ঢালিউডে সিনেমা কেন ‘ছিনেমা’

পাভেল হাসান
Published : 29 Sept 2017, 03:40 PM
Updated : 29 Sept 2017, 03:40 PM

সব লেখাতেই কিছু ভুমিকা লিখতে হয়, কিন্তু আজকে আমি কোনো ভুমিকা না টেনে মুল কথা দিয়েই শুরু করছি। আমার এই লেখার শিরোনাম দেখে অনেকেই হয়তো এতক্ষণে হেসে ফেটে পড়ছেন। ঢালিউড শব্দটিই হচ্ছে হাসির সেই কারন। বাংলাদেশে যারা সিনেমা দেখে থাকেন তারা হয়তো এতক্ষনে বুঝে গেছেন যে, আমার  আজকের লেখাটি ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রি তথা আমাদের দেশের ঢাকাই সিনেমা নিয়ে। আমি খুব অকপটে স্বীকার করছি যে, আমার এই লেখাটির শিরোনামের জন্য আজকের বাংলাদেশের সিনেমা ও তাদের বর্তমান অবস্থাই দায়বদ্ধ বলে মনে করছি।

১৯৫৬ সালে আব্দুল জব্বার খান এর পূর্ণ দৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমা 'মুখ ও মুখোশ" দিয়ে ঢাকাই সিনেমার যাত্রা শুরু এবং তার পরের ইতিহাসটা আমাদের সবারই জানা।

অনেক ক্রান্তিকাল সময় দিয়ে বাংলা সিনেমার ইতিহাস শুরু হয়েছিলো, আবার বর্তমানে সেই একি ক্রান্তিকাল দিয়ে বাংলা সিনেমা সময় অতিবাহিত করছে। শুধু মাঝের সময়টুকুই ছিলো বাংলা সিনেমার সোনালী দিন। যা আমরা একেবারেই অস্বীকার করতে পারিনা। কারন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কোলকাতাতেও বাংলা ভাষার সিনেমা নির্মাণ হয়ে থাকে। বর্তমানে কোলকাতার বাংলা সিনেমা অনেকটাই এগিয়ে গেছে। যেটা আমাদের বাংলাদেশি সিনেমার ক্ষেত্রে হতে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশি দর্শকের সে আশায় অনেকটা গুঁড়েবালি। বাংলাদেশি সিনেমার ইতিহাস নিয়ে আর বেশি কিছু লিখলামনা। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ইতিহাস নির্ভর তথ্য গুলো এখন ইন্টারনেটেই দেখা মেলে। তাছাড়া ইতিহাস নিয়ে খুব বেশি কিছু বলারও নাই। আমারা সবাই বেশিরভাগ সময়ই ইতিহাস নিয়ে ব্যাস্ত থাকি। আমরা বাংলাদেশিরা সবাই ইতিহাস নিয়ে খুবই আবেগপ্রবন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার ঘটনা খুব কম আমাদের মধ্যে।  বাংলাদেশি সিনেমার ক্ষেত্রেও তার বাতিক্রমটি ঘটেনি। ইতিহাসের অনেক যুগান্তকারী ছাপ আছে ঢাকাই তথা ঢালিউডের সিনেমায়, কিন্তু সেই হারে বর্তমানে তেমন এগোতে পারেনি।

আমাদের দেশে সাদাকালো, আংশিক রঙিন, রঙিন ও বর্তমানে ডিজিটাল সিনেমা নির্মাণ হয়ে আসছে। সাদাকালো সিনেমাগুলোর সময়টা বাংলদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্য সোনালী যুগ হিসাবে ধরা হয়ে থাকে। ৮০ এর দশক থেকে নিয়মিতভাবে ঢালিউডে আংশিক ও রঙিন সিনেমার অধ্যায় শুরু হয় যা আজ পর্যন্ত চলমান আছে। বদলেছে কিছু সিনেমার ধরন ও নির্মাণ কৌশল। কেবল বদলায়নি ঢাকাই সিনেমার প্রেক্ষাপট।

বিশ্বের সব দেশের সিনেমা যখন প্রযুক্তির হাত ধরে নতুন দ্বারপ্রান্তে, তখন আমাদের বাংলাদেশের সিনেমা অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধে। ধুকে ধুকে চলছে সিনেমা শিল্প। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ছোঁয়াতে বাংলাদেশের সব কিছুর উন্নতি হলেও কেবল উন্নত হলোনা আমাদের দেশের সিনেমা তথা সিনেমা শিল্প। বাংলাদেশি সিনেমাতে তেমন ব্যায়বহুল প্রযুক্তির ব্যবহার না হলেও কিছুটা (বাজেট অনুযায়ী) ব্যবহার আছে। কারিগরি দিক থেকেও অনেক এগিয়ে আছে। ঝক ঝকে পরিষ্কার ছবি, শব্দের মিশ্রণ যথেষ্ট লক্ষণীয়। কিন্তু তারপরেও কেন বাংলাদেশের সিনেমা অস্তিত্বের লড়াইয়ে??? কেনো বাংলাদেশি সিনেমা নিয়ে মানুষের হতাশা? কেনো বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে মানুষের এতো সমালোচনা??? কেন ঐতিহ্যবাহী সিনেমা এখন ছি!নেমা???

