রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের দেড়শ বছররবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে এ সময়ের গল্পকাররা

প্রমা সঞ্চিতা অত্রি
Published : 9 May 2011, 08:23 AM
Updated : 9 May 2011, 08:23 AM
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর ৭০ বছর পরে তাঁর ছোটগল্প নিয়ে কী ভাবছেন এখনকার গল্পলেখকরা? এ সময়ের লেখকদের কাছে রবীন্দ্রনাথের
গল্প নিয়ে কিছু প্রশ্ন রাখা হয়। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা গল্পে কী কী বদল ঘটেছে, রবীন্দ্রগল্পের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য কোনগুলি, রবীন্দ্রনাথের গল্প দিয়ে তিনি কতটা প্রভাবিত বা আদৌ প্রভাবিত কিনা বা তা কোন বৈশিষ্ট্যে আলাদা এবং তাদের প্রিয় রবীন্দ্র ছোটগল্প কোনগুলি–এ বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। দেখা গেছে, নিজের গল্পে রবীন্দ্রপ্রভাব নিয়ে বলতে গিয়ে গল্পকাররা একেকজন একেক রকম মত প্রকাশ করেছেন। কেউ যেমন নিজের লেখাতে অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথের ছায়া দেখতে পান, তেমনি অনেকেই আবার তাদের লেখায় রবীন্দ্র প্রভাব একেবারে নেই বলেই মনে করেন।
বি. স]

——————————————————-

শফিক রেহমান

(জন্ম: ১১ নভেম্বর ১৯৩৪)

রবি ঠাকুরের পরে আমাদের দুই বাংলাতেই অনেক ভাল গল্প লেখকের আর্বিভাব ঘটেছে বলে আমি মনে করি। আমার মনে হয় ঔপন্যাসিকের চাইতে গল্পকারই বেশি এসেছে আমাদের বাংলা সাহিত্যে। অনেক ভাল ভাল গল্পকার যেমন, সুবোধ ঘোষ, রমাপদ চৌধুরী, বারীন্দ্রনাথ দাস—যাঁর নাম হয়তো সবাই জানেন না, এরকম আরও অনেকেই আছেন। তারপর আরও আছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়–যাঁরা একাধারে ঔপন্যাসিকও বটে।

যেহেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে তাই আমি বলছি আমি হয়ত বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনার উপরেই বেশি লিখেছি, সেটাই আমাকে বেশি চিন্তিত করে।… হয়ত রবিঠাকুরের সময়ে, তাঁর লেখাতে রাজনীতি অতটা ইম্পর্টেন্ট হয়তো ছিল না। যদিও তার কিছু কিছু লেখায় রাজনীতি এসেছে কিন্তু সেটা তুলনামূলকভাবে কম।

তবে একটা জিনিস আমার কাছে যেটা মনে হয় যে, বাংলাদেশে ছোটগল্পটা ঠিক সেইভাবে হয় নি। এটার জন্য আমি চেষ্টা করেছি। 'যায়যায়দিন' যখন সাপ্তাহিক ছিল এবং এখন 'মৌচাকে ঢিল' এই দুই কাগজের মাধ্যমে আমি চেষ্টা করছি বাংলাদেশে যাতে ছোটগল্পকারের জন্ম হয়। সুখের বিষয় এই যে অনেকেই যারা খ্যাতিমান লেখক নন, মফঃস্বলের লেখক বা লেখিকা, তারা অনেকেই কিন্তু খুব ভাল লিখেছেন। কিছু কিছু গল্প আছে যেগুলো প্রায় ওয়ার্ল্ড ক্লাস হয়েছে, আমি বলব। কিন্তু এদেরকে কিন্তু অনেকেই চেনেন না। একটা নিদিষ্ট গণ্ডির মধ্যে তাদের পরিচয় সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। মোট কথা, এখানে কিন্তু ছোটগল্পকার অনেক হয়েছে এবং যখনই আমরা কোনো বিশেষ সংখ্যা বের করি, সেই সংখ্যাগুলো খুবই জনপ্রিয় হয় এবং তাতে অনেক ভাল ভাল গল্প থাকে। আমার মনে হয় ভবিষ্যতে এরকম আরও অনেক ছোটগল্প আসবে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের এখানে মূলত পরিচিত তাঁর কবিতা ও গানের কারণে। এ ব্যাপারটা ভীষণ লক্ষণীয় যে, আমাদের এখানে সাধারণ মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু গীতিকার ও কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। এর বাইরেও তাঁর যে পরিচয় আছে সেটা কিন্তু সাধারণ মানুষ অতটা জানে না। তিনি যে ছোটগল্প লিখেছেন সেগুলো কিন্তু তাঁর গান বা তাঁর কবিতাগুলোর মত ততটা জনপ্রিয় নয় বা তাঁর গীতিনাট্যগুলোও দেশে-বিদেশে যতটা সমাদৃত ততটা কিন্তু তাঁর উপন্যাস বা ছোটগল্পগুলি নয়। এখন তাঁর ছোটগল্পগুলোকে যদি সেভাবে নাট্যরূপ দেয়া যেত বা সবার মধ্যে পৌঁছে দেয়া যেত তাহলে লোকে হয়ত জানত যে তিনি একজন বড় গল্পলেখকও বটে। কিন্তু সেটা করা হয় নি। ফলে বেশিরভাগ লোক কিন্তু জানেই না যে তিনি একজন গল্পকার। বাংলাদেশে তিনি প্রথমত পরিচিত জাতীয় সংগীতের রচয়িতা হিসেবে দ্বিতীয়ত গীতাঞ্জলির লেখক হিসেবে এবং তৃতীয়ত তাঁর 'সঞ্চয়িতা'র জন্য তাঁকে কবি হিসেবে চেনে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তাঁকে আমরা শুধুমাত্র তাঁর গান ও কবিতার মধ্যেই বেঁধে ফেলেছি। তাঁর কাজগুলোকে আমরা সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। ফলে, তাঁর উপন্যাস বা ছোটগল্প নিয়ে বলতে গেলে কোনো কাজই হয়নি এখানে।

আমার গল্প নিয়ে আমি প্রথমে যে কথাটা বলব সেটা হচ্ছে আমি গল্প বেশি লিখিনি। গল্প লেখার চেষ্টা করেছি। সময় পেলে লিখতাম। আর যেসব গল্প আমি লিখেছি সেগুলো মূলত রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত। আমাদের দেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক অবস্থা চলছে এবং চারপাশে অস্থির যে সমাজ, সেটাই হয়ত আমার লেখায় চলে এসেছে। সেই ক্ষেত্রে রবিঠাকুরের সাথে আমার ডিফারেন্স। তবে আমি মনে করি যে রবিঠাকুরের সাথে আমার তুলনাই হতে পারে না। এটা একেবারেই ধৃষ্টতা বলে আমি মনে করি। উনার সঙ্গে আমার নাম নেয়াটাই আসলে ঠিক হবে না। এটা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা, ঔদ্ধত্য হবে। এটার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু যেহেতু আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে তাই আমি বলছি আমি হয়ত বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনার উপরেই বেশি লিখেছি, সেটাই আমাকে বেশি চিন্তিত করে। কারণ, এখানে ষোল কোটি মানুষের জীবন নির্ভর করছে রাজনীতির উপর। হয়ত রবিঠাকুরের সময়ে, তাঁর লেখাতে রাজনীতি অতটা ইম্পর্টেন্ট হয়তো ছিল না। যদিও তার কিছু কিছু লেখায় রাজনীতি এসেছে কিন্তু সেটা তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু আমার লেখায় রাজনীতিই প্রধান উপজীব্য।
আমার প্রিয় রবীন্দ্র ছোটগল্প হচ্ছে কাবুলিওয়ালা, ছোটবেলায় এটা পড়েছিলাম। এটার কথাই এ মুহূর্তে বেশি মনে পড়ছে।

