রবীন্দ্র সঙ্গীত কন্যা সুচিত্রা মিত্র চলে গেলেন

বেবী মওদুদ
Published : 27 Dec 2010, 05:42 PM
Updated : 4 Jan 2011, 04:55 PM

রবীন্দ্র সঙ্গীতের শেষ নক্ষত্রটি ঝরে গেল। পঙ্কজ মল্লিক, দেবব্রত বিশ্বাস, আবদুল আহাদ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কণিকা বন্দোপাধ্যায় , কলিম শরাফি ও সুচিত্রা মিত্র আমাদেরকে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনিয়ে যে বোদ্ধা বানাবার অবদান রেখে গেলেন, তার জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা শুধু রবীন্দ্র সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করেননি, রবীন্দ্রসঙ্গীত যাতে মানুষ শোনে তার এমন একটা আবহ তৈরি করেছেন যে, সেটাই হলো দুর্লভ। তাদের শ্রেষ্টত্ব এখানেই। রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনানোর মধ্য দিয়ে বাঙালিকে সংস্কৃতিবান, স্বদেশপ্রেমী, সাহসী ও সচেতন করে তুলতে এক বিরাট আত্মত্যাগ করেছেন তারা। বিশেষ করে তাঁদের কণ্ঠ, উচ্চারণ, গায়কী ভঙ্গীর জন্য তারা রবীন্দ্রনাথের ভাবশিষ্য হতে সক্ষম হন। এখানেই তাদের কৃতিত্ব ও সাফল্য। একসময় তাদের কণ্ঠের রবীন্দ্র সঙ্গীতের রেকর্ড মানুষকে প্রচণ্ডভাবে আনন্দ দিয়েছে, এমনকি আজকের প্রজন্মের কাছেও তাদের সিডি ভীষনভাবে জনপ্রিয় ।

কণিকা ব্যানার্জী ও সুচিত্রা মিত্র দুজনকে আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত কন্যা হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছি। শৈশবের জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তাদের গান শুনতে পেলে সব ভুলে যেতাম। আমার মায়ের নিয়ন্ত্রণে ছিল এইচএমভির রেকর্ড ও একটি কলের গান। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি কলের গানের বাক্স নিয়ে বসতেন। রেকর্ডে গান শুরু হলে আমরা যে যেখানে থাকতাম ছুটে এসে বসতাম। একটার পর একটা গান শুনতাম। কনিকা ও সুচিত্রা তখন থেকে আমার চিত্তের আধেয় হয়ে ওঠেন। যত বড় হয়ে উঠেছি তারা আমার হৃদয়ে স্থান নিয়ে ফেলেছেন। পাকিস্তানের রেডিওতে তাদের গান বাজানো নিষেধ ছিল। আমি আকাশবাণী কলকাতা রেডিওতে তাদের গান শুনতাম। তখন তো সাধারণ পরিবারের মেয়েরা মাত্র গান শিখতে শুরু করেছে। কেউ কেউ একটা দুটো করে গাইতে শুরু করেছেন মাত্র।

কিন্তু কণিকা, সুচিত্রা আমাদের কাছে যেন বিধাতা প্রদত্ত কণ্ঠের সেই স্বভাবজাত শিল্পী, যারা শুধুমাত্র গানে নয় ভাবের মাধ্যমেও আমাদের উজ্জীবীত করে চলেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনার, শেখার বা গাওয়ার আগ্রহ তাদের দেখেই আমাদের জন্মে।

কণিকা তো আগেই চলে গেছেন। সুচিত্রা মিত্রও আজ চলে গেলেন। আমার মনে হয়েছে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সর্বশেষ নক্ষত্রটিও খসে পড়লো। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। বার্ধক্যজনিত রোগ তাকে হঠাৎ কাবু করে ফেলে। মৃত্যুর সময় দুপুর বেলা তিনি খেতে বসেছিলেন। তারপরই হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ব্যথা নিয়ে চলে গেলেন।


