বস টু লস ঠু!!!

পাভেল হাসান
Published : 16 July 2017, 08:41 PM
Updated : 16 July 2017, 08:41 PM

বিনোদনের অনেক বড় একটা মাধ্যম হচ্ছে সিনেমা। যান্ত্রিক জীবনে সিনেমা মানুষের বিনোদনের বেশ বড় একটি জায়গা জুড়ে থাকে। যেখানে বিনোদনটাই প্রাধান্য পায় দর্শকশ্রোতাদের কাছে আনন্দের অংশ হিসাবে।

বাংলাদেশে এবারের ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত আকর্ষণ ছিল টালিউড সিনেমার সুপারস্টার নায়ক জিত এর ছবি "বস ২"। অনেক তর্ক বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায় বস-২ সিনেমাটি বাংলাদেশে এবারের ঈদ ২০১৭ তে। "বস-২" সিনেমাটি যৌথ প্রযোজনা নাকি যৌথ প্রতারণা এই তর্কটি এখন অনেক বড় ব্যাপার, তাই এ ব্যাপারে কথা না বলায় ভালো। বিনোদনটাকে মাথায় রেখে সিনেমা হলে থাকা দর্শকশ্রোতা উপভোগ করেছে পুরো সিনেমাটি।

ঢাকার বলাকা সিনেমাতে ঈদের দ্বিতীয় দিনে প্রচুর ভিড় ও লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বগতির দামের বিনিময়ে পেয়ে গেলাম কাঙ্ক্ষিত বস-২ সিনেমার টিকেট। আনন্দ তখন টিকেটরুপে হাতের মুঠোয়!!!!

সিনেমা হলে আসন গ্রহণ করতেই দর্শকদের উচ্ছ্বাস ও আগ্রহ দেখতে পেলাম। হঠাৎ একটি বিষয় খেয়াল করলাম, সেটা হল সিনেমা হলে প্রচুর মহিলা দর্শক। পরে বিষয়টি পরিষ্কার হলো এই ভেবে যে, হয়তো নায়ক জিত জিতে নিয়েছেন সব মেয়ের মন!!!

অতঃপর পর্দা উঠে গেলো, জাতীয় পতাকা প্রদর্শন। সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম জাতীয় পতাকা ও সঙ্গীতের সম্মান প্রদর্শন করতে। সিনেমা শুরু হল।

বস-১ এর সিকুয়েল হিসাবে নির্মিত হয়েছে বস-২ সিনেমাটি। শুরুতেই বস-১ এর কিছু দৃশ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে সিনেমার টাইটেল, যেখানে শিল্পী কলাকুশলীর নাম দেখিয়েছে। ভালো লেগেছে ব্যাপারটা। একটা আগ্রহ ছিল টাইটেলটির মাঝে। এবার সিনেমাটির কাহিনীতে আসা যাক। বস-১ যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই  বস-২ সিনেমাটির কাহিনী শুরু হয়েছে।

আদালতের সামনে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খল জনতার সাথে পুলিশের ধস্তাধস্তির এক দৃশ্য দিয়ে শুরু হয়। যেখানে সিনেমার নায়ক সূর্যের সবাই বিচার চাইছে। সিনেমাতে নায়ক জিত সূর্য নাম ভুমিকায় অভিনয় করেছেন। সূর্য ফাউন্ডেশন এর টাকা আত্মসাৎ করার জন্য মুম্বাই পুলিশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেরে। সিনেমার কাহিনীর প্রেক্ষাপট মুম্বাই থেকে শুরু হয়। তবে কাহিনীর প্রবাহে বাংলাদেশের কিছু প্রেক্ষাপট দেখা গেছে। সিনেমার নায়ক সূর্য চেয়েছিলেন দেশের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষদের জন্য একটি ফাউন্ডেশন তৈরি করতে। পরে ফাউন্ডেশনটি গড়ে তোলার লক্ষ্যে যে টাকা সংগ্রহ করা হয়, সেই টাকা নিয়ে পুরো সিনেমার কাহিনী। সেই কাহিনীর কিছু নাটকীয়তা দিয়ে সিনেমা এগিয়ে যায়।

এবার বিস্তারিত বলা যাক।

সম্প্রতি এক বলিউড সুপারস্টার এর সদ্য মুক্তি পাওয়া একটি সিনেমা শুধুমাত্র ভালো কাহিনী না থাকায় বক্স অফিসে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। এটা হয়তো সবারই জানা। তবে এই ঘটনাটি কিন্তু নতুন নয়। অনেক বিগ বাজেটের সিনেমাও দর্শকদের হলে টানতে পারেনি শুধুমাত্র ভালো কাহিনী না থাকার জন্য।