নিজের দেশকে ভালোবাসি, বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি, আর ভালোবেসেই বাংলা সিনেমা দেখি। সবার আগে আমার কাছে নিজের দেশের সিনেমার প্রাধান্য, তারপরে বাকিসব। আমাদের দেশের সিনেমা আমরা না দেখেল কে দেখবে??? একটি কথা না বললেই নয় সেটা হচ্ছে আমি বাংলা সিনেমা দেখেছি এবং দেখি যার কারনেই আজকে আমি এই লেখাটি লিখতে পারছি। যদি বাংলা সিনেমা না দেখতাম তাহলে এই লেখাটি লেখা আমার পক্ষে লেখা সম্ভব ছিলোনা। ছোটবেলা থেকে আমার আম্মুর কাছে শুনে আসছি "ভালোবাসে যে, শাসন/অভিমান করার অধিকারও রাখে সে"। আমার আম্মুর এই কথার সাথে মিল রেখে বলছি, একজন দর্শক হিসাবে বাংলা সিনেমাকে ভালবাসি তাই আমি হয়তো সেকারণেই অভিমানের কথাগুলো বাংলা সিনেমাকে নিয়েই বলছি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাইকে। আমার এই লেখায় কোন ধরনের কঠিন তাত্ত্বিক কথা ব্যবহার করিনি, খুব সহজেই আমার নিজের কথা গুলো বলার চেষ্টা করেছি।

শুধু মাত্র বাংলা সিনেমা দেখি বলে অনেকেই আমাকে অনেকভাবেই লজ্জা দিতেন বা এখনও দিয়ে থাকেন। আমার এক বড় ভাই আমাকে বলেছিলেন যে, "বাংলা সিনেমা ভদ্র লোকে দেখে? তুই অভদ্র দেখেই বাংলা সিনেমা দেখিস বুঝলি???" লজ্জায় আমি সেদিন কোন উত্তর দিতে পারিনি এবং এই লজ্জা আমাদের বাংলাদেশের সিনেমা পরিবারের সবার জন্য। মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন ঘুরপার করছিলো, বাংলাদেশে বিনোদনের এতো বড় একটা মাধ্যম বাংলা সিনেমা দেখা কেন অভদ্রতার কারন হবে??? বাংলা মঞ্চ নাটক, টিভি নাটক, সিরিয়াল, গান শুনলে অভদ্রতার প্রশ্ন উঠে না, কেবল বাংলা সিনেমার জন্য এই প্রশ্নটা কেন উঠে???

একজন বাংলা সিনেমার দর্শক হিসাবে আমার এই লেখাটিতে আজ তেমনই কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।

একটি সিনেমা নির্মাণ হয় দুটি অংশের প্রচেষ্টায়। একটি পর্দার সামনের অংশ ও অন্যটি পর্দার পেছনের অংশ। পর্দার সামনের অংশে বেশিরভাগই অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের দেখা যায় আর পর্দার পেছনে পরিচালক (অভিনয়, নৃত্য, একশন, গান), কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহকসহ  থাকে আরও অনেক কলাকুশলী। এই দুটি অংশেই থাকে কিছু মানুষের পরিশ্রম যা দিয়েই সিনেমা যেমন হিট হয় আবার ফ্লপও হয়। পরিচালনার মান, অভিনয়, কাহিনী, সংলাপ, নাচ, গান, একশন দৃশ্য একটি সিনেমার অনেক গুরুতপূর্ণ উপাদান। সিনেমার এই উপাদানগুলোই কিন্তু মান বিচারের মানদণ্ড হিসাবে ধরা হয়ে থাকে। এই মানদণ্ড কে ঘিরেই একটি সিনেমা, ছি!নেমায় রুপ নিয়ে থাকে।

প্রথমেই বাংলাদেশের সিনেমা পরিচালক ও তাদের পরিচালনার দক্ষতা নিয়ে মুল কথাগুলো শুরু করা হলো। বাংলাদেশের সিনেমাগুলো আজ যে ক্রান্তিকাল পার করছে, তার জন্য আমাদের দেশের সিনেমা পরিচালকরা বোধয় অনেকাংশেই দায়বদ্ধ। একটু পেছনে ফেরা যাক। আমাদের বাংলাদেশে অনেক খ্যাতিমান পরিচালক ছিলেন, ছিলেন বলছি এই অর্থে যে তাদের নির্মিত কোন সিনেমা বর্তমানে দেখা যায়না। পরিচালক সব সময়ের জন্য পর্দার পেছনের মানুষ। পর্দার পেছনে থাকায় অনেককেই চেনা সম্ভব নয়। তবে একজন পরিচালকই পারে তার দক্ষ সিনেমা পরিচালনা দিয়ে দর্শকের সামনে আসতে। বাংলদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে একটা সময় ছিল, যখন সিনেমা পরিচালকের নাম দিয়ে সিনেমা চলতো। দর্শক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতো কখন তার প্রিয় পরিচালকের সিনেমা আসবে?