কিংবদন্তী শিল্পীর মৃত্যুতে বাঙালি মাত্রই সবার মনকে বেদনায় আচ্ছন্ন করে তোলে। তার সহকর্মী, শিক্ষার্থী, গুণগ্রাহী সকলেই শোকাহত হয়েছেন। তিনি তো সঙ্গীত শিল্পী, স্বভাবজাত শিল্পী ছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার কণ্ঠ সবার থাকে না, এটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার কাছে একটা ভিন্ন মাত্রা মনে হতো। এই অবস্থানে এসে দাঁড়াতে তাঁকে রীতিমত চর্চা করতে হয়েছে। শুধুমাত্র সঙ্গীত নয়, উচ্চারণ এবং গানের কথা উপলব্ধি করতে হয়েছে। তাঁর শিক্ষার্থীরা বলেন, 'সুচিত্রা দি আমাদের গানটি শেখার আগে তার কথা পড়তে এবং উপলব্ধি করতে বলতেন।'

শিল্পীর কণ্ঠ শুধু মধুর হলেই চলবে না, তিনি যে গান গাইছেন তার ভাবটিও ফুটিয়ে তুলতে হবে। শ্রোতাকে সেই ভাবেও আকৃষ্ট করতে হবে। সুচিত্রা মিত্র ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের আক্ষরিক শিল্পী। তাঁর গলা ছিল উদাত্ত, উচ্চারণ ছিল স্পষ্ট। শব্দের সঙ্গে ভাবের মুগ্ধময় সমন্বয় ছিল তার কণ্ঠে। বিশেষ করে 'কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, আছে দুঃখ আছে মৃত্যু, মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান, আনন্দলোক মঙ্গলালোকে, আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে গানগুলি তাঁর গলায় বারবার শুনতে ইচ্ছে হয়। রবীন্দ্রনাথের গান যেন তাঁর অন্তরের উৎস ছিল। তাঁর গাওয়া গানগুলো এখন সিডির মাধ্যমে আমাদের কাছে স্মৃতি হয়ে থাকবে।

তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ছিলেন শুধু নয় রবীন্দ্র ভারতীয় শিক্ষক হিসেবেও জনপ্রিয় ছিলেন। একজন সচেতন মানুষ হিসেবেও তিনি তার সময়ের প্রতিনিধি হিসেবে নানা কর্মকান্ডে ব্যস্ত থাকতেন। শেষজীবনে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর ওপর একটি ডকুমেন্টরীও নির্মিত হয়েছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তিনি পথে পথে গান গেয়েছেন আমাদের শিল্পীদের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ঢাকায় এসে গান গেয়েছেন। সবার মন জয় করেছেন। সুচিত্রা মিত্র বাঙালি সাংস্কৃতির একজন আদর্শবান ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি সম্পূর্ণ রূপে ধারণ করেছিলেন বলেই একজন বড় মাপের শিল্পী ও মানুষ হতে পেরেছিলেন। তাঁর মধ্যে শিক্ষা-রুচি ও আন্তরিকতার পরিচ্ছন্নতা এতো বেশি ছিল যে তার পরবর্তী দু প্রজন্মের শিল্পীরা উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছে। তাঁর খুব কাছে গিয়ে আশীর্বাদ নিতে পেয়েছে।

তিনি রবীন্দ্রনাথের ছাত্রী ছিলেন না, তবে রবীন্দ্রনাথকে খুব কাছ থেকে দেখা ও জানার অভিজ্ঞতা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পনেরো দিন পর তিনি শান্তিনিকেতনে সঙ্গীত বিভাগে পড়তে যান। কবিগুরুর কাছে গান শিখতে পারেন নি, এটাই ছিল তার দুঃখ।

রবীন্দ্র সঙ্গীত কন্যা হিসেবে বাঙালির মননে সাংস্কৃতিতে হৃদয়ে সুচিত্রা মিত্র নদীর মত বহমান থাকবেন।
৩-১-২০১১

বেবী মওদুদ : সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।