হাসান আজিজুল হক

(জন্ম: ০২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯)

রবীন্দ্র পরবর্তীকালে বাংলা ছোটগল্প নানারকম ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। সেগুলো একটু ঘেঁটে দেখলেই ভালমত বোঝা যাবে। পরবর্তীকালের বিশাল গল্পভুবন নিয়ে আলোচনা করার তো এখানে সুযোগ নেই, দুই একটা পতাকা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন, রবীন্দ্রনাথের পরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তারপরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়–এদের কথা চলে আসে। এরপর পরবর্তীকালে আরও কজন বিশিষ্ট ছোটগল্পকার যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্র, এরকম আরও কয়েকজন আছেন। তারা গল্পের বিষয়বস্ত্তর ক্ষেত্রে ভীষণ রকম বৈচিত্র নিয়ে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্পে সাধারণ মানুষের কথা ছিল, গ্রাম্য সাধারণ মানুষের প্রতিচ্ছবি ছিল, কিন্তু তারা পেশার দিক থেকে জীবিকার দিক থেকে অনেকটা একইরকম ছিল।

রবীন্দ্রনাথের গল্পে সাধারণ মানুষের কথা ছিল, গ্রাম্য সাধারণ মানুষের প্রতিচ্ছবি ছিল, কিন্তু তারা পেশার দিক থেকে জীবিকার দিক থেকে অনেকটা একইরকম ছিল।… ভাষার দিক থেকেও রবীন্দ্রনাথের যে—অসাধারণ, অতিশয় উচ্চমার্গের যে ভাষা ছিল, যে ভীষণ মাধুর্যময় ভাষা ছিল, তাতে অনেকে এ অভিযোগও করতে পারে যে যতটা বিশাল কান্তি ছিল রবীন্দ্রনাথের মধ্যে, যতটা কান্তি ও সৌন্দর্য ছিল তার ভাষায়, তার পেশি অতটা জোরালো ছিল না।

কিন্তু পরবর্তীকালের গল্পে বিচিত্র মানুষের সমাবেশ হয়েছে, সমাজের নানা স্তরের মানুষের সমাবেশ হয়েছে। একেবারে কৃষক-শ্রমজীবী মানুষ যেমন আছে, একেবারে গ্রাম্য অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেদের কথাও আছে। এই যে ব্যাপারটা, সেটা কিন্তু রবীন্দ্র পরবর্তীকালে–এটা ঘটেছে। আবার ভাষার দিক থেকেও রবীন্দ্রনাথের যে—অসাধারণ, অতিশয় উচ্চমার্গের যে ভাষা ছিল, যে ভীষণ মাধুর্যময় ভাষা ছিল, তাতে অনেকে এ অভিযোগও করতে পারে যে যতটা বিশাল কান্তি ছিল রবীন্দ্রনাথের মধ্যে, যতটা কান্তি ও সৌন্দর্য ছিল তার ভাষায়, তার পেশি অতটা জোরালো ছিল না—এ অভিযোগ কেউ করতেও পারেন। রবীন্দ্র পরবর্তী কালের গল্পে ভাষাতে অনেক পেশি যোগ হয়েছে আর অনেক মাংসও যোগ হয়েছে, কিন্তু হয়ত অত মাধুর্য নেই, অত সৌন্দর্য নেই।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, মানবিকতার যে বিশুদ্ধ রূপ রবীন্দনাথ তুলে ধরেছেন তাঁর ছোটগল্পে, আমি বলব এটাই তার গল্পের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। যা পরবর্তীকালের লেখকরা পারেন নি। পরবর্তীকালে মানবিকতার চাইতে মানুষের রূপটাতেই আরেকটু বেশি জোর পড়েছে। যে মানুষ কামনা-বাসনা দ্বারা ক্ষুব্ধ, তাদের কথাই একটু জোরালোভাবে এসেছে।

রবীন্দ্র ছোটগল্প থেকে আমার ছোটগল্প কতটুকু বের হয়ে এসেছে বা আদৌ এসেছে কিনা সেটা আমার চাইতে সমালোচকরাই ভাল বলতে পারবেন বলে আমি মনে করি। এ ব্যাপারে আমার কোন মত নেই। এই দায়িত্বটা আমি আমার গল্পের পাঠকদের উপরেই দিতে চাই। তারাই এটা বিচার করুক। আমি যখন গল্প লিখি, আমার মনের মধ্যে তখন কত লোক যে বিচরণ করেন–তার কি কোন ঠিক আছে! লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে, রবীন্দ্রনাথ আছে, অন্য আরও সাহিত্যিকেরা আছে, ফলে কখন যে কার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি বা হইনি তা বলা মুশকিল। আরেকটা কথা সেটা হচ্ছে আমি আমার লেখালেখি শুরু করার পরেও অনেক সময়কাল পর্যন্ত বাংলা ছোটগল্পের সাথে আমার ফরমাল পরিচয় যাকে বলে, সেটা ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ততদিনে আমি আমার গল্পগুলো লেখা শুরু করে দিয়েছি। তার মানে একদিক থেকে বাংলা ছোটগল্পের ঐতিহ্যের ধারাটাকে আমি যে ঠিক অনুসরণ করেছি আমার লেখার ব্যাপারে, এটা বলাই যাবে না। এক অর্থে আমি নিজের ইঞ্জিনে নিজেই কয়লা দিয়েছি এবং সেই কয়লা থেকে যে বাষ্প বেড়িয়েছে তা দিয়েই আমার ইঞ্জিনটাকে চালানোর চেষ্টা করেছি। তবে পরবর্তীকালে অনেক কিছু পড়েছি, জেনেছি; ফলে কারও কারও ছাপ আমার লেখার মধ্যে পড়তেও পারে, সেটা অস্বীকার করছি না। অনেক প্রিয় লেখক আছেন যাদের দ্বারা হয়ত প্রভাবিত হয়েছি কিন্তু সেটা আমার চাইতে আমার সমালোচকেরাই বেশি ভাল বলতে পারবেন বলে আমার ধারনা।

রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে প্রায় শ'খানেক গল্প আছে। এর মাঝে পাঁচ সাতটা গল্প আছে যেগুলো আমার কোনদিনই পড়া হয় নাই। এছাড়া অন্য যে গল্পগুলো আছে, সেগুলো বেশিরভাগই আমার অনেকবার করে পড়া হয়েছে। এর মাঝে আমার, বেশ কিছু গল্প আছে খুব পছন্দের, যেমন পোস্টমাস্টার, ছুটি, কাবুলিওয়ালা, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, সম্পত্তি সমর্পণ, দেনা পাওনা, মণিহার ইত্যাদি। তবে আমার কাছে 'ক্ষুধিত পাষাণ' ও 'শাস্তি' গল্প দুটিকে রবীন্দ্রনাথের অন্যতম দুটি শ্রেষ্ঠ গল্প বলে মনে হয়।