শক্ত মাটিকে গাছের ভিত হিসাবে যেমন ধরা হয়ে থাকে, তেমনি কাহিনীকে একটি সিনেমার ভিত বলা যেতেই পারে। শুধুমাত্র ভালো কাহিনীর জন্যই সিনেমা দর্শকদের মনে সাড়া ফেলতে পারে একথা সবারই জানা।

বস-১ সিনেমাটি আমি যখন দেখেছি আমি তখনও জানতামনা যে এটি একটি তেলেগু সিনেমার রিমেক ছিলো। পড়ে তেলেগু সিনেমাটি দেখে আমার কাছে জিত এর বস-১ সিনেমাটিই তুলনামুলক ভাবে ভালো লেগেছিলো।

বলাবাহুল্য যে, টালিউডের  বেশির ভাগই সিনেমা এখন তামিল বা তেলেগু অনুকরনে নির্মিত হচ্ছে। তবুও বেশ ভালো ব্যবসাসফল সিনেমা ছিলো বস-১। তাহলে সেই দৃষ্টি কোন থেকে চিন্তা করলে বস-২ তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি দর্শকদের মনে। হল থেকে বেরিয়ে সবাই এমনটাই বলছিলেন।

সিকুয়েল ছবি শুধুমাত্র যে বস-২ ক্ষেত্রেই এমনটা হয়েছে তা কিন্তু নয়। যেমন হলিউড সিনেমার সিকুয়েল হিসাবে যেগুলো নির্মাণ করা হয় সেগুলোর অনেক্ষেত্রেই দেখেছি যে, সিকুয়েল-২ সিনেমাগুলো তার পূর্ববর্তী সিকুয়েল সিনেমাটাকে টপকে যায় জনপ্রিয়তার দিক থেকে। যার কারনেই মনে হয় যে, অনেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান একই সিনেমার সিকুয়েল নির্মানে আগ্রহী হয়ে থাকে।

কিন্তু বাংলা ও হিন্দি ভাষার যে সিকুয়েল সিনেমা গুলো নির্মিত হয় সেগুলোর ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিকুয়েল-২ সিনেমাগুলো সাড়া জাগাতে পারেনা। বস-২ সিনেমাটি বোধয় সেই ধারাবাহিকতায় থেকে গেলো। তবে বস-২ এর পরে যদি এটার আরও কোন সিকুয়েল আসে তবে সেটা নিশ্চয় আরও ভালো হবে, এমনটাই প্রত্যাশা থাকলো নির্মাতার প্রতি।

সিনেমাতে সবসময় গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ খোঁজাটা যেমন বোকামি তেমনি পাওয়ার আশা করাটাও বোকামিই বলা যায়। যেমন বস-২ সিনেমার ট্রেলারটি শুরু হয়েছিল একটি সংলাপ দিয়ে যা, "স্বপ্ন পূরণ করাটা লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য পূরণ করাটা স্বপ্ন হওয়া উচিৎ"। বটেই তো, বেশ ভালো কথা। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এবার স্বপ্ন ও লক্ষ্যের জটিল সমীকরণের সমাধান পাবার জন্য বস-২ না দেখলে হবেই না!!! প্রায় ২ ঘণ্টা ২২ মিনিটের সিনেমা দেখে ফেললাম, কিন্তু সমীকরণের কোন সমাধান নেই!!! পুরো সিনেমা দেখার পরেও বোঝা গেলোনা পরিচালক কোনটিকে স্বপ্ন আর কোনটিকে লক্ষ্য বুঝিয়েছেন!!! এ কেমন বিচার??? প্রশ্নটা থেকেই গেলো।

জিত!!! বস-২ নাম ভুমিকায় উনিই একমাত্র বস। সম্পূর্ণ পেশাদার অভিনয় শিল্পী হিসাবে তার সেরাটায় দেয়ার চেষ্টা করেছেন। পুরো সিনেমাটি উনি একাই টেনে নিয়ে গেছেন শেষ পর্যন্ত। তবে আবেগের দৃশ্য গুলোতে উনি আরও ভালো করতে পারতেন। অ্যাকশন দৃশ্যে জিত বরাবরই বলিষ্ঠ বলে আমার কাছে মনে হয়। তবে নাচের প্রতি জিত বোধয় বস-২ তে বেশ অমনোযোগী ছিলো বলা যেতে পারে।

এবার বলবো সিনেমাটির অন্যান্য চরিত্রে থাকা অভিনয়শিল্পীর কথা। বস-২ ছবিতে ৩/৪ জন বাংলাদেশি শিল্পীর উপস্থিতি ছিলো আমার দেখা মতে। বাকিটা ওপার বাংলার শিল্পী ও কলাকুশলী।

