অন্য দেশে, অন্য মিশনে: মুশিকি থেকে সাকে

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 15 Feb 2017, 07:31 PM
Updated : 15 Feb 2017, 07:31 PM

২৩ নভেম্বর, ২০১৬। বিকেল সাড়ে তিনটায় মুশাকি ক্যাম্প থেকে সাকে  এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। মুশাকি-কে ভোলার সুযোগ নেই। কেবল এ স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই নয়, এ ক্যাম্পের অফিসারদের আন্তরিকতা ও আপ্যায়নের জন্যও তাদের মনে রাখতে হবে। আমাদের থাকা খাওয়া ও বেড়ানোর প্লান-প্রোগ্রাম তারাই তৈরি করেছেন ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। তাই বিদায় বেলা তাদের ছেড়ে আসতে কষ্টই হল। মনে হয়েছিল, যদি আরো কয়েকটি দিন না হলে অন্তত আর একটি দিন এখানে থেকে যাই। বিদায়ের মুহূর্তে মেজর রুজিনা প্রশ্ন করেছিলেন, মুশাকি কেমন লাগল, আমি রসিকতা করে বলেছিলাম, দেশে বউ আর বাচ্চাগুলো না থাকলে এখানে একটা বিয়ে করে থেকেই যেতাম! কিন্তু সেটা হল না। কারণ আগামীকাল গোমা শহরটা একটু দেখতে হবে আর সেই সাথে কিনশাসা যাবার বিমানের অনিশ্চয়তাও দূর করতে হবে।

একজন সিনিয়ার ওয়ারেন্ট অফিসারের নেতৃত্বে আমাদের নিরাপত্তাসহ জিপটি রওয়ানা দিল বিকাল সাড়ে তিনটা। এখান থেকে সাকে শহরটি খুব বেশি দূরে নয়। সোজাসুজি মাপলে হয়তো চার/পাঁচ কিলোমিটার হবে। দুটো পাহাড় পার হলেই সমতল ভূমি। এ সমতল ভূমিতেই সাকে শহরটি। এ শহরে ইউএন এর অপারেশনাল কিছু ইউনিট আছে। তার সাথে আছে আমাদের বাংলাদেশ মিলিটারি পুলিশের একটি ক্যাম্প।  আজ রাতটা আমাদের সেখানেই থাকতে হবে। মেজর মাহমুদই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাদের জিপ যাওয়া মাত্রই সেখানে মেজর সাকিল আমাদের অভ্যর্থনা জানাবেন। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। মুশিকি এলাকায় কখন বৃষ্টি নামে, আর কখন রোদ ওঠে তা বলাই মুসকিল। আজ সকাল থেকে অন্তত চারবার বৃষ্টি এল আর গেল। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। হয়তো একটু পরেই তা থেমে যাবে, আকাশে উঠবে সূর্য। চমৎকার নরোম রোদে ভরপুর হবে পাহাড়ের চূড়াগুলো।

মুশাকিতে আসার সময় পাহাড় বেয়ে বেয়ে উপরে উঠেছিলাম। তাই সময় বেশি লেগেছিল। এবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বেয়ে নামব। তবে তাই বলে যে খুব দ্রুত হবে, তা নয়। কারণ পাহাড়ি পথে গাড়ি নিয়ে উঠতে যতটা সাবধান থাকতে হয়, নামতে গেলে তার চেয়েও বেশি সাবধানী হতে হয়। গতকাল আসার সময় আমি গাড়ির বাম দিকে ছিলাম। আমাদের গাড়িটি যে পথ বেয়ে এসেছিল তা ছিল উপত্যকার বাম দিকের পাহাড়শ্রেণি ঘেঁসে। তাই উপত্যকাটি পড়েছিল হাতের ডান দিকে যে দিকে ড্রাইভার বসে থাকে। তাই ঐ সময় উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে একটু অসুবিধাই পড়েছিলাম।

কিন্তু এবার উর্বর উপত্যকাটি পড়ল আমার জানালার দিকে। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনের সকল স্বাদ মিটিয়ে ভোগ করলাম। কি অপরূপ শোভা! পাহাড়ের পথগুলো তৈরি হয় সাধারণত উপত্যকাকে পাশে রেখে। দুই দিকে দুটি পাহাড় শ্রেণি, মাঝখানে নিচু ভূমি। এই নিচু ভূমিতে এসে পাহাড় বেয়ে বৃষ্টির পানি ও ঝরনার পানি পড়ে। তখন এখানে নদী তৈরি হয়। এই নদীর দুই পাড়েই গড়ে ওঠে মানুষের বসতি। ডিআর কঙ্গোর এ উপত্যকাটি যেমন উর্বর, তেমনি এখানে চলে আবাদ-ুসবাদ। যত দূর চোখ যায় ততোদূরের সব পাহাড়েই চাষাবাদের চিহ্ন। আবাদের মধ্যে আছে কাসাভা, মিষ্টি আলু, গোল আলু, বিন বা সিম ও এক ধরনের কচু। পাহাড়ে বড় বড় গাছ চোখে পড়ে না বললেই চলে। অনেক স্থানে ইউক্যালিপ্টাস বাগান আছে। ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, পেপেঁ চোখে পড়ল। কলাও আছে, তবে খুব বেশি মনে হল না। আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে চলছে মোটর সাইকেল। তিনজন করে যাত্রী বহন করছে এরা। যেখানে যাত্রী দুজন, সেখানে দ্বিতীয় যাত্রীর পিছনে কলার ছড়া বা অন্য কোন মালপত্র। রাস্তা সম্পূর্ণ কাঁচা। অনেক স্থানে ভাঙ্গাও। অনেক স্থানে বৃষ্টির পানিতে গর্ত তৈরি হয়েছে। কিছু কিছু স্থানে রাস্তার উপর মাঝারি আকারের পাথরে ভরা। মোটর সাইকেল এ পাথরের উপর দিয়েই চলছে।