হাসনাত আবদুল হাই

(জন্ম: ০৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯)

রবীন্দ্র পরবর্তীকালে বাংলা ছোটগল্পের বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথমত পরিবর্তন এসেছে কাহিনী বা পটভূমির দিক দিয়ে। অধিকাংশ রবীন্দ্র ছোটগল্পের পটভূমি ছিল গ্রাম। গ্রামই ছিল তাঁর গল্পের প্রাণ। গ্রামের সৌন্দর্য ও গ্রামীণ জীবন তাঁর মত করে আর কেউ বর্ণনা করতে পারেনি। পরবর্তী কালের গল্পকারদের ক্ষেত্রে শহরকে পটভূমি করেই গল্প লেখার প্রবণতাটা বেশি দেখা গেছে। আরেকটা পরিবর্তন এসেছে গল্প বলার ধরনে। সেটা হচ্ছে যে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোতে গল্প বর্ণনার ভঙ্গিটি ছিল সরাসরি। কিন্তু এখন সরাসরিভাবে বয়ান না করে একটু পরোক্ষভাবে গল্প বয়ানের রীতি প্রচলিত হয়েছে। তাছাড়া উনি গল্প লিখেছেন বিশ শতকের গোড়ার দিকে। সে সময়ের সমাজ বাস্তবতার সাথে তাঁর পরবর্তীকালের সমাজ বাস্তবতার ছিল বিস্তর ফারাক। সে বিষয়গুলোও তাঁর গল্পের থেকে পরবর্তীকালের রচিত গল্পগুলোর মাঝে পার্থক্য তৈরি করেছে। পরবর্তীকালে গল্পের চরিত্রগুলোর অনেক পরিবর্তন ঘটেছে এবং গল্পের বিষয়বস্ত্ততেও অনেক বৈচিত্র এসেছে। রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট চরিত্রগুলো ছিল সহজ-সরল ও ন্যায়বান কিন্তু পরবর্তীকালে চরিত্র চিত্রণে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার এসেছে। চরিত্রগুলোর মাঝে অনেক জটিলতা ঢুকে পড়েছে। গল্পকারের চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তনের সাথে গল্পের স্বরূপও পাল্টে যাচ্ছে। মোটকথা রবীন্দ্রনাথের প্রয়াতকাল পরবর্তী এই দীর্ঘ সময়ে বাংলা ছোটগল্পের বেশ কিছু বাঁক বদল ঘটেছে।

উনি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে অনেক কথা বলেছেন।… মূলত এই বিষয়টাই ছিল তাঁর ছোটগল্পের মূল উপজীব্য।… সহজ চোখে সরলভাবে যা দেখতেন তাই তাঁর গল্পে তুলে ধরতেন। এখন আমরা অনেক বাইরের পত্র-পত্রিকা পড়ি, ওগুলো দ্বারা প্রভাবিত হই…।

রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোর একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উনি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। মানব মনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো তিনি অনেক আন্তরিকতার সাথে তুলে ধরেছেন। মূলত এই বিষয়টাই ছিল তাঁর ছোটগল্পের মূল উপজীব্য। যেমন, পোষ্টমাস্টার গল্পে তারপর সমাপ্তি, হৈমন্তি এইসব গল্পগুলোতেও তাঁর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়। শরৎচন্দ্র কিংবা বঙ্কিমের গল্পে এ ব্যাপারটা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল উনি তাঁর গল্প নিয়ে অতটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন না। চারপশের বাস্তব জীবন থেকেই তিনি তাঁর গল্পের রসদ জোগাড় করতেন। সহজ চোখে সরলভাবে যা দেখতেন তাই তাঁর গল্পে তুলে ধরতেন। এখন আমরা অনেক বাইরের পত্র-পত্রিকা পড়ি, ওগুলো দ্বারা প্রভাবিত হই, কিন্তু তাঁর সময়ে তো তিনি এত পত্র পত্রিকা পড়ার সুযোগ পাননি, কিংবা পেলেও তা এখনকার তুলনায় অনেক কম।ফলে এই বিষয়গুলো তাঁর ভিতর খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প আমার ছোটগল্প থেকে আমি বলব অনেক দিক দিয়েই অন্যরকম। আমি এবং আমার যারা সমসাময়িক তারা প্রায় সবাই থাকি শহরে। তাই আমাদের গল্পগুলো হয় অধিকাংশই নগরকেন্দ্রিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায় তাঁর গল্পগুলো প্রায় সবই কিন্তু গ্রামীণ জীবন নিয়ে লেখা। এখানেই একটা বড় পার্থক্য আছে বলে আমি মনে করি। আর আরেকটা পার্থক্য যেটা আছে সেটা হল ভাষা এবং বর্ণনাভঙ্গীতে। উনার গল্প বর্ণনার ধরন এবং ভাষার ব্যবহার এখনকার লেখকদের চেয়ে তো অবশ্যই অনেক আলাদা।

আমার প্রিয় রবীন্দ্র ছোটগল্প হচ্ছে 'ক্ষুধিত পাষাণ'।

আবদুশ শাকুর

(জন্ম: ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১)

আমার কাছে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ছোটগল্পে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে, ছোটগল্পের আকৃতিতে-প্রকৃতিতে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাঠামোর বাইরে গিয়ে গল্প নিয়ে যত প্রচেষ্টা হয়েছে সে অনুপাতে সার্থকতা ততটা আসেনি। ততটা স্থায়ী মানের বা স্থায়ী গদ্যের ছোটগল্প রচিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথের পরে প্রেমেন্দ্র মিত্রকেই একমাত্র বলা যায় সত্যিকারের নতুন গল্পকার। কিন্তু এরকম খুব কমই দেখা গেছে। প্রমথ চৌধুরী ছোটগল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, 'ছোটগল্পকে ছোট হতে হবে এবং গল্প হতে হবে। এই দু'টিই শর্ত।' কিন্তু পরবর্তী কালের গল্পকারদের গল্পে আর গল্পত্ব থাকেনি। তারা ভেবেছেন গল্পের অ্যাখানভাগ অত বেশি থাকলে সার্থক ছোটগল্প হয় না, ওটা গল্প হয়ে যায়। তাই তারা অ্যাখানভাগ একদম কমিয়ে দিতে দিতে প্রায় একরকম বাদই দিয়ে ফেলছেন। এজন্যে এখনকার গল্পকারদের গল্পে আর গল্প থাকে না। থাকে শুধু কথা আর কথা, ব্যাখ্যা আর ব্যাখ্যা, কাব্যিয়ানা আর কাব্যিয়ানা, এইসব। গল্পত্ব অল্পই থাকে।

