ষোড়শ সংশোধনী বাতিল, বিচারকদের জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তা ও কয়েকটি ঘটনার পরম্পরা

শেখ মেহেদী মির্জা
Published : 6 August 2017, 09:47 PM
Updated : 6 August 2017, 09:47 PM

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে বিচারপতি মো. মিজানুর রহমান ভূইয়ার পক্ষে তার জমাদার সিদ্দিকুর রহমান হাওলাদার হাইকোর্টের বিচারপতিদের কক্ষে কক্ষে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের খামে করে ব্লগার রাজীব হায়দারকে মুরতাদ (ইসলাম ধর্ম ত্যাগকারী) আখ্যায়িত করে লেখা একটি প্রতিবেদন দিয়ে আসেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তাঁর কোন অপরাধ খুজে পায়নি।

ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি অপসারনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার আইনের খসরা করেছিলো সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি এবি এম খাইরুল হক আর তা বাতিল করে দিলেন সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৭ বিচারপতি।

আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে থাকা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) প্রকারান্তরে বাধা দিচ্ছে সুপ্রীমকোর্ট। সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুদকের কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন হবে না। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অনুমোদন ও নির্দেশ ক্রমেই অরুনাভ চক্রবর্তী চিঠিটি দুদকে পাঠান বলে দুদকের নথি সূত্রে জানা গেছে।

সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে দেয় এবং জিয়া ও এরশাদের শাসন আমলকে অবৈধ ঘোষনা করে কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের বয়স ৬০ থেকে ৬২ এবং সপ্তম সংশোধনীর ফলে ৬২ থেকে ৬৫ করা হয়; উক্ত বিষয় দুটি বহাল রাখা হয়।

পাকিস্তানের একটি রায় ও বাস্তবতাঃ

১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মুনির প্রথমবারের মতো 'ডকট্রিন অব নেসেসিটি' তত্ত্বের প্রয়োগ করেন, তা ছিল রাষ্ট্রপ্রধান গোলাম মোহাম্মদ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারকে একতরফাভাবে, প্রশাসনিক নির্দেশের মাধ্যমে বরখাস্ত করার যে সিদ্ধান্ত নেন, তা আইনসিদ্ধ করতে।

যুক্তি ছিল, শাসনতন্ত্রের অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখা। দেশ বাঁচলে তবেই না শাসনতন্ত্র রক্ষার প্রশ্ন ওঠে। দেশ-বিদেশের নানা উদাহরণ হাতিয়ে, এমনকি রোম সাম্রাজ্যের ইতিহাস ঘেঁটে বিচারপতি মুনির রায় দিয়েছিলেন, দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না।

তাঁর এই অভিনব যুক্তি ব্যবহার করে সে দেশের সেনাবাহিনী যখন-তখন মখমলের গদিখানায় চড়াও হয় এবং দেশের মানুষের ওপর নিজের ইচ্ছামতো ছড়ি ঘোরায়। ইসকান্দার মির্জা ও আইয়ুব খান থেকে হালের মোশাররফ পর্যন্ত—সবাই এই একই যুক্তি দেখিয়েছেন।

বিচারপতি মুনির পরে নিজের আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানের দুর্ভোগের শুরু ওই ১৯৫৪ সালের সিদ্ধান্ত থেকেই।

সুপ্রিমকোর্টের রায় অবশ্য পালনীয় কিন্তু তা অভ্রান্ত নয়, তা বলা যাবে না। কে বড়? বিচার বিভাগ নাকি আইন বিভাগ নাকি নির্বাহী বিভাগ সে আলোচনায় না জড়িয়ে চলুন রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় আজ শেষ করি…

রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।