উধাহরনস্বরূপ কিছু সিনেমার কথা বলছি। প্রয়াত শহিদুল ইসলাম খোকন এবং কাজী হায়াতকে চেনেননা  এমন সিনেমা দর্শক বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই দুই পরিচালকের কয়েকটি সিনেমার কথা না বললেই নয় যে সিনেমাগুলি বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমাকে সাফল্যের এক অন্যধারায় নিয়ে যায়।

আমার মনে পড়ছে এই মুহূর্তে "ঘাতক" সিনেমা সম্পর্কে। এই সিনেমাটি রাজনৈতিক কিছু জটিলতা পেরিয়ে মুক্তি পেয়েছিল। যার কারনে বাংলাদেশের অনেক সিনেমা হলে সিনেমাটি প্রদর্শনকালে আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে হয়েছিলো আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে। যা এখন অনেক হিন্দি সিনেমার ক্ষেত্রেই ঘটতে দেখা যায়। সিনেমার নাম ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত জনপ্রিয় অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদি এবং তার সিনেমায় করা চরিত্র নিয়ে বেশ আলোচিতও হয়েছিলো।

তারই নির্মিত অন্য একটি সিনেমা "বিশ্ব প্রেমিক"। এই সিনেমাতেই হুমায়ুন ফরিদী ভিলেন চরিত্র থেকে আসেন এনটি হিরো চরিত্রে চিত্রনায়িকা মৌসুমির বিপরীতে। তাদের দুজনেরই অংশগ্রহনে "তোমরা কাউকে বলোনা" শিরোনামের একটি গান সেই সময়ে ব্যাপক প্রশংসা পায় দর্শকশ্রেণীর কাছে। শুধু মাত্র এই গানটি এক নজর দেখার জন্য প্রতিটা সিনেমা হলে বেড়ে গিয়েছিলো প্রচণ্ড ভিড়।

সিনেমার মুল ধারাকে ঠিক রেখে মেয়েদের অধিকার ও বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয়বস্তু নিয়ে নির্মিত হয় "পালাবি কোথায়"। সিনেমাটিতে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন চিত্রনায়িকা শাবান, চম্পা, সুবর্ণা মুস্তাফা এবং অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদি। পরিচালকের এই সিনেমাও দর্শকের মন জয় করে নেয় এবং আসে অভাবনীয় সাফল্য।

সামাজিক অসঙ্গতি ও তার প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিনেমা গুলি বেশিরভাগই জনপ্রিয় চিত্রপরিচালক কাজী হায়াতের ঝুলিতে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন  প্রেক্ষাপটে "সিপাহী" সিনেমাটি নির্মিত হয় কাজী হায়াতের পরিচালনায়। এই সিনেমাটি যতবারই দেখি ততবারই মুগ্ধ হয়ে যাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় আহত আপন ভাইকে নিজ হাতে গুলি করে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়ার মত করুন দৃশ্যও এই সিনেমায় দেখানো হয়, যা দর্শকের মনে আজও দাগ কাটে। এই সিনেমার শেষ দৃশ্যের অভিনয়ে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন কে যারা দেখেছেন তাঁরা কখনই ভুলতে পারবেননা উনার অভিনয় দক্ষতাকে।

চিত্রনায়ক মান্নার ক্যারিয়ারের সেরা সিনেমাগুলোর মধ্যে ছিল কাজী হায়াতের "দেশদ্রোহী"। তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয় ঘিরে নির্মিত হয় এই সিনেমাটি। এই সিনেমার একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করেন খ্যাতিমান অভিনেত্রী ডলি জহুর। এই দুই শিল্পীর অভিনয়ে তখনকার দর্শক মুগ্ধভরে ডুবে গিয়েছিলেন দেশদ্রোহী সিনেমাতে। আমার মনে আছে টিকেট সংকটের কারনে মুক্তির ৩ সপ্তাহের মাথায় আমি সিনেমাটি দেখি কারন এতটাই দর্শকের ভিড় ছিলো হলগুলোতে।

বাংলা সিনেমার একজন ত্যাগী সিনেমা পরিচালকের জীবন নিয়ে নির্মিত হয় কাজী হায়াতের আরও একটি দর্শকনন্দিত সিনেমা "দেশপ্রেমিক"। যে সিনেমাতে উঠে আসে সেন্সর বোর্ড ও বাংলা সিনেমা নিয়ে লড়াই করা এক চিত্রপরিচালকের জীবন। এই চিত্রপরিচালকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক আলমগির। তৎকালীন সময়ে ঐরকম ব্যাতিক্রম বিষয় নিয়ে সিনেমা নির্মাণের সাহসিকতা দেখিয়েছেন কাজী হায়াত।

সত্যিই ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। এই পরিচালকরা তো আমাদের দেশেরই এবং তারাতো দেশীয় বাংলা সিনেমা দিয়েই দর্শকের মন জয় করেছেন। এই যে সিনেমার কথাগুলো বললাম, এই সিনেমা গুলো তো ৭০ বা ৮০ এর দশকেরও নয়। এই গুলো ৯০ দশকের সিনেমা যা ২০ থেকে ২৫ বছর আগের। ঐ সময়ে যদি এতগুলো ভালো সিনেমা নির্মাণ হয়ে থাকে তাহলে এখন কেনো হবেনা? এখনতো আরও উন্নত সময় চলচ্চিত্রের জন্য। 

কিন্তু আফসোসের বিষয় এখন আমাদের দেশে একেবারেই ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে ১০ টি মানুষ পাওয়া যাবেনা যারা বর্তমানে কয়েকজন সিনেমা পরিচালকের নাম বলতে পারবেন। এর জন্যও কিন্তু বর্তমানে সিনেমা পরিচালকরা কোন ভাবেই দায় এড়াতে পারেননা। বর্তমানে সিনেমা পরিচালনার মান এতটায় নিচে নেমে গেছে যার কারনে কোন পরিচালকের কাজ দর্শক মনে রাখতে পারছেননা।