রাস্তার পাশে কয়েকটি স্থান থেকে নিচের পাহাড়ের উপর ফসলের ক্ষেত এত মনোরমভাবে দেখা যায় যে আমরা সেখানে না থেমে পারলাম না। বলা বাহুল্য, সেনাবাহিনীর নিয়মানুসারে রওয়ানা দেয়া থেকে শুরু করে গন্তব্যে পৌঁছানোর মাঝখানে কোন স্থানে থামার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের অনুরোধ সেনাসদস্যগণ উপেক্ষা করতে পারলেন না। আমরা দুইটি স্থানে নেমে ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম। স্থানীয় কিছু লোক আমাদের কাছে এল। কিন্তু এরা ইংরেজি বোঝে না। তবে আমাদের কাছ থেকে কিছু ডলার যাঞ্ছনা করল। ইউএন সদস্যদের কাছ থেকে খাবার ও টাকা পয়সা চাওয়া মিশন এলাকায় নতুন কিছু নয়। তবে নিয়মানুসারে তাদের কোন কিছু দেয়া বিধি সম্মত নয়।

প্রায় এক ঘন্টা পর আমরা পাহাড়ী পথ শেষ করে সাকে শহরে প্রবেশ করলাম। শহরের কিয়দংশ দেখে মনে হবে এটা সম্পূর্ণ সমতল ও উর্বর। কিন্তু একটু সামনে আগালেই বোঝা যাবে এটা একবারে সমতলও নয় আর উর্বরও নয়। এ সমতল অংশটি শেষ হওয়ার পরেই শুরু হল পাথর আর কালো কালো কাঁকর। আসলে এখন আমরা প্রবেশ করলাম নাইরোগোঙ্গো জীবন্ত আগ্নেয়গিরির লাভার রাজ্যে। শহরের বাড়িঘরগুলো তৈরি হয়েছে শীতল লাভা জমাট বেঁধে তৈরি হওয়া পাথর থেকে। পাথরগুলো সম্পূর্ণ নিরেট নয়। অনেকগুলোর মাঝে মাঝে ফাঁকা স্থান রয়েছে। কিছু কিছু স্থানে রয়েছে পথরের ঢিবি। এসব ঢিবির উপর   উপরিভাগে ভাঁজপড়া পাথর। স্পষ্ঠ বোঝা যায় যে লাভার স্রোত উপর থেকে নিচের দিকে আসতে আসতে এ স্থানে থেমে গেছে। গোটা শহরে কালো কালো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরের কণা। এগুলো আসলে আগ্নেয়গিরির  উদগিরিত ছাই বা এস।

সাড়ে চারটায় আমরা সাকে শহর থেকে সামান্য ভিতরে হ্রদের পাড়ে জাতিসংঘের বেইজে প্রবেশ করলাম। ফটকের বাইরে কঙো সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট। চেকপোস্টকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সৈনিকদের আবাসিক এলাকাও। আমাদের সাথে ব্যান ইন্জিনিয়ারের সেনাসদস্যগণ  কঙ্গো সেনাবাহিনীর বাসভবনগুলো দেখিয়ে অবজ্ঞার সুরে বললেন, 'দেখলেন স্যার, এদের সেনাবাহিনীর সদস্যদের থাকার ব্যবস্থা?' হ্যাঁ, তাদের অবস্থা শোচনীয় বটে! কিন্তু একটি গৃহযুদ্ধ কবলিত দেশের সরকারি চাকুরেদের সুযোগসুবিধা আর কত সুন্দর হবে? এরা যে বেতনভাতা না পেয়েই মাসের পর মাস সরকারি চাকরি করছে, আমাদের সেনাসদস্যরা সেটা হয়তো জানেন না।

আমাদের গন্তব্য হল হ্রদ কিভুর পাড়ে বাংলাদেশ মিলিটারি পুলিশের অপারেশনাল ক্যাম্প। এ ক্যাম্পে আমাদের নামিয়ে দিয়েই ব্যান ইন্জিনিয়ারের সেনাসদস্যরা বিদায় নিলেন। তখন বিকেল সাড়ে চারটা বাজলেও মেঘে ঢাকা আকাশ ও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির জন্য অনেকটাই অন্ধকার হয়ে এসেছে। একটি গ্রুপ ছবি তুলেই আমরা ওদের ছেড়ে দিলাম। সেলুট করে তারা বিদায় নিলেন। একটি ঘন্টার যাত্রায় তাদের সাথে আমাদের বেশ হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল।বিদেশের মাটিতে দেশের মানুষকে এত বেশি আপন মনে হয়, সেটা আবার বুঝতে পারলাম।

(চলবে–)