পরবর্তী কালের গল্পকারদের গল্পে আর গল্পত্ব থাকেনি। তারা ভেবেছেন গল্পের অ্যাখানভাগ অত বেশি থাকলে সার্থক ছোটগল্প হয় না, ওটা গল্প হয়ে যায়। তাই তারা অ্যাখানভাগ একদম কমিয়ে দিতে দিতে প্রায় একরকম বাদই দিয়ে ফেলছেন। এজন্যে এখনকার গল্পকারদের গল্পে আর গল্প থাকে না। থাকে শুধু কথা আর কথা, ব্যাখ্যা আর ব্যাখ্যা, কাব্যিয়ানা আর কাব্যিয়ানা…। গল্পত্ব অল্পই থাকে।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, তা গ্রামবাংলার প্রাণের কথা বলে এবং তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এসব গল্প রচিত হওয়া বলেই তা গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে একেবারে স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ একটা ধারণা তুলে ধরে। পল্লিগ্রামের যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা, সংস্কার, কুসংস্কার সবই এসেছে তাঁর গল্পে। বলা হয়ে থাকে সব মিলিয়ে তাঁর ছোটগল্পের সংখ্যা প্রায় পঁচাশি বা মতান্তরে নব্বইয়ের উপর। তাছাড়া তাঁর ছোটগল্পের নানারকম ভ্যালুয়েশন বা আমরা যাকে বলি মূল্য সংযোজন, সেটা হয়েছে। বলতে গেলে তিনিই তো বাংলা ভাষার প্রথম ছোটগল্পকার। সুতরাং ছোটগল্পকে তিনি গড়েছেন নিজের হাতে, নানা রূপে।

আমার ছোটগল্পগুলো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের থেকে প্রথমত ভাষার দিক দিয়ে অন্যরকম। আমি তো একেবারে প্রবন্ধের ভাষায় গল্প লিখি আর উনি একেবারে প্রাঞ্জল, সহজ-সরল ভাষায় গল্প লিখেছেন। আর তাছাড়া প্রতিটা মানুষই তো স্বতন্ত্র ফলে দেখার ভঙ্গিতে কিছুটা তফাৎ আছে, কালের প্রেক্ষিতে দৃষ্টিভঙ্গির যে পার্থক্য হয় সেটাও আছে। যেমন, আমার গল্পে সমাজতন্ত্র অনেক বেশি আসে, উনার গল্পের চাইতে; তারপর তাঁর গল্পে মানবিকতা বেশি আর আমার গল্পে সমাজবাস্তবতা বেশি।

তাঁর অনেক গল্পই আছে যেগুলো ভাল লাগে। নানা বিষয়ের উপরেই তো তিনি লিখেছেন। এর মধ্যে ঘাটের কথা, ক্ষুধিত পাষাণ তারপরে পোষ্টমাস্টার, শাস্তি-এই গল্পগুলো বেশি পড়া হয়েছে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

(জন্ম: ১৮ জানুয়ারি ১৯৫১)

রবীন্দ্র ছোটগল্পের একটা ধারা আর তার পরবর্তী ছোটগল্পের যে ধারা দুটি প্রায় ভিন্ন দুটি ধারা। রবীন্দ্রনাথের পরে সমাজ বাস্তবতা পাল্টেছে, রাজনৈতিক বাস্তবতা পাল্টেছে, বৈশ্বিক বাস্তবতা পাল্টেছে; তারপর ছোটগল্পের ধরনে অনেকগুলো পরিবর্তন এসেছে যেমন এক সময় তো বাস্তববাদী যুগ ছিল তারপর আধুনিক যুগে রবীন্দ্রনাথ নিজেও লিখেছেন, অনেক ধরনের শৈলী ব্যবহার করেছেন। আধুনিক কাল পরিবর্তিত হয়ে উত্তরাধুনিক কালে গেছে, আখ্যানধর্মিতার পরিবর্তন এসেছে। ফলে রবীন্দ্রনাথের পরে ছোটগল্পে অনেকরকম পরিবর্তন এসেছে। বিষয়বস্ত্ততে হয়ত কয়েকটা ব্যাপার আছে যা চিরন্তন, কিন্তু তারপরও সমাজ বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়বস্ত্ততে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এই যে দেশবিভাগ, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, এ বিষয়গুলো ছোটগল্পের মধ্যে চলে এসেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। এগুলি তো রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতায় ছিল না। তারপর যেটা হচ্ছে যে–শৈলীতে এবং আখ্যান বয়ানভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। তো এইটাই খুব স্বাভাবিক।

তিনি কিন্তু খুব বড় পরিসরে গল্প লেখেননি। তাঁর গল্পের পাত্র-পাত্রীরা সবাই খুব সাধারণ।… তাঁর গল্পের যে ভাষা সেটি অত্যন্ত চমৎকার ও সংবেদনশীল একটি ভাষা। তাঁর চরিত্র চিত্রায়ন অসম্ভব কুশলতাপূর্ণ।… তাঁর এক চরিত্রের সঙ্গে আরেক চরিত্রের যে সম্পর্ক স্থাপন পদ্ধতি তা এত চমৎকার যে মনে হয় এর কোন বিকল্প নেই।… তাঁর ছোটগল্পের ভুবন একেবারেই আমাদের জানাশোনা অন্তরঙ্গ একটি ভুবন। যে ভুবনে তিনি আমাদেরকে তাঁর সঙ্গে করে নিয়ে যান। তিনি কখনো পাঠকদের নিজেদের উপর ছেড়ে দেন না। উনি যেন তাঁর হাত ধরিয়ে আমাদেরকে তাঁর গল্পের ভুবন দিয়ে হাঁটান!

রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ছোটগল্পের একটা সংজ্ঞা দিয়েছিলেন যে, ছোট ছোট দুঃখকথা থাকবে, নিতান্তই সহজ-সরল হবে অর্থাৎ খুব বেশি বাগাড়ম্বর থাকবে না, আর শৈলীর নামে শৈলী নির্ভরতাটা থাকবে না। ছোটগল্পের ভুবনটা হবে এরকম যে একটা আখ্যান থাকবে এবং যে ভাষাটি ব্যবহৃত হবে সেটি হবে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটা ভাষা, যেটি পণ্ডিতি বা পোশাকি ভাষা নয়, যে ভাষাটি মানুষ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করে আর সবচেয়ে বড় জিনিস–যেটা তিনি বলেছিলেন—যে, ছোটগল্পের অভিঘাতটা হবে যে, শেষ হইয়াও হইল না শেষ। এটা রবীন্দ্রনাথের চমৎকার একটা অভিঘাত যে, তিনি বলে যাচ্ছেন আর আমরা গল্পটা পড়ছি এবং একবার পড়ার পর মনে হয় যেন আবার পড়ি! কিছুতেই যেন আমাদের মনে হচ্ছে না যে গল্পটা শেষ হয়েছে। এই অভিজ্ঞতাটা আসলে আবেগের, অনুভূতির। আরেকটা বিষয় হচ্ছে তাঁর অধিকাংশ গল্পই রচিত হয়েছে মানুষের ছোট ছোট অনুভূতির জায়গাগুলোকে নিয়ে। তিনি কিন্তু খুব বড় পরিসরে গল্প লেখেননি। তাঁর গল্পের পাত্র-পাত্রীরা সবাই খুব সাধারণ। মধ্যবিত্ত পরিবার, গ্রামের মানুষ এরাই তাঁর গল্পের চরিত্র হয়ে এসেছে ঘুরে ফিরে। আমাদের চারপাশে অভিজ্ঞতার যে সাধারণ পরিমণ্ডল এর থেকে খুব একটা বাইরে তিনি যাননি । সে অর্থে বলা যায়, তাঁর গল্পের বিষয়বস্ত্ত আমাদের একেবারেই অন্তরঙ্গ একটা বিষয়বস্ত্ত। আরেকটা দিক যেটা–সেটা হচ্ছে, তাঁর ভাষা। তাঁর গল্পের যে ভাষা সেটি অত্যন্ত চমৎকার ও সংবেদনশীল একটি ভাষা। তাঁর চরিত্র চিত্রায়ন অসম্ভব কুশলতাপূর্ণ। প্রতিটা চরিত্রই অত্যন্ত জীবন্ত বলে মনে হয়। তারপরে তাঁর এক চরিত্রের সঙ্গে আরেক চরিত্রের যে সম্পর্ক স্থাপন পদ্ধতি তা এত চমৎকার যে মনে হয় এর কোন বিকল্প নেই। একেবারে নির্বিকল্প একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তাঁর সেই পারদর্শিতাটি। সব মিলিয়ে আমি বলব যে তাঁর ছোটগল্পের ভুবন একেবারেই আমাদের জানাশোনা অন্তরঙ্গ একটি ভুবন। যে ভুবনে তিনি আমাদেরকে তাঁর সঙ্গে করে নিয়ে যান। তিনি কখনো পাঠকদের নিজেদের উপর ছেড়ে দেন না। উনি যেন তাঁর হাত ধরিয়ে আমাদেরকে তাঁর গল্পের ভুবন দিয়ে হাঁটান! এ বিষয়টা আমার কাছে অনেক বড় একটা ব্যাপার বলে মনে হয়।