তবে খুবই অল্পসংখ্যক হাতে গোনা কিছু পরিচালকের ভালো কাজ তথা সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে এই সকল পরিচালকের সিনেমা গুলো মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। একেবারেই সর্বস্তরের দর্শকের কাছে খুব বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছেনা। বৈষম্য শব্দটি বাংলাদেশের সিনেমা নির্মাণেও প্রবেশ করেছে। কারন এখন সব সিনেমায় কিন্তু দর্শকের শ্রেণীবিভাগ চিন্তা করে নির্মাণ করা হচ্ছে। মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হলের জন্য এক ধরনের সিনেমা আবার সাধারণ সিনেমা হলের জন্য অন্য রকমের সিনেমা। বিনোদনের এই বৈষম্য মানা একজন দর্শকের মানা খুব কঠিন।

৬০ থেকে ৯০ দশকের মধ্যে যে সিনেমাগুলো নির্মাণ হয়েছে তা কিন্তু বেশির ভাগই সকল শ্রেণীর দর্শকের জন্য। এবং এই সময়ে নির্মিত সিনেমাগুলো শ্রেণীবর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে সমাদৃত হয়েছে। সুভাষ দত্ত, মিতা, এহতেশাম, খান আতা, জহির রায়হান, আলমগির কবির, আব্দুল্লাহ আল মামুন, সত্য সাহা, আজিজুর রাহমান, তোজাম্মেল হক বকুল, দিলিপ বিশ্বাস, গাজি মাযহারুল আনোয়ার, দেলোয়ার জাহান ঝনটু, কাজী হায়াত, শহিদুল ইসলাম খোকন, মাসুদ পারভেজ, এ জে মিন্টু, সোহানুর রহমান, রাজ রাজ্জাক, শিবলি সাদিক, মোহম্মদ হান্নান, মতিন রহমান, চাষি নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন আহমেদ সহ আরও অনেকেই আছেন যারা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তাদেরই নির্মিত মুলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার জন্য।

গ্রাম বাংলা থেকে শহরের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে পেয়েছেন মানুষের ভালবাসা। আমাদের দেশে আরও অনেক গুণী নির্মাতা আছেন যাদের নাম এই মুহূর্তে আমি উল্লেখ করতে না পারায় দুঃখিত। উনারা সবাই বাংলাদেশের মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন। অনেক প্রতিকুলতার মাঝেও সিনেমা নির্মাণ করে বাংলাদেশের মানুষের বিনোদন যুগিয়েছেন। কিন্তু আফসোসের সাথে বলছি যে বর্তমানে আমাদের দেশে অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তেমন কোন গুনি নির্মাতা বের হয়ে আসতে পারছেননা

আমাদের দেশের বর্তমানের অনেক পরিচালকই বলে থাকেন যে, বাজেট স্বল্পতার জন্য উনারা ভালো সিনেমা নির্মাণ করতে পারেননা। তাদের এই কথা আমি সম্পূর্ণরূপে মেনে নিতে পারিনা। কারন কিছু ক্ষেত্রে কাহিনীর প্রয়োজনে হয়তো বেশি বাজেট লাগতে পারে তাই বলে সব সিনেমায় বেশি বাজেট লাগবে বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। কারন আগেকার সিনেমার বাজেটগুলো বর্তমান সিনেমার থেকে অনেক কম ছিল। তারপরেও দর্শকের মন জিতে নিয়েছে।

কোলকাতার জনপ্রিয় সিনেমা "ছোট বউ" এর একজন গুণী নির্মাতার নাম আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। উনি হলেন অঞ্জন চৌধুরী। এই ছোট বউ সিনেমার জনপ্রিয়তার কারনে বাংলাদেশেও এই সিনেমাটির রিমেক হয়েছিলো। এই গুণী নির্মাতার অনেক জনপ্রিয়তাও আছে আমাদের দেশের দর্শকশ্রেণীর কাছে। উনার কথা বলার কারন হচ্ছে, উনার সিনেমার বাজেট। উনার সিনেমাই বোধয় কোলকাতার সবচেয়ে কম বাজেটে নির্মিত হতো। তার এমনও সিনেমা দেখেছি, যে সিনেমায় আউটডোরের শুধু গানের দৃশ্য ছাড়া পুরোটাই ইনডোরে নির্মাণ করা হয়েছে। আপনারা চাইলে ইউটিউব এ দেখতে পারেন। উনার সিনেমার মুল বিষয় ছিলো ভালো কাহিনী, সংলাপ আর মান সম্পন্ন অভিনয়। বিশ্বাস করুন আমাকে এ ছাড়া আর কোন কিছু পাবেননা উনার সিনেমাতে।

বাংলাদেশের সর্বশেষ ব্লকবাস্টার হিট সিনেমা আয়নাবাজির বাজেট কিন্তু বেশি ছিলোনা, তবে ছিল শুধু একটা কাহিনী, কিছু সংলাপ, আর কিছু ভালো অভিনয়। শুধু বাজেট সিনেমার মান পরিবর্তন করে দেয় এটা একেবারেই অযৌক্তিক বলে অনেক দর্শকই মনে করে থাকেন।

এবার সিনেমার অন্যতম উপাদান অভিনয়ের কথা বলবো। আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে কিছু ঘটনা। সিনেমায় যখন অনেক করুন দৃশ্য হতো, হলের অনেকেই কেঁদে দিতো। আমার এখনও মনে আছে, আমাদের দেশের খ্যাতিমান প্রয়াত অভিনেতা সালমান শাহ অভিনীত "এই ঘর এই সংসার" সিনেমাতে বড় বোনের মৃত্যুর দৃশ্যে উনার কাঁদার অভিনয় দেখে আমার মাও কেঁদে দিয়েছিলো।

