ধর্ম, জাতীয়তা ও কাতার সংকট

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 15 June 2017, 11:24 AM
Updated : 15 June 2017, 11:24 AM

ধর্ম ও জাতীয়তার মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য আছে, অনেক ধর্মান্ধ ব্যক্তি তা আমল দিতে চায় না। বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অনেকেই মনে করেন, পৃথিবীর তাবৎ মুসলমান এক জাতি এবং তাদের পিতা হলেন হযরত ইব্রাহিম। কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাস যাই হোক না কেন, বাস্তবতা ভিন্ন।

ধর্ম জাতি গঠনের একটি উপাদান হতে পারে। কিন্তু তাই বলে মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ই আধুনিক জাতীয়তার সব কিছু নয়। আধুনিক জাতীয়তার উপাদানগুলোর মধ্যে ভৌগোলিক অবস্থান ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়  সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর জাতিরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের চেয়েও ভৌগোলিক পরিচয় আরো বেশি বিবেচ্য বিষয়। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রিয়ার ভাষা জার্মান এবং নৃতাত্বিকভাবে তারা সবাই শ্লাভ বা জার্মান হলেও তারা কিন্তু এখন অস্ট্রিয়ান, জার্মান নয়। একইভাবে, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বাংলাদেশের মানুষের মতো নৃতাত্ত্বিকভাবে বাঙালি হলেও তারা এখন বাংলাদেশি নয়, ভারতীয়।

একমাত্রা ইরান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো দেশই আরবী ভাষী এবং নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে অনেকটাই আরব।  তারা সবাই একই ধর্মের অনুসারী। কিন্তু তাদের ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক না কেন, তারা ভৌগোলিক ও অনেকটা নৃতাত্ত্বিকভাবে এক একটি আলাদা জাতি তৈরি করেছে। এই জাতির সংশক্তি ধর্মীয় টানের চেয়ে অনেক বড়।

সম্প্রতি কাতার সংকট মানুষের ধর্মীয় পরিচয়ের দুর্বলতা প্রকট করে তুলেছে। ভাষা ও ধর্মে এক এবং নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে কাছাকাছি হয়েও কয়েকটি ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ কাতারকে ধ্বংস করার খেলায় মেতেছে।

কাতারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পিছনের কারণ যাই হোক না কেন, কাতারের প্রশাসনিক স্বকীয়তা ও তার হাতে থাকা আল জাজিরা নামের বহুল প্রচারিত ও বহুল জনপ্রিয় প্রচারমাধ্যমটাকে ধ্বংস করাই যে ঐসব দেশের স্বৈরশাসকদের মূল উদ্দেশ্য তা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

আল জাজিরা সারা বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠীই শুধু নয়, গোটা আরব জগতের বাইরেও গোটা আফ্রিকাতে এর অবস্থান অনেকটাই বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার বিকল্প হিসেবেই। এই  প্রচার মাধ্যম সৌদি আরবসহ অনেক আরব রাষ্ট্রের রাজতন্ত্র এবং মিশরের মতো একটি জঘন্য শাসকগোষ্ঠীর কাছে আসলেই ভীতিকর। তাই তারা আল জাজিরাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক।

মুসলমানদের পবিত্র স্থানসমূহের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিতে সৌদি আরব যে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে অনেক দূরে  অবস্থান করছে সেটা সবাই জানে ও বোঝে। এমনতাবস্থায়, মুসলিম বিশ্বের কাছে সৌদি আরব যতই নেতৃত্বের দাবীদার হোক, প্রকৃত অর্থে সেটা হয়ে ওঠেনি। আর যেহেতু তারা রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতিভূ এবং তাদের বিপরীতে প্রায় সকল মুসলিম দেশই গণতান্ত্রিক ধারায় শাসিত হচ্ছে, তাই সৌদি আরব রাজতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক যে কোন মতবাদকেই প্রচণ্ড ভয় পায়। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রাজতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি। তাই আলজাজিরার অস্তিত্ব তারা মেনে নেবেন না এটাই স্বাভাবিক।

সৌদি আরবসহ অন্যান্য অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসিত রাষ্ট্রগুলোর বড় সহায় হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা চায়, যেমন করে চায় ঐসব রাষ্ট্র তেমন আচরণই করবে। কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্তের পিছনে যে মার্কিন ইন্ধন ছিল এবং এর সাথে যে ইহুদী লবিটিও সম্পৃক্ত তার প্রমাণ প্রাওয়া যায় এর অব্যবহিত পরেই মার্কিন রাষ্ট্রপতির  ও ইসরাইলী এক সাবেক মন্ত্রীর দাবী থেকে।

ইসরাইলের এক সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক সেনা প্রধান বলেছেন, সুন্নী মুসলমানগণ এখন নাকি তাদের নৌকায়। কেবল শিয়া মতের ইরান তাদের নৌকায় নেই। তাই এখন সবাই মিলে ইসরাইলের শত্রু ইরানকে ধ্বংস করা সহজতর হবে।

অন্য দিকে  সৌদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও ক্রাউন প্রিন্স সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যে সৌদি আরব ছাড়া বিশ্বের অন্য দেশের মুসলমানগণ প্রকৃত মুসলমান নন। পৃথিবীর খাঁটি মুসলমান হল কেবল সৌদিরাই। সৌদি মন্ত্রীর কথায় অনুমান  করা যায় যে  এ সব দেশ এখন ইসরাইলের দখলেই চলে গেছে। নইলে কোন প্রকৃত মুসলমান, অন্য মুসলমান রাষ্ট্র বা জাতির মুসলমানিত্বে  এমন সন্দেহ পোষণ করতে পারে না।

মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে আল্লাহর উপর তাদের বিশ্বাস ও তাকওয়ার উপর। যে দেশের শাসকগোষ্ঠী ইসলামের মৌলনীতির ব্যত্যায় ঘটিয়ে রাজতান্ত্রিক উপায় দেশ শাসন করছেন, তারাই আবার  গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত অন্যান্য রাষ্ট্রের মুসলমানদের নিকৃষ্ট বলছে। এটা কিষের আলামত, সেটা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়।

(১৪/০৬/২০১৭ । ঢাকা)