সিনেমার নায়িকা হিসাবে শুভশ্রীকে মডেল হিসাবে দেখানো হয়েছে যেমনটা ছিল বস-১ এ। উল্লেখযোগ্য তেমন অভিনয় না থাকলেও সিনেমাটির একমাত্র রোম্যান্টিক গান এ বেশ মানিয়ে নিয়েছেন। সিনেমার আরও একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করেছেন নুসরাত ফারিয়া। অভিনয় ও নাচে অনেক মনযোগী হতে হবে এবং সেইসাথে সমানভাবে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। অভিনয়ে নিয়মিত হতে চাইলে এর কোন বিকল্প নেই নুসরাত ফারিয়ার জন্য।

প্রিন্স শাহনেওয়াস হোসেন নামক খল চরিত্রে এর অমিত হাসান বেশ ভালো করেছেন তার চরিত্রে। সিনেমাটিতে বাকি সব খল চরিত্রের চেয়ে তাকে অনেক মানানসই বলে মনে হয়েছে। সিনেমাটির সাস্পেন্স খল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইন্দ্রনিল সেনগুপ্ত। কিন্তু খল চরিত্রে তার অভিনয় বেশ হতাশ করেছে দর্শকশ্রোতাদের বলতে হবে। সিনেমা শেষে অনেক দর্শকশ্রোতাই এমনটা বলছিলেন।

আরও একটি বিশেষ খল চরিত্রে ওপার বাংলার গুণী অভিনেতা ও মঞ্চশিল্পী কৌশিক সেন বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। খল চরিত্রে অভিনয় করলেও তার অভিনয়ে দর্শক কিছুটা হেসেছিলো বলে মনে আছে আমার। ছবিতে আরও একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুপ্রিয় দত্ত। যাকে মন্ত্রি হিসাবে দেখা গেছে। অভিনয়ের ব্যাপ্তিকাল কম হলেও বেশ ভালো ছিলেন তার চরিত্রে। পুলিশ কমিশনার এর চরিত্রে দেখা যায় জনপ্রিয় অভিনেতা  চিরঞ্জিতকে সাবলীল অভিনয়ে।

এবার ছবির অন্যান্য দিক নিয়ে কথা বলা যেতে পারে।

ছবির চিত্রনাট্য ভালো ছিল। সিনেমাটিতে ৩ টি গান রয়েছে। বাণিজ্যিক সিনেমা হিসাবে গানগুলো ভালো হয়েছে, বিশেষ করে জিত শুভশ্রীর রোম্যান্টিক গানটি। বস শিরোনামে আরও একটি গান ছিল জিতের। "ইয়ারা মেহেরবান" গানটি বোধয় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো, এমনটাই বোঝা গেছে গানটি চলাকালীন সময়ে।

আলোকসজ্জা ও রূপসজ্জা ছিল বেশ ভালো। বেশ লোক সমাগমে আউটডোরের শুটিং কিছু ছিলো। সিনেমাটিতে  বস শিরোনামে গানের মিউজিকটি বিভিন্ন আবহ দৃশ্যের জন্য চমৎকার ছিল।

ছবির সংলাপ গুলো বস-১ এর মতো তেমন ছিলোনা। তবে "আমি একবারই বলি আর একশো বার বলি মানেটা একই" জিতের এই সংলাপটি চরিত্রের সাথে মানিয়েছে বলতে হবে। সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্য গুলো বেশ ভালো ছিল।

সিনেমা হলে থাকা প্রতি দর্শক সিনেমা শেষে শুধু কাহিনীর জন্যই বেশ আফসোস করে বের হয়েছেন বলে আমি যা দেখেছি।

সব শেষে কিছু কথা। আমরা সবাই জানি, ভালো ও পরিচ্ছন্ন ছবি দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে ফিরিয়ে আনে। আর সেই দর্শক তার উপার্জিত কষ্টের টাকা দিয়ে একটি ভালো গল্প বা কাহিনীর সিনেমাটাই দেখতে চাইবে সব সময়। এটাই স্বাভাবিক বিষয়। বেশি বাজেটের সিনেমা মানেই যে বেশি ভালো সিনেমা ঠিক তেমনটা মনে করেননা বেশিরভাগই দর্শকশ্রোতারা।

ইরান ও কোরিয়ান সিনেমার উধাহরন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। যে সিনেমাগুলো বেশিরভাগই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ভালো গল্প ও কাহিনীর জন্য। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে সংশ্লিষ্ট ওই সিনেমার বাজেটগুলো তেমন বেশি ছিলোনা বললেই চলে। সর্বশেষ আয়নাবাজি সিনেমাটির কথাও বলা যেতে পারে। যে সিনেমাটি গল্প ও কাহিনীর একটু ভিন্ন উপস্থাপনায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সবসময় বেশি বাজেটের দিকে না তাকিয়ে ভালো গল্প ও কাহিনীর দিকে মনোযোগ দেয়াটা এখন সবচেয়ে জরুরী।

তাই ভালো গল্প ও কাহিনীনির্ভর সিনেমা নির্মাণে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।