এবার আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। আমার এই কথা হয়তো কারও হাসির খোরাক হতে পারে!!! জনপ্রিয় প্রয়াত চিত্রনায়ক জসিম আমার অনেক পছন্দের অভিনেতা ছিলেন। শুধু আমার নয়, আমার ধারনা অনেকেরই কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। জসিম  বাংলাদেশের এমনই  একজন চিত্রনায়ক ছিলেন যার জীবনের বেশিরভাগই ছবি হিটের তালিকায় ছিলো । উনার সিনেমা চলাকালিন সময়ে দর্শকের উচ্ছ্বাস ও হলে ভিড় আমি নিজেই দেখেছি। তো তারই অভিনীত "ঘাত প্রতিঘাত" সিনেমায় মেয়ের অসুখের জন্য টাকা চেয়ে ভিলেনের পা ধরার কান্নার দৃশ্যে হল ভর্তি দর্শকের সাথে আমি নিজেও আবেগপ্রবণ হয়েছিলাম। একটু ভেবে দেখুন তো কেন দর্শক এতোটা আবেগ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করবে পর্দায় দেখা অভিনেতার অভিনয় দেখে?

প্রশ্নের উত্তরটা হচ্ছে প্রাণবন্ত অভিনয়। চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়া। ছিলো অভিনয়ের চেষ্টা। যা আগের দিনের শিল্পীদের মধ্যে ছিলো। এই কারনেই আমরা একজন হুমায়ুন ফরিদি কে পেয়েছিলাম।

বর্তমানে যে সিনেমাগুলো নির্মাণ করা হয়ে থাকে সেগুলোতে শুধু মুল চরিত্রে থাকা অভিনেতা/অভিনেত্রী ছাড়া তেমন কারোও ভালো অভিনয়ের চেষ্টা দেখা যায়না। শুনেছিলাম মুল চরিত্রের জন্য সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক দেয়া হয় আর অনান্য চরিত্রগুলোর জন্য তুলনামুলক কম পারিশ্রমিক দেয়া হয়। তাই হয়তো যার পারিশ্রমিক যতটুকু ঠিক ততোটুকুই তাঁরা (অভিনেতা/ অভিনেত্রী)অভিনয়ের চেষ্টা করে থাকেন বাংলাদেশের বর্তমানের সিনেমাগুলোতে। আমি বছর খানেক আগে একটি সিনেমা দেখেছিলাম। যেখানে সিনেমার একটি দৃশ্যে প্রিয়জনের বিয়োগান্তে নায়কের কান্নার দৃশ্যে হলভর্তি দর্শক হাসছিলো। আর কমেডি অংশের কথা না হয় বাদই দিলাম। এখন বলুন তো সিনেমা থেকে ছি!নেমা হবার জন্য কি এই  "অভিনয়" নামক কারনটিই যথেষ্ট নয়???

বাংলাদেশে একটি সময় ছিলো যখন কোন মিউজিক ভিডিও বা গানের একক অ্যালবাম বের হতোনা। আর হোলেও সংখায় অনেক কম ছিলো। মানুষের গানের এই অভাব মিটে যেতো শুধু বাংলা সিনেমার গান শুনে। তখন বাংলা সিনেমার গান দর্শক-শ্রোতার মুখে মুখে থাকতো। অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ছিলো আমাদের দেশীয় সিনেমার গান। এখন যেমনটা বলিউড ও টালিউড (কোলকাতার সিনেমা) সিনেমার গানের ক্ষেত্রে দেখা যায়। কিন্তু আফসোস হলেও সত্যি এই যে ৯০ দশকের মধ্যে মুলধারার বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমায় কিছু ভালো গান হলেও ২০০০ সালের পরের সময়তে নির্মিত সিনেমায় তেমন উল্লেখযোগ্য গান দেখা যায়নি। এই সময়টা বাংলাদেশের সিনেমার এক কালো অধ্যায়। নকল সুর ও কথার গান বাংলা সিনেমার গানকে ধ্বংস করার জন্য অনেকটা ভুমিকা পালন করেছে।

এবার গানের চিত্রায়ন নিয়ে কিছু কথা। ঢাকাই সিনেমার সবচেয়ে অবহেলিত দিক গানের চিত্রায়ন। গানের চিত্রায়নের দিক থেকে বলিউডের সিনেমা অনেক এগিয়ে। একারনেই বোধয় বাংলাদেশের কোরিওগ্রাফারগন হিন্দি সিনেমার গানগুলোর মতো করে আমাদের দেশীয় সিনেমায় হুবহু চিত্রায়ন করে থাকেন। কথা,গান,সুর, এমনকি গানের দৃশ্যায়ন গুলো পর্যন্ত নকল করে থাকেন। কিন্তু নকলের হাত ভালো না হবার কারনে এই গান গুলো দর্শকের ছি!ছি! মন্তব্য ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারেনা। গানের অশ্লীলতার কথা নাই বা বললাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনে এক ছোট ভাই বলেছিল যে নকল করার জন্য আলাদা মেধা ও মেধাবিসত্ত্ব লাগে, এটা যার তার দ্বারা হয় না।