আমার নিজের লেখার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বরাবরই অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। শুধু আমি না আমার মনে হয় যিনিই বাংলা ভাষায় ছোটগল্প লিখবেন এবং যে শৈলীতেই লিখুন না কেন তিনি রবীন্দ্রনাথের থেকে অনুপ্রেরণা পাবেন। তাঁকে অনুসরণ করবেন না, কারণ অনুসরণ করার আসলে কিছু নেই। তিনি এমন একজন মানুষ যাকে অনুসরণ করতে গেলে তাঁর পদচিহ্নের মধ্যেই আটকে থাকতে হবে। আমি আমার দু'টো বিষয়ে মনে করি যে রবীন্দ্রনাথের থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। একটা হচ্ছে যে গল্পের ভেতরে একটা গল্প থাকতে হয়। আমি চেষ্টা করেছি গল্পটাকে শুধু অন্তঃসার শূন্য না, শুধু বাগাড়ম্বর বা কথার সর্বস্বতা না বা শুধু শৈলীর সর্বস্বতায় আমি কখনো বিশ্বাস করিনি। তাঁর প্রতিটা গল্পের ভিতরে একটা গল্প থাকে যা আমাকে সবসময়ই খুব অনুপ্রাণিত করে। আর দ্বিতীয় হচ্ছে তাঁর চরিত্রায়ন। অত্যন্ত জীবন্ত তাঁর চরিত্রায়ণ। জীবন্ত, এজন্য যে তাঁর প্রতিটা চরিত্রই জীবন থেকে নেয়া। বাস্তব চরিত্র। কোন আরোপিত বা একেবারে মনগড়া কোন চরিত্র তাঁর গল্পের মাঝে নেই। এই যে জীবনের সাথে সম্পর্কিত চরিত্র, প্রতিদিনের গল্পের ভিতর জেগে উঠা চরিত্র, এটি আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়।

তবে আমার লেখার আরও কিছু বিষয় আছে, যেমন জাদুবাস্তবতার ব্যাপারটা, যেটা রবীন্দ্রনাথের গল্পে এভাবে ছিল না। তিনিও কাজ করেছেন পরাবাস্তবতা নিয়ে যেমন 'ক্ষুধিত পাষাণ' গল্পে, কিন্তু আমার গল্পে আমি জাদুবাস্তবতার যে বিষয়টা সেটা ব্যবহার করেছি বাস্তবতার অনুষঙ্গ হিসেবে, বাস্তবেরই একটা সম্প্রসারণ হিসেবে। এই একটা দিকই আমি বলতে পারব যে আমি বেরিয়ে এসেছি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প থেকে। আর দ্বিতীয় আরেকটা ব্যাপার আছে সেটা হচ্ছে ভাষার দিক থেকে। আমি আমার লেখায় আমার একেবারে আঞ্চলিক ভাষাটাও মাঝে মাঝে ব্যবহার করি। যেটা রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় একেবারেই করেননি। তবে একথা আমি আবারও বলি যে, রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার তুলনা আমি কোন ক্রমেই করতে চাই না। কারণ একেবারে হিমালয়ের সাথে একটা মাটির ঢিবির তুলনাটা শুধু আকৃতিগতভাবে একটা খুব বিপর্যয়েরই সৃষ্টি করে! আমি তাই সবসময়ই বলি যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের অনুপ্রেরণা।

তাঁর অনেক গল্প আছে যেগুলো মনে দাগ কেটেছে। যেমন, 'একরাত্রি' নামে একটা গল্প আছে, অসাধারণ একটা গল্প তারপর 'ক্ষুধিত পাষাণ' গল্পটা আমাকে খুবই নাড়া দেয়, যতবার পড়ি আমার কাছে অদ্ভুত লাগে গল্পটা। 'দান-প্রতিদান', 'মনিহার', 'কাবুলিওয়ালা', 'হৈমন্তি', 'পোস্টমাষ্টার'–এ গল্পগুলো উনার একেবারে অমর-অজর গল্প। এগুলো কোনোদিন মানুষ ভুলবে না। তারপর তাঁর 'ল্যাবরেটরি' উত্তরাধুনিক ধাচেঁর একটা গল্প। এ গল্পটাও বেশ মজার। মোটের উপর, তাঁর লেখা প্রিয় ছোটগল্প আমার এগুলোই।

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর

(জন্ম: ৩১ জানুয়ারি ১৯৬৩)

রবীন্দ্র পরবর্তীকালেই শুধু রবীন্দ্র গল্প'র পরিবর্তন হয়নি, বরং তিনি তার কালে–তিনিই তিনার গল্পের অনেক পরিবর্তন করেছেন। ছোট প্রাণ ছোট ব্যথার গল্পকৌশল তিনি নিজেই নড়বড়ে করে দিয়েছেন। নষ্টনীড় আর ল্যাবরেটরি ধরনের গল্পে এসেছে জীবনের বহুমাত্রিক বয়ান। এই সময়ের গল্প, গল্পের জায়গা-জমিন, বলার ধরন, ভাষার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। একসময় মনে করা হতো গল্পে গল্প থাকবে, রবীন্দ্রনাথের গল্পে তা ছিলও; এখন গল্পহীন গল্পও হয়, কখনও-বা শুধু অনুভূতির সারাৎসার হয়ে যাচ্ছে গল্প।

