থানায় দুই ইন্সপেক্টরের ইতি-নেতি

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
Published : 19 March 2012, 03:06 AM
Updated : 19 March 2012, 03:06 AM

শুধু সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নয়; বরং থানায় কর্মরত অনেক পুলিশ সদস্যের মুখেও শোনা যায়, ইদানিং থানায় নাকি দুই জন অফিসার-ইন-চার্জ বা ওসি পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, একজন ওসি-প্রশাসন, অন্যজন ওসি-তদন্ত। অনেকে আবার অভিযোগের সুরে বলেন, সরকার থানাকে দুর্বল করতেই এক থানায় দুইজন ওসি পোস্টিং দিয়েছেন। এরা কাজের কাজ কিছুই করেন না, কেবল গ্রুপিং বা রেসারেসি করেন। এই নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে বিভ্রান্তি এবং অনেক পুলিশ অফিসার, বিশেষ করে থানায় কর্মরত সিনিয়র ইন্সপেক্টর, যারা অনেক দিন থেকে থানার ওসি-গিরি করে আসছেন, তাদের অনেকেই অনেকভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা যায়।

আমার সাথে অনেক পুলিশ ইন্সপেক্টরের খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। এই বিষয়টি আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি এবং এখনও করছি। এই ব্যবস্থার প্রতি একটি বিভক্ত মতামত রয়েছে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। যে সব ইন্সপেক্টর নতুন পদোন্নতি পেয়েছেন, তারা বড়ই খুশি। কিন্তু পুরাতন ইন্সপেক্টরদের একটা অংশ বেশ মনক্ষুন্ন।

পুলিশের অনেক সিনিয়র অফিসারের মধ্যেও এই সম্পর্কে বিভক্ত মতামত রয়েছে। তবে এই লেখার শুরুতেই বলে রাখছি, পুলিশের মতো একটি সুশৃঙ্খল সার্ভিসে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ বা সিদ্ধান্তে অনানুষ্ঠানিকভাবে বা ঘরোয়া পরিবেশে দ্বিমত করে মতামত পোষণ করা যায়। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কোন কিছু বলা সম্ভব না এবং উচিৎও নয়।

বিষয়টির বিশ্লেষণে প্রথমেই আসা যাক থানায় দুই ইন্সপেক্টরের পদবী সম্পর্কে। থানা প্রশাসনে পুলিশের শুরু থেকেই একই পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তার দায়িত্বপালন স্বাভাবিক বিষয়। বঙ্গ-ভারতের পুলিশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, কোন এক সময় থানায় দারোগা বা সাব-ইন্সপেক্টরই একমাত্র অফিসার ছিলেন। তার সহায়তায় কিছু পাইক বা গোড়সওয়ার বরকন্দাজ থাকত। কিন্তু বিধিবদ্ধ পুলিশ চালু হওয়ার পর থানায় একাধীক দারোগার পদ সৃষ্টি করা হয়। দারোগাদের মধ্যে সিনিয়রতম দারোগাই থানার প্রশাসন ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ করত।

বৃটিশ আমল থেকে শুরু হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের দেড় দশক পর্যন্ত থানায় সিনিয়র সাব-ইন্সপেক্টরই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করত। কিন্তু, ১৯৮৩ সালের পরে থানাগুলোর মান উন্নয় করে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পদটিতে একজন ইন্সপেক্টর পদায়ন করা হয়। এই সময় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তার সাথে দারোগাদের একটি পদগত পার্থক্য সূচিত হয়। বলাবাহুল্য, ভারতের অনেক রাজ্যে এখনও একই থানায় একাধীক সাব-ইন্সপেক্টরের মধ্যে সিনিয়রতম সাব-ইন্সপেক্টর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এমনকি বাংলাদেশের রেলওয়ে থানাগুলোর অফিসার-ইন-চার্জগণ এখনও সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার অফিসার। এমতাবস্থায়, এক থানায় দুইজন ইন্সপেক্টর পদায়ন করলে থানার কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনগত জটিলতা কিংবা পদের অসামঞ্জস্য তৈরির কোন কারণ নেই।

এ কথা ঠিক যে কতিপয় সিনিয়র ইন্সপেক্টর তাদের থানায় দ্বিতীয় ইন্সপেক্টর পদায়ন করার জন্য মনক্ষুন্ন হয়েছেন। তারা এটাকে তার কর্তৃত্ব খর্ব করার বিষয় বলে মনে করছেন। কিন্তু, একই অফিসারকে থানার কাজের ভার ( ওয়ার্ক-লোড) সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলবেন, 'আর বলেন না। একজন মানুষ আর কত খাটতে পারে? দিন নেই, রাত নেই, সারাক্ষণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। দম ফেলার ফুসরৎ নেই। কিন্তু, তাদের যদি বলা হয়, 'অতিরিক্ত একজন অফিসার আপনার কাজের ভার তো কিছুটা হলেও লাঘব করবে, তখন তারা কোন সদুত্তর দিতে পারবেন না।

থানার অফিসার-ইন-চার্জ হিসেবে বহু বছর চাকুরি করেছেন, এমন একজন সিনিয়র ইন্সপেক্টর তর্কের এক ফাঁকে যুক্তি দিয়ে বলেই বসলেন, 'তা হলে প্রতি জেলাতেও দুইজন করে এসপি দেওয়া হোক?

