আমার স্কুল, আমার স্মৃতি, আমার কষ্ট

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 7 July 2017, 02:12 PM
Updated : 7 July 2017, 02:12 PM

আমার বাল্যকালের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠটিই হল আমাদের ইদগাহ। তাই ইদের নামাজ পড়তে গেলেই স্কুলের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি যখন প্রথম স্কুলে যাই তখন আমাদের স্কুলের ঘরটি ছিল কাঁচা। ছিল মাটির ঘর। একবার ঝড়বৃষ্টিতে সেই ঘর ভেঙ্গে গেলে আমাদের কয়েকদিন খোলা মাঠে বসে ক্লাস করতে হয়েছিল। এরপর চলল পরিত্যক্ত টিনের চালাগুলো দিয়ে তৈরি একটি খোলা ঘর। তারও পরে একটি ইঁটের তৈরি আধাপাকা ঘর ছিল। এখানে সিমেন্টের  পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছিল মাটি। উপরে ছিল টিনের ধাবড়ি। একমাত্র প্রধান শিক্ষকেরর কামরা ছাড়া ঘরের দরোজা-জানালায় কোন কপাট ছিল না।

গ্রামের মুরব্বিগণ অনেক চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত একটি পাকাঘর করে দিলেন। কিছু টাকা পেলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের  ব্যক্তিগত দান থেকে। বাকী টাকা সংগ্রহ করলেন নিজেদের  দেয়া চাঁদার মাধ্যমে। সংগ্রহীত টাকায় তারা নিজেরাই একটি ইঁটের ভাঁটা দিলেন। ভাঁটার কিছু ইঁট বিক্রি করে, বাকী ইঁট দিয়ে একটি মজবুত টিনসেড ঘর তৈরি করলেন।  বেশ বড় ঘর। কিন্তু এখানে কোন পৃথক কামরা ছিল না। পাঁচটি ক্লাস পাশাপাশি বসত। আমরা এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসের সবই দেখতে পেতাম। এটা ছিল ১৯৭৪ কি ১৯৭৫ সালের ঘটনা। আমাদের টিনসেডের ইঁটের স্কুল ঘর। বলতে কি সেই সময় এটাই ছিল গ্রামের একমাত্র পাকা ঘর।

ধীরে ধীরে আমাদের সামর্থ্য বাড়ল। আমরা দরিদ্র থেকে ধনী হতে থাকলাম। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের বরাদ্দ বাড়তে থাকল। আমাদের স্কুলের জন্য দুই তলার ভিত্তি সম্পন্ন একটি একতলা বিল্ডিং তৈরি হল। তবে পুরাতন সেই টিনসেডের বিল্ডিংটিও থাকল।

২০০০ সালে তৈরি হল সেই মজবুত বিল্ডিংটি। এ বিল্ডিং এর সাথে স্কুলে বসল টিউবয়েল। এর সাথে থাকল একটি সেনিটারি ল্যাট্রিনও। পূর্বে আমরা পানির পিপাসা লাগলে আশেপাশের বাড়ি গিয়ে পানি খেতাম। শিক্ষকদের জন্য পানি আনতাম। আর প্রাকৃতিক কর্মের জন্য ছিল আশেপাশের ঝাড়জঙ্গল। কিন্তু এখনকার ছাত্রছাত্রীদের জন্য আধুনিক সুযোগসুবিধা এল। তার অনেক বেশি সভ্য হল, অনেক বেশি সুবিধা পেল। ১০ বছর পর এই একতলা স্কুলের উপরে আর এক তলা উঠল। আমার গ্রামে একটি মাত্র দুইতলা বিল্ডিং হল। আর সেটা হল আমাদের স্কুল ঘরটিই। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আর স্থানের কোন সমস্যা হল না।

