মৃত্যুর অনুমতি চেয়ে আবেদনঃ বাংলাদেশ প্রবেশ করল শুভ মৃত্যুর যুগে

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 22 Jan 2017, 06:47 AM
Updated : 22 Jan 2017, 06:47 AM

সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন মেহেরপুরের এক বাবা। তাঁর দুই সন্তান ও এক নাতি দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত। দেশে-বিদেশে তাদের চিকিৎসা করিয়ে বাঁচানোর কোনো পথ পাননি। মেহেরপুর জেলা শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বেড়পাড়া গ্রামের ফল ব্যবসায়ী জনৈক তোফাজ্জেল সম্প্রতি জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করে তার দুই ছেলে ও এক নাতির মৃত্যু ঘটানোর অনুমতি চেয়েছেন। এ নিয়ে প্রচার মাধ্যমে বইছে তুমুল ঝড়। তোফাজ্জলের একটি আবেদনে যেন গোটা দেশ জেগে উঠেছে। কি এমন কারণ যে একজন মানুষ তার সন্তানদের মেরে ফেলার অনুমতি প্রার্থনা করতে পারেন?

জানা গেছে, তোফাজ্জলের দুই ছেলে সবুর, রায়হানুল ও মেয়ের ছেলে (নাতি) সৌরভ ডুশেন মাসকুলার ডিসট্রোফি (ডিএমডি- Duchenne Muscular Dystrophy) নামের এমন এক রোগে আক্রান্ত এখন পর্যন্ত যার কোন চিকিৎসা বা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। তারপরও চিকিৎসা করাতে ও প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র কিনতে তোফাজ্জল এখন নিঃস্ব। তার চেয়েও বড় কথা হল, তার সন্তানগণ অসুখের যন্ত্রণায় তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে। অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না। আর যে রোগের চিকিৎসা নেই, সে রোগ নিয়ে যন্ত্রণাকাতর জীবন-যাপনের কোন মানেই হয় না।

তবে তোফাজ্জেল হোসেনকে আশার বাণী শুনিয়েছেন ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হোমিওপ্যাথি হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তাঁরা জানিয়েছেন, দীর্ঘ মেয়াদের চিকিৎসায় এ রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব। যদি সেখানে ভর্তি করা যায়। একটু আশার পথ দেখলেও অর্থসংকটের কারণে সন্তানদের চিকিৎসার পথ না পেয়ে বাধ্য হয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে তোফাজ্জেলের আবেদন হয় আক্রান্ত ছেলেদের মৃত্যুর অনুমতি অথবা চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া হোক।

নিজের বা প্রিয়জনদের মৃত্যু ঘটানোর ইচ্ছা প্রকাশ বা অনুমতি প্রার্থনার এ ধরনের আবেদন আমাদের কাছে যত নতুনই হোক না কেন, এটা আদতে কোন নতুন বা অভিনব বিষয় নয়। বাস্তব কারণেই যখন বেঁচে থাকা অসহনীয় হয়, তখন মানুষ জীবন থেকে মুক্তি চায়। বিত্ত-বৈভব, খ্যাতি-ক্ষমতা, কর্তৃত্ব-খবরদারিত্ব সব কিছুতেই প্রতিষ্ঠা পাবার নিরন্তন সংগ্রামে জয়ী হয়ে যে জীবনকে মানুষ তিলে তিলে গড়ে তোলে, হতাশা, যন্ত্রণা আর বিতৃঞ্চার কবলে পড়ে সেই জীবনকেই মানুষ মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করার সহজতম যন্ত্রণাহীন পথ খোঁজে, আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ সমাজের কাছ থেকে আইনী অধিকার চায়।

অথচ কেবল বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর সব সমাজেই আত্মহত্যা করা কিংবা কোন অসুস্থ ব্যক্তিকে আত্মহত্যায় সহায়তা করা অপরাধ। কিন্তু বাস্তব অবস্থা এই যে মানুষ এক সময় তার জীবন থেকে মুক্তি চায়। এ মুক্তি চাওয়ার বিষয়টি অনেক সময় ধর্মীয় আচারের মাধ্যমেও হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের মুসলমানগণ গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের হয় মুক্তি, নয়তো মৃত্যুর জন্য দেয়া করে, খাজে খতম কিংবা ইউনুস খতম করে। উন্নত বিশ্বে জীবনের একটি পর্যায়ে জীবন থেকে স্বেচ্ছায় বিদায় নেয়ার জন্য আত্মহত্যা করা কিংবা আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে ডাক্তার কর্তৃক মরণঘাতি ঔষধ প্রয়োগের অধিকার আদায় করার জন্য অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন আন্দোলন পর্যন্ত করে।কিন্তু যন্ত্রণাকাতর হলেও জীবনকে স্বেচ্ছায় নষ্ট করার কিংবা এ কাজে সহায়তা করার কাজের আইনগত স্বীকৃতি কোন কালেই বিতর্কহীন ছিল না, এখনও নেই।