তিনি গল্পে একটা নিপুণ কাহিনী বলতে চান, ম্যাসেজ দেয়ার টেন্ডেন্সি তার আছে। ন্যারেটিভ বেশ সরস, পূর্ববাংলার জীবন-জগৎ তার গল্পে চলে আসে। এখানেই তার উপন্যাস আর প্রবন্ধ থেকে তার ভাবময়তা যেন আলাদা। এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে তার উপন্যসে পূর্ববাংলার কোনো বিস্তৃত জীবনালেখ্য নেই, ভাব নেই, ভাবযাতনা নেই। তিনি জল-নদী-হাওর-খাল-বিলের এই বঙ্গকে উপন্যাসের যথার্থ চারণভূমি যেন মনে করতে চাননি! তার গল্পের শিক্ষিত চরিত্রসকল প্রায়শঃই উপনিবেশ চৈতন্যকে লালন করে।

তিনি গল্পে একটা নিপুণ কাহিনী বলতে চান, ম্যাসেজ দেয়ার টেন্ডেন্সি তার আছে। ন্যারেটিভ বেশ সরস, পূর্ববাংলার জীবন-জগৎ তার গল্পে চলে আসে। এখানেই তার উপন্যাস আর প্রবন্ধ থেকে তার ভাবময়তা যেন আলাদা। এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে তার উপন্যসে পূর্ববাংলার কোনো বিস্তৃত জীবনালেখ্য নেই, ভাব নেই, ভাবযাতনা নেই। তিনি জল-নদী-হাওর-খাল-বিলের এই বঙ্গকে উপন্যাসের যথার্থ চারণভূমি যেন মনে করতে চাননি! তার গল্পের শিক্ষিত চরিত্রসকল প্রায়শঃই উপনিবেশ চৈতন্যকে লালন করে। তার গল্পে জীবনের বহুমাত্রিকতা আছে, আছে ভাষার পরিবর্তন। অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষজন, যেমন, চাকর, কৃষক, অবহেলিত নারী, এমনকি বৈরাগী/মুসলমান চরিত্রও তার গল্পে লক্ষ করা যায়।

আমার ছোটগল্প রবীন্দ্র-প্রভাব নেই বলেই ধারণা রাখি। আমার গল্পে জীবন আরও বর্ণিল, বৈচিত্রের ভিতর দিয়ে যাতায়াত করে। কেবল অনুভূতি, কাহিনী, বা ম্যাসেজ আমার গল্পের নিয়ন্ত্রক নয়। আসলে আমার গল্পে কোনো নিয়ন্ত্রণকারী আছে বলেও মনে করি না। একই গল্পে ভাষার চলিত-লৌকিক, এমনকি বৈঠকি মেজাজ থাকতে পারে, অনেক বেশি রাজনৈতিক, সমকালীনতা প্রচণ্ডভাবে আছে বলে আমি মনে করি। আমি আর আমার গল্পচরিত্র বা জীবন আলাদা আছে বলে মনে করতে চাই না। রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ-জমিদারি ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকে গল্প লিখেছেন বলে আমার ধারণা হয়। কিন্তু আমি জীবনের সামগ্রিকতা থেকে গল্পকে আলাদা করতে পারি না। তবে এ কথাও স্বীকার করতে চাই, রবীন্দ্রনাথ গল্পভুবনের এক বিশাল বৃক্ষের নাম, এর ছায়ায় না-এসে কারও উপায়ও নাই।

রবীন্দ্রনাথের প্রিয় গল্প অনেক। বিশেষ করে আমার পাঠকৃত একাডেমিক গল্প নানাভাবে আমায় জারিত করে– এসব হচ্ছে বলাই, পোস্টমাস্টার, কাবুলিওয়ালা, ছুটি, হৈমন্তি। এর বাইরে বার বার পাঠ করি ক্ষুধিত পাষাণ, নষ্টনীড়, কঙ্কাল, শাস্তি, স্ত্রীর পত্র, জীবিত ও মৃত, একরাত্রি, ল্যাবরেটরি, বোষ্টমি।

শাহাদুজ্জামান

(জন্ম: ১ জানুয়ারি ১৯৬২)

আধুনিক ছোটগল্প ব্যাপারটি যখন বিশ্বসাহিত্যে দানা বাঁধছে তার কাছাকাছি সময়েই রবীন্দ্রনাথ গল্প লিখতে শুরু করেছেন এবং যে গল্পগুলো তিনি লিখেছেন সেগুলো সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যের গল্পগুলোর সমান্তরালে রাখা চলে। বলা চলে একেবারে সূচনা থেকে রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে বিশ্বমানের গল্প দিয়েই বাংলা ছোটগল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে। ফলে পরবর্তীকালে যারা গল্প লিখতে এসেছেন তাদের একটি বেশ উঁচু মানদণ্ডের বিপরীতে কাজ করতে হয়েছে। তবে ছোটগল্পের বিষয়বস্তু, ভাষা, প্রকরণের যে মানচিত্র রবীন্দ্রনাথ তৈরী করেছিলেন তাঁর সীমানা অতিক্রম করবার চেষ্টা করেছেন পরবর্তীকালের অনেক লেখকই। বেশ কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও রবীন্দ্রনাথের গল্পের প্রধান পাত্রপাত্রীরা শিক্ষিত, সুশীল, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর। রবীন্দ্রপরবর্তীকালের অনেক লেখক তাদের গল্পে শ্রেণীর এই সীমা অতিক্রম করেছেন, তাঁরা নিন্মবিত্ত, অন্ত্যজ মানুষের জীবনকে তাদের গল্পে তুলে এনেছেন। আবার রবীন্দ্রভাষা বলয় থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষাভঙ্গির গল্প লিখেছেন কমলকুমার মজুমদার। গল্পের প্রকরণ পরিবর্তনেরও চেষ্টা চলেছে। আদি-মধ্য-অন্তের ন্যারেটিভকে ভেঙে অ্যান্টি-ন্যারেটিভ গল্প লেখা হয়েছে। সুবিমল মিশ্র প্রমুখ সে চেষ্টা করেছেন। বিশ্বসাহিত্যের নানা নতুন ভাবধারাকে বাংলা গল্পে আনবার চেষ্টা হয়েছে। শহীদুল জহির যেমন যাদুবাস্তবতার ভাবনা এবং প্রকরণের ব্যবহার করেছেন। তবে গল্পের এইসব প্রবণতার কথা মাথায় রেখেও বলা যায় মোটাদাগে পরিসর, থিম, মুহূর্তের সমন্বয়ে অ্যালান পো যাকে বলেছিলেন 'ইউনিটি অব ইফেক্ট', যা ছিলো রবীন্দ্রগল্পের মূল প্রবণতা, তা থেকে বাংলা গল্প ব্যাপক কোনো বাঁক নিয়েছে তা বলা যায় না। রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কবিতার মানচিত্রের যে আমূল পরিবর্তন আমরা দেখি গল্পের ক্ষেত্রে সেটা ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না।

রবীন্দ্রনাথ যখন গল্প লিখতে শুরু করেন তখন বিশ্বসাহিত্যের ছোটগল্পের দিকপাল লেখকরা হচ্ছেন সমরসেট মম, অ্যাডগার অ্যালান পো, মোঁপাশা, ও হেনরি প্রমুখ। লক্ষ করি এইসব বিশ্বখ্যাত লেখকদের ছোটগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে 'সারপ্রাইজ'। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গল্প লিখতে গিয়ে সে পথে হাঁটেননি। যদিও তাঁর গল্পে সারপ্রাইজ আছে তবে 'সারপ্রাইজ ইলিমেন্ট' তার গল্পের প্রধান শক্তি নয়। অপ্রত্যাশিত চমক দিয়ে সাধারণত তাঁর গল্প শেষ হয় না বরং গল্প শেষে পাঠকের জন্য একটা বিশেষ থিমের উসকানি থাকে।