যথার্থই বলেছিল আমার সেই ছোট ভাইটি। তার কথার উপর ভিত্তি করে বলতে ইচ্ছে করছে যে, আমাদের সিনেমার কোরিওগ্রাফারগন নকল করার মেধাসত্ত্ব থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। তবে নকল করা মৌলিক কাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বেশিরভাগই সিনেমার গানগুলোর চিত্রায়ন দেখলে মনেই হয়, কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই তাড়াহুড়ো করে নির্মাণ করা হয়েছে। ইউটিউব এ এখন বিভিন্ন দেশের সিনেমার বিহাইন্ড দা সিন, সং ও প্রোডাকশন, মজার দৃশ্যসহ এর ভিডিও দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে পূর্ণ নির্মাণের সময়কার কাজ, পূর্বপ্রস্তুতি ও বিভিন্ন কর্মশালার ঘটনাগুলো দেখে থাকি। কিন্তু বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমার এমন কিছু পূর্বপ্রস্তুতি ও কর্মশালা বিষয়ক কোন ভিডিও দেখা যায়না। তবে এবারের ঈদের কিছু যৌথ প্রযোজিত সিনেমার এমন কিছু ভিডিও দেখা গেছে। সিনেমা নির্মাণের জন্য পূর্ব প্রস্তুতি ও কর্মশালা খুবই দরকার বাংলাদেশের প্রতিটি সিনেমার জন্য, তা না হলে বাংলা সিনেমার জনপ্রিয়তা ধরে রাখা খুব কষ্ট হয়ে যাবে। তবে আমাদের দেশের শিল্পীদেরও কিছুটা দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাঁরা তো জানেন যে কোন গানটি নকল, সেগুলো যদি জেনেও তাঁরা কেনো করেন এটা দর্শকের বোধগম্য নয়।

বাংলাদেশের একটি বাজে সত্য দেশীয় সিনেমায় অশ্লীলতা। সিনেমার পোস্টার থেকে শুরু করে সিনেমার সব জায়গায় এটি পাবেন। মূলত এই কারনেই বাংলা সিনেমা ছি! ছি! পর্যায়ে চলে গেছে এবং  বাংলা সিনেমা নিয়ে ছি! টা কিন্তু এখান থেকেই শুরু হয়। একটু ভাবুন তো আপনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিনেমা দেখেছেন, হঠাৎ করে একটি গানের দৃশ্যে বা সিনেমার দৃশ্যে একটি নোংরা বা নগ্ন দৃশ্য চলে এলো। ভাবুন তো বিষয়টা কেমন লাগবে??? আমি জানি খুবই অস্বস্তিকর লাগবে। বাংলাদেশের জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে যে সব সিনেমা হল রয়েছে তার বেশিরভাগ হলেই বাংলা সিনেমায় এই সব নগ্ন দৃশ্য দেখা যায়। যেগুলো কে আমরা কাটপিস নামে জানি। এই কাটপিস গুলো অনেক সময় ভালো তারকার সিনেমাতেও জুরে দেয়া হয় বেশি টাকার লোভে এবং এই সিনেমা গুলো উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে বেশি দেখা যায়।

বাংলাদেশের সিনেমা খুব কম পরিমানে মৌলিক কাহিনীর হয়ে থাকে। বেশিরভাগ বাংলাদেশি সিনেমা হিন্দি, তামিল, তেলেগু সিনেমার অনুকরনে নির্মাণ করা হয়ে থাকে। কোন জনপ্রিয় সিনেমার কাহিনী অবলম্বনে সিনেমা নির্মাণ করা যেতেই পারে, তাতে সমস্যার কোন কারন নেই। তবে সেক্ষেত্রে সিনেমার মানের দিকটা আগে খেয়াল রাখতে হবে। শুধুমাত্র ভারতেই তাদের নিজের অঙ্গপ্রদেশের সিনেমাগুলোর বিভিন্ন ভাষায় রিমেক করে পেয়েছে দর্শক জনপ্রিয়তা। তবে এই রিমেক সিনেমার কাহিনী গুলো সিনেমা নির্মাণের আগেই ঘোষণা দেয়া হয়ে থাকে যে এটি অমুক সিনেমার রিমেক বা ছায়া অবলম্বনে নির্মিত। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের পরিচালক ও কাহিনীকারদের মধ্যে এইটুকুও আন্তরিকতা দেখা যায়না তার দর্শক শ্রেণীর জন্য।

বাংলাদেশের পরিচালক থেকে শুরু করে অভিনয় শিল্পীরা পর্যন্ত সিনেমা মুক্তির আগে দর্শককে বলবে, "এই সিনেমাটি একটু অন্য ধরনের, সম্পূর্ণ মৌলিক কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে"। আপনি একজন দর্শক হিসাবে তাদের কথা বিশ্বাস করে সিনেমা হলে গেলেন সিনেমাটি দেখতে, পরে পুরো সিনেমা দেখার পর আপনি বুঝতে পারলেন এটি অমুক সিনেমার কাহিনীর নকল করে নির্মিত হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে আপনি বোকা সেজে গেছেন এবং আপনার কষ্টের টাকা তখন পানিতে। এই সময় দর্শকের বাংলা সিনেমা নিয়ে ছি!!! মন্তব্য করা কি খুব অযৌক্তিক??? এই প্রশ্নটি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের কাছে থেকেই গেল।

