেল পার্লস এর উদ্দেশে। হোটেলটা দারুস সালামে খুব বেশি পরিচিত নয়। তাই মাডার্ন কোস্ট সার্ভিসের টিকিট কাউন্টারের পাশে বলে লোকেশান দিলাম। প্রথম দিন দারুস সালাম এসে যে হোটেলে উঠেছিলাম তার ভাড়া ছিল প্রতি রাত ৪০ ডলার। কিন্তু সেবার মান ছিল একেবারেই বাজে। তাই এবারের যাত্রায় একটা অল্প দামের হোটেলে উঠতে চাইছিলাম। আমার সাথে মসলা সফরে যে আমেরিকান বিউটিসিয়ান লাস্ট্রার ছিল সেই আমাকে জান্জিবারের ফুঙগুনি হোটেলেই এ হোটেলের ঠিকান দিয়েছিল। তার কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে আমি ওদের আগে ফোনও করেছিলাম।

এ হোটেলের ভাড়া প্রতি রাত মাত্র ১৯ ডলার। আমাকে নিচ তলার একটি রুম দেয়া হল। রুমে একটি ছোট খাট আছে। আছে এসি। তবে এর ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। তবে আমি থাকব মাত্র একটি রাত। সারাটা দিন ক্লান্ত হয়ে হোটেলে এসে ঘুমাব মাত্র। তাই অসন্তুষ্ট হবার কিছু নেই। গত ১৬ মে রাতে জানজিবার যাবার পথে দারুস সালামের ঐ রঙ্গুয়ে হোটেলের ৪০ ডলারের ভাড়ার বিপরীতে এই ১৯ ডলারের হোটেল পার্ল প্যালেস-২, বরং অনেক ভালই বলব।