তার যুক্তি সঠিক বটে। কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে না, এসপি পদে জেলায় কাগজে কলমে আসলে দুইজন অফিসার কাজ করছেন। এদের একজন হলেন জেলার এসপি যিনি পুলিশ-জেলার প্রশাসন ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। অন্যজন জেলার বিশেষ শাখার জন্য যিনি গোয়েন্দা বিভাগের কাজ কর্ম পরিচালনা ও সম্পাদন করেন। কিন্তু, এই দুই পদে শুরু থেকেই একই ব্যক্তি কাজ করে আসছেন। দুই পদের জন্য দুই জন পুলিশ সুপার পদায়ন করা যুক্তিসংগত হলেও বাংলাদেশ সরকারের এতটা আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই। একটি জেলায় ডিএসবি এর জন্য এক জন পৃথক পুলিশ সুপারের পদ সৃষ্টি করতে হলে তাদের অফিস, আবাসন, যানবাহন ইত্যাদির জন্য যে বিশাল অংকের আর্থিক ব্যয় হবে তা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এই মুহূর্তে বহন করা সম্ভব নয়।

.

বলাবাহুল্য, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার প্রাথমিক পর্যায় শুরু হয় থানায় রুজুকৃত মামলার তদন্ত দিয়ে। থানা পুলিশের তদন্তের গুণগতমানই বিচার-ব্যবস্থার উৎকর্ষ নির্ধারণ করে। তদন্তের গুণগত মান নিশ্চিত করা না গেলে অপরাধীদের আদালতের মাধ্যমে শাস্তিদান সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের আদালতে সাজার হার এখনও সন্তোষজনক নয় । এদেশে সাজার হার মাত্র ২৪%। অর্থাৎ শতকরা ৭৬ টি মামলার চূড়ান্ত রায়ে আসামীরা খালাশ পায় । এমতাবস্থায়, পুলিশ প্রশাসন তথা সরকার তদন্তের মান উন্নয়নের জন্য নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। এই লক্ষ্যে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এর সম্প্রসারণের কাজ চলছে। একই সাথে চলছে তদন্তের জন্য একটি পৃথক ব্যুরো তৈরি করার কাজও। এই বিভাগগুলো সম্প্রসারণ বা সৃষ্টি হলে জেলার পুলিশ সুপারের বাইরেও প্রতিটি জেলায় না হলেও অন্তত কয়েকটি জেলা মিলে একজন করে পুলিশ সুপারের পদ তৈরি হবে।

থানায় কর্মরত ইন্সপেক্টরদের মধ্যে সিনিয়র ইন্সপেক্টরের পদবী হল ইন্সপেক্টর (প্রশাসন ও অপারেশন)। ইনি অবশ্যই থানার অফিসার-ইন-চার্জের দায়িত্ব পালন করবেন। থানার সার্বিক প্রশাসনের দায়িত্ব হল অফিসার-ইন-চার্জের। তাই, তার অধীনে কর্মরত সকল পুলিশ সদস্যের সার্বিক পরিচালনা এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণের সার্বিক দায়িত্বও তারই।

অন্যদিকে থানার জুনিয়র ইন্সপেক্টরের পদবী হবে ইন্সপেক্টর (তদন্ত)। তিনি ইন্সপেক্টর (প্রশাসন ও অপারেশন) কে সার্বিক কাজে সহায়তা করবেন। তবে তিনি মূলত তদন্তের জন্যই দায়ী থাকবেন। থানায় মামলা রুজু হলে তা তদন্তের জন্য ইন্সপেক্টর (তদন্ত) এর নিকট প্রেরণ বা হাওলা করা হবে। ইন্সপেক্টর (তদন্ত) কিছু মামলার তদন্ত নিজে গ্রহণ করবেন ও অন্যান্য মামলা সাব-ইন্সপেক্টরদের দিয়ে করাবেন। এ ক্ষেত্রে থানায় তদন্তাধীন সকল মামলার তদন্তের প্রাথমিক তদারকির ভার ইন্সপেক্টর (তদন্ত)ই গ্রহণ করবেন।