বাংলাদেশের সিনেমার একশন দৃশ্য ছিল সবচেয়ে এগিয়ে। সিনেমাগুলোর একশন দৃশ্যে অত্যন্ত মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন এদেশের একশন দৃশ্যের পরিচালকরাসহ অনেকেই। একশন নির্ভর সিনেমার জন্য চিত্রনায়ক রুবেল, সোহেল রানা, জসিম, ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন অন্যতম। আরও একজন গুনি পরিচালকের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় চিত্রপরিচালক প্রয়াত শহিদুল ইসলাম খোকন। এই গুণী পরিচালকের কিছু একশন নির্ভর সিনেমা তৎকালীন অনেক ভারতীয় একশন সিনেমার থেকে এগিয়ে ছিলো । চিত্রনায়ক জসিমের জাম্বস এবং রুবেলের একশন ওয়ারিওরস ফাইটিং গ্রুপের কাজও ছিল বেশ প্রশংসনীয়। চমৎকার স্টান ও একশনের নৈপুন দৃশ্যগুলি বাংলাদেশি সিনেমার প্রান ছিল। কিন্তু এখনকার সিনেমা গুলোতে ঐরকম আশা করাটা দর্শকের আশা করাটা শুধুই আকাশ কুসুম কল্পনা।

আমার লেখার এই অংশে সিনেমার রূপসজ্জা, চিত্রগ্রহন, পোশাক, আর্টিস্ট কাস্টিং, শিল্প নির্দেশনা নিয়ে কিছু কথা বলবো। বাংলাদেশের সিনেমার রূপসজ্জার কাজ গুলি নতুন করে কিছু বলার নেই। রূপসজ্জা নিয়ে কথা বলতে গেলে বাণিজ্যিক সিনেমায় চিত্রনায়ক শাকিব খানের রূপসজ্জাই বোধয় উৎকৃষ্ট উধাহরন, তার রূপসজ্জার পার্থক্য তারই অভিনীত যৌথ প্রযোজনার সিনেমা দেখলেই বোঝা যায়। বাংলাদেশে এই রূপসজ্জার প্রেক্ষাপটটি কিন্তু শুধু শাকিব খানের ক্ষেত্রেই যে ঘটেছে ঠিক তা নয়, এটা বাংলাদেশের সিনেমায় অভিনয় করা সকল অভিনেতা/ অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

চিত্রগ্রহণের উপর একটা সিনেমার অনেক কিছু নির্ভর করে, আমারা যে সিনেমাটি দেখছি সেই সিনেমাটি কিন্তু চিত্রগ্রহণের মাধ্যমেই দেখছি। বাণিজ্যিক সিনেমার চিত্রগ্রহনের কাজে যথেষ্ট প্রযুক্তি ও কৌশলগত একটা অভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের সাদা কালো সিনেমাতে যে মানের চিত্রগ্রহনের কাজ দেখা গেছে, তা ৯০ থেকে ২০০০ সালের সিনেমা গুলোতে দেখা যায়নি। তবে সম্প্রতি যৌথ প্রযোজনা ব্যাতিত দেশীয় আয়নাবাজি সিনেমার চিত্রগ্রহণের কাজ অত্যন্ত মান সম্পন্ন দেখা গেছে।

পোশাক সিনেমার চরিত্রে রূপদানকারী শিল্পীদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা বহন করে। আমি খুব অকপটেই বলছি যে, যৌথ প্রযোজনার ও বিকল্প ধারার সিনেমা গুলো বাদে আমাদের দেশের বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোর পোশাকের বিষয়টি খুবই অবহেলিত। পৃথিবীর সব দেশের সিনেমাতে যখন শুধু পোশাকের জন্য একজন ফ্যাশন ডিজাইনার নিয়োগ দেয়া হয়, তখন আমাদের দেশের সিনেমাগুলো তা থেকে অনেক দূরে। যে সিনেমাগুলোর বাজেট একটু বেশি হয়ে থাকে শুধু মাত্র সেই সিনেমাগুলোর কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীদের পোশাকে কিছুতা ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেলেও বাকি অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীদের জন্য ব্যাপারটা একেবারেই হতাশাজনক।

বাংলাদেশের ৯০ দশক পর্যন্ত সিনেমা গুলোর জন্য যে আর্টিস্ট কাস্টিং এর বিষয়টি একেবারেই হতাশাজনক। এ ব্যাপারে কিছু কথা বলতেই হচ্ছে যে, আমাদের বাংলাদেশে যদি কোনো অভিনেতা/ অভিনেত্রীর একটি সিনেমা কোন কারণে হিট বা ব্যাবসাসফল হয়ে থাকে তাহলে পরবর্তীতে পর পর বেশ কটি সিনেমায় শুধু তাঁকেই দেখা যায়। উল্লেখ্য যে, সেই সিনেমার চরিত্রগুলো তাঁর জন্য মানানসই হোক বা না হোক তাঁকে সেই সিনেমাগুলোর জন্য চুক্তিবদ্ধ করা হয়ে থাকে। একটি মানুষ সব সিনেমার সব চরিত্রে মানানসই নাও হতে পারে বা সব চরিত্র একজন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নাও হতে পারে। সিনেমা শিল্পে ভারত অনেকটা এগিয়ে গেছে। তাই তাদের কিছু উদাহরন বলছি। যেমন ধরুন তারা সিনেমার জন্য লেখা একই চরিত্রের জন্য বিভিন্ন অভিনেতা ও অভিনেত্রীর কথা চিন্তা করে থাকেন। পরবর্তীতে স্ক্রিন টেস্টে যিনি ভালো করেন তাঁকেই চূড়ান্ত নির্বাচন করা হয়ে থাকে। পত্র পত্রিকার মাধমে এমন অনেক সংবাদ পড়েছি, যেখানে শুধু মাত্র নাকি চরিত্রকে ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য অনেকবার শিল্পী পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের পরিচালকরা কি ভেবে একজন মানুষকে বার বার সব চরিত্রের জন্য নির্বাচন বা আর্টিস্ট কাস্টিং করে, আমার বিষয় টা বোধগম্য নয়।