এ সময় আমাদের সেই বাল্যস্মৃতিজড়িত টিনসেডের ঘরটি সরকার নিলামে দিল। শহর থেকে ঠিকাদারগণ এলেন সেটি ভেঙ্গে ইঁট-কাঠ নিয়ে যাবেন। মাঠটি বড় করবেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালে নির্মিত সেই স্কুল ঘরটি তখনই ভালই ছিল। টিনে জঙ ধরলেও তাতে বর্ষায় পনি চোয়াত না। দরোজা জানালার কাঠ পচে গেলেও ইঁটগুলো ছিল প্রায় নতুনের মতোই। সবচেয়ে বড় কথা হল, এ ঘরটি ছিল গ্রামের মানুষের অনেক কষ্টের ফসল। আমার মতোই তাদের বাল্যস্মৃতিজড়িত ছিল এ ঘরটির সাথে। যখন সরকার থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যেত না, গ্রামের মানুষ দরিদ্র ছিল, তখন তারা নিজেদের রোজগার দিয়ে গড়ে তুলেছিল এই ঘরটি। তাই তারা সম্মিলিতভাবে বাধা দিল। শহরের ঠিকাদারগণ ঘরটি আর ভাঙ্গতে পারল না। তবে এটাতে আর ক্লাসও হচ্ছিল না। কিন্তু   পরিত্যাক্ত হলেও সেটা স্মৃতি হিসেবেই স্কুল ক্যাম্পসে দাঁড়িয়ে থাকল একটি আধুনিক পুরাকীর্তি হয়ে।

কিন্তু ঘটনার মোড় ঘুরতে থাকল বিপরীত দিকে। এক সময় ছাত্রছাত্রীগণ দেখল তাদের দুইতলা স্কুল ঘরে ফাটল ধরেছে। ক্রমান্বয়ে সেই ফাটল বড় হতে লাগল। এর পর অন্য স্থানে ফাটল দেখা দিল। সে ফাটলগুলোও বড় হতে থাকল। গ্রামের লোকজন এসে দেখল ফাটলগুলো বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তারা ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় পড়ল। শহর থেকে প্রকৌশলীরা এলেন। তারা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মত দিলেন যে ২০০০ সালে নির্মিত এ পাকা ঘরটি আর বসবাসের উপযোগী নয়। যে কোন সময় এটা ধ্বসে পড়তে পারে। তাই তারা এটাকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করল।

এবার ডিজিটাল যুগের ছাত্রছাত্রীগণ ফিরে গেল ১৯৭৪ সালের এনালগ যুগে।  দুই তলা বিল্ডিং এর গর্ব তাদের সহসাই চূর্ণ হল। ছেঁড়া জামা, নাঙ্গা পা, খাতার পরিবর্তে সিলেট ও পেন্সিল নিয়ে আমরা যে ঘরে ক্লাস করতাম, সম্মৃদ্ধির যুগের বাচ্চারও এখন সেই ঘরেই ক্লাস করে। কী আবেগ আর দূরদর্শিতা ছিল আমাদের গ্রামের মুরব্বিদের! যদি সেই সময় পুরাতন ঘরটি ভাঙ্গা হত, তাহলে  স্বাধীনতার অর্থশত বছর পরেও আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েদের খোলামাঠেই ক্লাস করতে হত।

বড় কষ্টের কাল আমাদের। বড় যন্ত্রণা আমাদের হৃদয়ে। গ্রামের লোকের ঘামের টাকায় নির্মিত ঘরে গ্রামের মানুষের নিজস্ব তদারকী থাকে। কিন্তু সরকারের টাকায় নির্মিত কোটি টাকার প্রকল্পে গ্রামের মানুষের কোনই অংশগ্রহণ নেই। কোটি টাকার বিল্ডিং বানাতে গিয়ে ঠিকাদার জিরো থেকে হিরো হয়ে গেল। তার বাড়ি হল, গাড়ি হল। রাজনীতিতে পদোন্নতিও হল। কিন্তু আমাদের স্কুল ঘরটি তার বিপরীত গতিতে ধ্বসে পড়ার উপকৃম হল। আমাদের সামনেই লক্ষ লক্ষ টাকা মেরে দিয়ে ঠিকাদার আলবৎ চলে গেল। আমরা কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলাম।  ট্যাক্সের টাকা দিলাম। এবার আমাদের বাচ্চাদের জীবন দেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। সরকার অনুমতি না দিলেও আমরা এখন অরণ্যে ফেরত গিয়েছি। (ঢাকা, ০৫ জুলাই, ২০১৭)