রবীন্দ্রনাথ যখন গল্প লিখতে শুরু করেন তখন বিশ্বসাহিত্যের ছোটগল্পের দিকপাল লেখকরা হচ্ছেন সমরসেট মম, অ্যাডগার অ্যালান পো, মোঁপাশা, ও হেনরি প্রমুখ। লক্ষ করি এইসব বিশ্বখ্যাত লেখকদের ছোটগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে 'সারপ্রাইজ'। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গল্প লিখতে গিয়ে সে পথে হাঁটেননি। যদিও তাঁর গল্পে সারপ্রাইজ আছে তবে 'সারপ্রাইজ ইলিমেন্ট' তার গল্পের প্রধান শক্তি নয়। অপ্রত্যাশিত চমক দিয়ে সাধারণত তাঁর গল্প শেষ হয় না বরং গল্প শেষে পাঠকের জন্য একটা বিশেষ থিমের উসকানি থাকে। এটি রবীন্দ্রগল্পের বৈশিষ্ট্য।

রবীন্দ্রনাথের গল্পের কাঠামোর একটা ব্যাপার আমি বেশ উপভোগ করি। প্রায়শঃই তাঁর এক গল্পে একাধিক গল্প জুড়ে দেয়া থাকে। রাশান মাত্রিওস্কা পুতুলগুলোর মত এক গল্পের কোঠরে আরেক গল্প গুঁজে দেয়ার টেকনিকটি কৌতূহলোদ্দীপক। কালঘনিষ্ঠতাও তাঁর গল্পের একটি বৈশিষ্ট্য। তাঁর গল্পগুলো তার সমকালের বিবিধ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে তাঁর বয়ান বলা যায়। উদীয়মান শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তের নানা প্রগলভতা, সামন্ত ক্ষয়িষ্ণুতা, জাতপাত, কন্যাদায়গ্রস্ততা, সাহিত্যিক উন্নাসিকতা, নারী পুরুষ সম্পর্কের পরিবর্তনশীলতা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গকে কখনো কৌতুক, কখনো বিষাদ, কখনো ক্রোধে তিনি উপস্থিত করেছেন তাঁর গল্পে।

রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ পড়ি কৈশোরে, বেশ গোগ্রাসে পড়েছি মনে আছে। তারপর বহু বছর আর তাঁর গল্প পড়িনি। আমি নিজে যখন গল্প লেখা শুরু করি তখন আমার মনোযোগ ছিলো বিশেষত ল্যাটিন আমেরিকার গল্প পড়ার দিকে আর পড়েছি বাংলা সাহিত্যে সমসাময়িক যারা নানারকম নিরীক্ষাধর্মী গল্প লিখছেন তাদের লেখা। আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে যাবার পর আমি আবার মনোযোগের সঙ্গে গল্পগুচ্ছ পড়ি। কৈশোরের সারল্য তখন আর নেই। মগজে মার্ক্সিস্ট ইসথেটিকস, পোস্টমর্ডানিস্ট বিতর্ক। তবু নতুন পাঠেও রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ গল্পে আমার মনোযোগ অখণ্ড থাকে। আমার ছোটগল্পের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মিল অমিল আছে কিনা ভেবে দেখিনি। রবীন্দ্রনাথের কাছে ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধের জন্য পৃথক ঘর, আমার এই ঘরগুলোর দেয়াল ভেঙে ফেলতে ইচ্ছা হয়, চেষ্টা করি। তবে গল্পের ভেতর গল্প, চমকের বদলে গল্পে একটা কোন মুহূর্ত, কোন অমীমাংসিত অনুভূতি, কোন তর্ককে জারি রাখার রবীন্দ্রনাথের চেষ্টাটি আমাকে আকর্ষণ করে। এসবের হয়তো পরোক্ষ প্রভাব আমার গল্পে থেকে থাকতে পারে।

রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলো অনেক আগে পড়েছি। সবগুলো গল্প মনেও নেই। এ মুহূর্তে প্রিয় গল্প বেছে বলা দুষ্কর। রবীন্দ্রনাথের কিছু গল্প স্কুল পাঠ্যপুস্তকে পড়তে গিয়ে কিম্বা কিছু গল্পের চলচ্চিত্ররূপ দেখতে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে সেসব গল্প পাঠের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। তবে ভাবতে বসলে কিছু গল্পের ছবি, চরিত্র মনে উঁকি দেয় বৈকি। 'অতিথি' গল্পের তারাপদকে মনে পড়ে–যে স্নেহ, প্রেম, বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্রবন্ধন জীবনকে ঘিরে ফেলবার আগেই বার বার পালায়; মনে পড়ে 'একটি ক্ষুদ্র পুরাতন গল্প'-এ গল্পকে ভেঙে ফেলবার ভঙ্গিটি, চাইলে গল্পটির গায়ে রীতিমত উত্তর আধুনিকতার তকমা পড়ানো যায়; 'কঙ্কাল' গল্পে একটি খুলির মুখে প্রেম, হত্যা, আত্মহত্যার বয়ানটিকে যেভাবে সাজানো হয়েছে সেটিও চমৎকার, 'অপরিচিতা' গল্পের সপ্রতিভ মেয়ে কল্যাণীকে মনে পড়ে–অন্ধকার প্লাটফর্ম থেকে যার কণ্ঠস্বর শোনা যায় 'জায়গা আছে'। 'ঠাকুর দাদা' গল্পের নিঃস্ব জমিদারের বিত্তের মর্মান্তিক ছলনাটির কথা মনে আছে, মনে আছে 'দুরাশা' গল্পে দার্জিলিং এর কুয়াশায় দাঁড়ানো নারী সন্ন্যাসীটির কথা যে সেপাই বিদ্রোহের পক্ষাবলম্বী কুলত্যাগী এক মুসলমান নবাবের; 'অধ্যাপক' গল্পের সেই দৃশ্যটি মনে পড়ছে যখন কিরণের শাড়ির আঁচল থেকে তার আধখাওয়া পেয়ারাটি মাটিতে গড়িয়ে পড়লে তার ঐ 'দংশনচিহ্নিত, অধরচুম্বিত' পেয়ারাটি হাতে তুলে নেবার জন্য মহীন্দ্রের প্রাণ উচাটন হয়ে ওঠে।

পাপড়ি রহমান

(জন্ম: ২০ নভেম্বর ১৯৬৪)