আমার লেখাটি এতক্ষন ধরে যারা এই অংশটুকু পর্যন্ত পড়ছেন, তাদের মনে একটা বিরক্তির উদ্রেক হতেই পারে। আমি বলছি এটা খুব স্বাভাবিক। ঠিকই তো, এত বড় লেখা কি পড়া যায়!!! কিন্তু তবুও আমার কিছু কথা আছে। বাংলাদেশি সিনেমা নিয়ে আমাদের কথা না বলার সময়টা এতটাই দীর্ঘ হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশি সিনেমা নিয়ে এখন কথা বলতে গেলে আর ছোট করে লেখা সম্ভব নয়। দেশের সিনেমা ভালো হোক মন্দ হোক তা দেশের দর্শকদেরকেই দেখতে হবে। ভালোমন্দ অভিমত দর্শক দেবে এটাও স্বাভাবিক। এই মতামতের উপর ভিত্তি করে নির্মাতারা তাদের নির্মাণে পরিবর্তন আনবে। বদলে যাবে চলচ্চিত্র। আসবে উন্নয়নের ধারা। এগিয়ে যাবে আমাদের দেশের চলচ্চিত্র, জয় করবে বিশ্ব।

একটি বিষয় খেয়াল করেছি আমি, সেটা হল আমাদের দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা অনেকেই দর্শকের উপর অনেক দোষ চাপিয়ে দিয়ে থাকেন এই বলে যে, দর্শকরা বাংলা সিনেমা দেখেননা। অনেকেই স্পষ্টবাদী হয়ে থাকেন দর্শকের ক্ষেত্রে, কিন্তু দর্শকের দিক থেকে কোন স্পষ্টকথা উনারা শুনতে অভ্যস্ত নন। এটা খুব আফসোসের বিষয় যে চলচ্চিত্র পরিচালকরা সবাই স্পষ্ট কথা বলতে পছন্দ করেন, কিন্তু উনারা দর্শকের বলা স্পষ্ট কথা বা মতামত শুনতে পছন্দ করেননা এমন কি দর্শকের দেয়া সিনেমার রিভিউটিও। এ কেমন বিচার দর্শকের প্রতি????

আমি এই সকল নির্মাতাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, দর্শকদের সম্মান করতে শিখুন, দর্শকের মতামত থেকে ভালো পরামর্শ গ্রহন করুন এবং দর্শকের জন্য ভালো কিছু নির্মাণ করুন। বিনোদনকে মানুষের মনের খোরাক বলা হয়। তো সেই মনের খোরাক নেবার জন্য দর্শক ভালো বিনোদনটাই খুঁজবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই বিনোদনের নামে বর্তমান চলচ্চিত্র নির্মাতারা যা ইচ্ছা তাই নির্মাণ করে যদি বলেন সেটি গ্রহন করতে, তাহলে বলবো এটি ঘোরতর অন্যায়। কারন একজন দর্শকই চলচ্চিত্র নির্মাতা, কলাকুশলীসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাজের বড় মূল্যায়নকারি এবং এই দর্শকের জন্যই আপনাদের নির্মিত সিনেমাগুলি হিট বা ফ্লপের তালিকায় উঠে আসে।

সবশেষে কিছু কথা বলতেই হবে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য চাই একটু চেষ্টা, যেকারনে আমাদের দেশের পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, অভিনেত্রী, কলাকুশলীসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের একজন গুণী নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল এর একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। যেখানে উনি অত্যন্ত চমৎকার একটি কথা বলেছেন। উনি বলেছেন যে, "বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উন্নয়নে প্রয়োজন তিনটি জিনিস-শিক্ষা, শিক্ষা, শিক্ষা। চলচ্চিত্র শিক্ষার ব্যাপক প্রসার প্রয়োজন"। আমি নিজেও উনার সাথে একমত। প্রতিটি কাজের জন্যই আছে আলাদা আলাদা শিক্ষা, আর সেই শিক্ষা ছাড়া কোন কাজেই উন্নতি করা সম্ভব নয়। আর তাই এই মুহূর্তে চলচ্চিত্র উন্নয়নে চলচ্চিত্রমুখী শিক্ষা নেয়াটাই চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের জন্য ইতিবাচক হবে বলে আমরা সকল দর্শক মনে করছি। তাহলে সিনেমা যদি এখন ছি!নেমা হয়ে থাকে, তবে সেই ছি!নেমা থেকেও সিনেমা হতে বেশি সময় লাগবেনা।

বি:দ্রঃ আমার এই লেখাটি সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত আবেগ, অনুভূতি, অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। এই লেখাটি কোনো ভাবেই পাঠকের আবেগ, অনুভূতি, অভিজ্ঞতাকে আঘাত করেনা। গঠনতান্ত্রিক মতামত সব সময়ের জন্য উৎসাহযোগ্য। এই লেখায় ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।