রোগযন্ত্রণা বা দুঃখ-কষ্ট হতে অব্যহতির জন্য শান্তিপূর্ণ উপায়ে আত্মহত্যা বা মরে যাওয়ার বিষয়টিকে বলা হয় ইউথ্যানাশিয়া, যার বাংলা প্রতিশব্দ বা পরিভাষা হতে পারে শুভমৃত্যু। এই ইউথ্যানাশিয়াকে এখন অনেকে ব্যক্তিগত অধিকার হিসেবে দাবি পর্যন্ত করছে। শান্তিপূর্ণ স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার আদায়ের জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে গড়ে উঠেছে নানান প্রকারের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তারা নানাভাবে, নানা যুক্তি দেখিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন, আবেদন করছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য করছেন যে রোগ-শোকে মুহ্যমান আদম সন্তানের যখন আর সুস্থ্য জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে না, অথচ অমানবিক যন্ত্রণায় সারাক্ষণ তারা নিজে যেমন দগ্ধ হচ্ছেন আর অন্যদেরও দগ্ধ করছেন, তাদের সেই অভিশপ্ত জীবনকে ধ্বংস করাই মানবিক। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের গড়পড়তায় এখনও বোঝানো সম্ভব হয়নি। তাই তো পৃথিবীর নগণ্য সংখ্যক কিছু রাষ্ট্র ভিন্ন অন্য কোথাও ইউথ্যানাসিয়া বা শুভমৃত্যুর অনুমতি নেই।

তারপরও এ মুহূর্তে পৃথিবীর অন্তত চারটি দেশ- নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ও কলম্বিয়ায় পুরোপুরিভাবে ইউথানাশিয়া বৈধ রয়েছে। এর বাইরেও জাপানসহ আরো চারটি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ছয়টি অঙ্গরাজ্যে ডাক্তারদের সহয়তায় ইউথ্যানাসিয়াকে বৈধ করা হয়েছে।

ইউথানাসিয়া সম্পর্কে আধুনিককালের বিতর্ক ১৮৭০ সালে শুরু হলেও প্রাচীনকালেও এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দারুণ বিতর্ক ছিল। প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও এ নিয়ে বিতর্ক ছিল। প্রাচীন গ্রিসে হেমলক পানে আত্মহত্যা থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত কার্যকরের ব্যবস্থা ছিল। প্রাচীন গ্রিসে ইউথ্যানাসিয়া নিয়ে যে বিতর্ক চলত তার পক্ষে ছিলেন সক্রেটিস ও প্লেটোর মতো দার্শনিকগণও। আর বিধির কি লিখন, শুভমৃত্যুর সমর্থক সক্রেটিসকেই কালক্রমে এ ধরনের মৃত্যুর আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তবে তা ছিল আদালতের নির্দেশক্রমে।

প্রাচীন রোমে ইউথ্যানাসিয়া বৈধকর্মই ছিল। এমনকি রোমান সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তথা প্রথম রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজার নিজেও এ শান্তিপূর্ণ স্বেচ্ছামৃত্যুর আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার এ কাঙ্খিত মৃত্যু হয়েছিল তার প্রিয়তমা পত্নী লিভিয়ার কোলেই। আর সেই সময়ের ঐতিহাসিক সুটোনিয়াস (historian Suetonius) তা প্রত্যক্ষ করে যে বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন সেই লেখনিতেই এ অবিধা (টার্ম) টির উদ্ভব হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জও ইউথানাসিয়ার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। তার চিকিৎসকগণ মরফিন ও কোকেইনের অতিরিক্ত ডোজ দিয়ে তার যন্ত্রণাহীন মুত্যু নিশ্চিত করেছিল। তবে বিষয়টি সেই সময় গোপন রাখা হয়েছিল এবং তার মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পর তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়।

ইউথ্যানাসিয়াকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমটি হল স্বেচ্ছামৃত্যু (Voluntary)। এখানে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিজে কিংবা তার ডাক্তারের সহায়তায় চেতনানাশক প্রাণঘাতি ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে মুত্যু কার্যকর করে। অনিচ্ছা প্রসূত (Nib-voluntary) শুভ মৃত্যুতে ব্যক্তির সম্মতি দেয়ার কোন সুযোগ থাকে না। যেমন কোমায় যাওয়া কোন রোগীর মৃত্যু ঘটানোর সিদ্ধান্ত চিকিৎকগণ কিংবা তার আত্মীয়-স্বজনরাই নিযে থাকে। অন্যদিকে  বাধ্যকৃত (In-Voluntary) শুভ মৃত্যু আদালতে আদেশে কিংবা  অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে।

আলোচ্য প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লেখিত হতভাগ্য তোফাজ্জলের দুই সন্তান ও এক নাতির জন্য ইউথ্যানাসিয়ার আশ্রয়গ্রহণ ঠিক কোন শ্রেণিতে পড়বে তা বিতর্কের বিষয়। তবে এ নিয়ে বিতর্ক না থাকাই স্বাভাবিক যে তোফাজ্জল তার সন্তান ও নাতির ইঊথ্যানাসিয়া ঘটিয়ে এক যন্ত্রণা থেকে তাদের যেমন মুক্তি দিতে চান, তেমনি মুক্তি পেতে চান নিজেও।

প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে উত্তরাধুনিক কাল পর্যন্ত মানুষের স্বেচ্ছামৃত্যুর বৈধতা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে বিতর্ক চলছে। কিন্তু এ বিতর্ক এখন পর্যন্ত অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। আর ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ইউথ্যানাশিয়া বা শুভমৃত্যুর বিপক্ষের পাল্লাই এখন পর্যন্ত ভারী রয়েছে।

সম্ভবত বাংলাদেশে এই প্রথম কেউ ইউথ্যানশিয়া বা শুভ-মৃত্যুর দাবি নিয়ে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে আসল। তাই তোফাজ্জলের চিঠি আমাদের যারপরনাই অবাক করেছে। কিন্তু আমাদের সমাজের পরিবর্তন যে দ্রুততার সাথে হচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে এ শুভমৃত্যুর দাবি তুলে যদি এক বা একাধিক সংগঠন দাঁড়িয়ে যায়, অবাক হবার কিছু থাকবে না।

(২২ জানুয়ারি, ২০১৭, ইউএন হাউজ, জুবা, দক্ষিণ সুদান)।