পুলিশি কাজের প্রাণ হচ্ছে তদন্ত। কিন্তু, আইন-শৃঙ্খলা তথা তাৎক্ষণিক চাহিদা পূরণে ব্যস্ত থাকায় থানার অফিসার-ইন-চার্জের পক্ষে তদন্তে নিবিড়ভাবে সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। এই জন্য থানার তদন্তের মান নিম্নগামী হতে থাকে। থানায় একজন অতিরিক্ত ইন্সপেক্টর নিয়োগের ফলে এই তদন্তের মান উন্নত হবে বলে আশা করা যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক থানায় কর্মরত ইন্সপেক্টরদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বন্টন করেছেন। এই দায়িত্ব বন্টন বা চার্টার অব ডিউটিতে ইন্সপেক্টর (প্রশাসন ও অপারেশন) এর ৩১ টি ও ইন্সপেক্টর (তদন্ত) এর ১২ টি কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে ।

জনগণের সেবাদানে প্রত্যয়ী অফিসার-ইন-চার্জগণ সরকারের এই পদক্ষেপকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করেন। এই বিষয়ে মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার অফিসার-ইন-চার্জ জনাব মোঃ মোশারফ হোসেন বলেন, ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার দুইজন পুলিশ অফিসার থানায় পদায়ন করার ফলে তার কাজের ভার অনেকটাই লাঘব হয়েছে। তিনি এখন প্রয়োজনে নিশ্চিন্তে ছুটিতে যেতে পারেন। কারণ, অফিসার-ইন-চার্জ হিসেবে তখন অন্য একজন দায়িত্বশীল অফিসার থানার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অধিকন্তু, তিনি ইতোপূর্বে থানার তদন্তের মান নিয়ে বড়ই চিন্তিত ছিলেন। তার মতে, পুলিশের শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে তার তদন্ত করার ক্ষমতা ও দক্ষতা। আইন-শৃঙখলা ও জরুরী ডিউটি সম্পাদনের জন্য সরকারের অনেক বাহিনী রয়েছে। কিন্তু, তাদের সাধারণ তদন্তের ক্ষমতা নেই। কিন্তু পুলিশই একমাত্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাদের সরকার ফৌজদারি অপরাধ তদন্তের ভার অর্পণ করেছে। কিন্তু, আইন-শৃঙখলার হল্লা ডিউটিতে বেশি সময় ব্যয় করতে বাধ্য হওয়ার ফলে তারা তদন্তে প্রয়োজনীয় সময় ব্যয় করতে পারছিলেন না। এখন থানা পর্যায়ে তদন্তকার্য পরিচালনা ও তদারকির জন্য একজন বাড়তি ইন্সপেক্টর পদায়নের ফলে তার থানায় তদন্তের মান আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে।

আমি গত বছর ফেব্রুয়ারী মাসে কেন্দুয়া থানায় কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম মনিটর করতে গেলে থানায় কর্মরত জুনিয়র ইন্সপেক্টরকে ( কাকতালীয়ভাবে তারও নাম মোশারফ হোসেন) অফিসার-ইন-চার্জের বাসায় পাই। অফিসার-ইন-চার্জের পরিবার কর্মস্থলে বসবাস করেন না এবং থানায় দ্বিতীয় ইন্সপেক্টরের থাকার জন্য আলাদা বাসা না থাকায় তিনি অফিসার-ইন-চার্জের বাসাতেই বসবাস করছেন। অফিসার-ইন-চাজ মোশারফ হোসেন বলেন, সে আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তার থাকার আলাদা ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সে আমার বাসাতেই থাকবে।

থানাই পুলিশ-সেবার মূখ্য কেন্দ্র। প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার সদস্যের পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের সেবাদানের মান থানার মানদণ্ডে তুলনা করা হয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরাধের ধরণ পরিবর্তন, চিরায়ত কর্মকাণ্ডের বাইরেও পুলিশের কর্মপরিধির বিস্তৃতি ইত্যাদি কারণে থানা-পুলিশের কাজের মাত্রা অসহনীয়ভাবে বেড়ে গেছে। এমতাবস্থায়, থানায় পুলিশের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি সময়ের দাবি। কিন্তু, ইতোপূর্বে পুলিশের শুধু নিম্নপদে লোকবৃদ্ধির প্রবণতা ছিল। বর্তমানে সেই প্রবণতা দূর হয়েছে এবং পুলিশের উপর পদে অধীক সংখ্যক কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক থানায় দুইজন ইন্সপেক্টর পদায়ন তারই ধারাবাহিকতা। এই ব্যবস্থার ফলে থানায় সার্বিক সেবাদান প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে যা ক্রমশ সাধারণ মানুষের কাছেও দৃশ্যমান হবে।

তথ্যসূত্র :
১। http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-02-14/news/224555
২। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং- স্বঃ মঃ (পু-৩)/পদ-১০/২০০৪৯অংশ-১) /৩৭১ তারিখ ১৪/০৬/২০১০ এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টাসের স্মারক নং জিএ/৪-২০০৮(অংশ)/২২২৮ তারিখ ৪/১০/২০১০