রবীন্দ্রনাথের পরে ছোটগল্প কতটুকু পরিবর্তিত হয়েছে একেবারে সঠিক মাপজোক করা মুশকিল। তবে অবশ্যই পরিবর্তিত হয়েছে। এই শতবর্ষের অধিক সময়ে সমাজ, জীবন তথা রাষ্ট্র বদলের সঙ্গে সঙ্গে ছোটগল্পও বদলে গেছে। ওই সময়টাতে কথাসাহিত্য অধিকাংশই ছিল ভাববাদের আলোকে বাস্তববাদের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি। কিন্তু এখন তো তা নয়। এখন সরাসরি বাস্তবই হয়ে উঠছে শিল্প বা গল্প। রবীন্দ্রনাথ মানব সংসারের যা কিছু কদর্য, হতশ্রী তা আড়ালে আবডালে রাখতেই ভালোবাসতেন। কিন্তু এখনকার ছোটগল্প একেবারে উন্মোচিত। ভয়ানক রুঢ়, কঠিন, নির্লজ্জ্ব, নগ্ন এর প্রকাশ। এই সময়ের ছোটগল্পকাররা অনেক বেশি বাস্তববাদী। সাহসী। জীবনজটিলতাগুলো খোলাখুলিই বলতে চান। ফলে রাখঢাকের বালাই তাদের কম।আমাদের এ সময়ের বেশিরভাগ গল্পই নীতিভ্রষ্টতা, মনোবীক্ষণ, হতাশা, রাজনীতি, ধূসরতা ইত্যাদি নিয়ে আবির্ভূত।আবার কে যে কোথা থেকে কী বা কাকে কিভাবে গল্প করে তুলছেন এটাও বলা মুশকিল। সেদিন একেবারে অনতি তরুণের এক গল্প পড়ে চমকে উঠলাম। গল্পের নাম-বেওয়ারিশ কুকুর, কালার পরোটা এবং একটি ব্যক্তিগত আফসোস।একটা কুকুর ট্রেনে কাটা পড়ার আগে নিজের আধখানা পরোটা খাইয়েছিল কুকুরটিকে।কুকুরের বাকি অংশ যখন একজন আরেকটা চলমান ট্রেনের তলায় দিয়ে এলো, ওই আধখানা পরোটার আফসোস তখনো তার যায়নি! কী জটিল মনঃস্তত্ত্ব ভাবা যায়? তো আগেই বলেছি একেবারে নির্ধারণ করা মুশকিল বদলটা কোথায় বা কতোটা?

ওই সময়টাতে কথাসাহিত্য অধিকাংশই ছিল ভাববাদের আলোকে বাস্তববাদের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি। কিন্তু এখন তো তা নয়। এখন সরাসরি বাস্তবই হয়ে উঠছে শিল্প বা গল্প। রবীন্দ্রনাথ মানব সংসারের যা কিছু কদর্য, হতশ্রী তা আড়ালে আবডালে রাখতেই ভালোবাসতেন। কিন্তু এখনকার ছোটগল্প একেবারে উন্মোচিত। ভয়ানক রুঢ়, কঠিন, নির্লজ্জ্ব, নগ্ন এর প্রকাশ। এই সময়ের ছোটগল্পকাররা অনেক বেশি বাস্তববাদী। সাহসী। জীবনজটিলতাগুলো খোলাখুলিই বলতে চান। ফলে রাখঢাকের বালাই তাদের কম।

উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য না বলে পছন্দনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো বরং বলি। যেমন যে কোনো গল্পের জন্য ভাষা একটা বড় বিষয় আমার কাছে।রবীন্দ্রনাথের গল্পভাষা বেগবান, স্রোতস্বিনী। শান্ত-স্নিগ্ধ শ্রী তে মনোরম তাঁর ভাষা। করুণরসের আধিক্য বেশিরভাগ গল্পেই দেখা যায়। হতে পারে পাঠক আসলে ভেতরে ভেতরে কাঁদতে পছন্দ করে। আমি নিজেও হয়তোবা। রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পের নিজে যে ব্যাখা দিয়ে গিয়েছেন–'শেষ হয়েও হইল না শেষ।' এই ফ্রেমে আবদ্ধ তাঁর অধিকাংশ গল্পই। বা তাঁর গল্পগুলো গ্রামবাংলার প্রাত্যহিক বাস্তবতাকে যেভাবে পরিস্ফুট করেছে তা আমাকে ব্যাপক টানে।রবীন্দ্র ছোটগল্পের পাত্র-পাত্রীরা বেশির ভাগই মানবীয় ধর্মে উদ্ভাসিত। ত্যাগ, তিতিক্ষা, বেদনা, অপ্রাপ্তি বা মনস্তত্ত্ব এত বেশি স্পষ্ট যে সেসবও বারংবার স্পর্শ না করে পারে না। 'নষ্টনীড়ের' চারুবালা যখন পাশের ঘরে ছুটে গিয়ে নিজের বেগবান কান্নাকে দমানোর অপচেষ্টা করে, তা এতটাই মৌলিক যে, আমি যেন চাক্ষুস দেখতে পাই। তাছাড়া তাঁর গল্পে উপমা, তুলনা বা চিত্রকল্পের ব্যবহারে যে সাবলীলতা এখনো কেউ তা তেমন সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।

আমার গল্প তাঁর গল্প দ্বারা প্রভাবিত কিনা জানতে চাইলে বলব- না, একেবারেই না। যদিও আমার বেশিরভাগ গল্পই গ্রাম নির্ভর। রবীন্দ্রগল্পও তাই। আসলে যে জীবন আমি যাপন করি, তা আমি লিখতে অপছন্দ করি। কারণ আমি মনে করি এতে আমার শ্রম কম দেবার আশংকা থাকে। ফলে আমি বেছে নিয়েছি যা আমাকে কষ্ট করে তুলে আনতে হয়। যদিও আমরা চেতন বা অবচেতনে কারো না কারো লেখার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই লিখতে শুরু করি। তবে রবীন্দ্রনাথের গল্প দ্বারা আমার গল্প মোটেও প্রভাবিত নয়। একশ বছরের আগের একজন লেখক দ্বারা আমি প্রভাবিত কেন হবো? আমি অতটা প্রাচীনপন্থী নই, তা সে যত বড় মাপের লেখকই হোক না কেন! আমার গল্প একেবারেই আমার নিজস্ব গল্প। আমার নিজের গল্প। যেমন আমি যদি আমার 'মঙ্গাক্রান্ত আকালুর মাছ সমাচার' গল্প প্রসঙ্গে বলি- গর্ভ হওয়া স্ত্রী ভাত বেশি খাচ্ছে বলে স্বামী আকালু প্রায়ই ভাবছে-অই ফুলে ওঠা পেটে যদি বাম পায়ের গোঁড়ালি দিয়ে জোরে একটা যাতা দেয়া যেতো! অথবা পেটটা যদি ফটাশ করে ফেটে যেত-প্রতিদিন নাগরিক সংগ্রামের সাথে আকালু পেরে উঠছে না। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশ ছোঁয়া দামের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গনজেরা বেগমের ভাত বেশি খাওয়া, এই রূঢ় বাস্তবের বীভৎসতা রবীন্দ্রনাথ হয়তো ভাবতেও পারেন নি। সমাজ যে ভাবে বদলেছে তাতে গর্ভ হওয়া স্ত্রীর বেশি ভাত খাওয়াও স্বামী মেনে নিতে পারছে না। আমাদের নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এটা স্বাভাবিক ঘটনা। অথবা আমি যদি আমার 'শোধ' গল্পের কথা বলি–স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের প্রতিবাদে প্রথম স্ত্রী স্বামীর/সতীনের যৌথ বিছানা পেশাবে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতা তো আমি পেয়েছি বলেই লিখেছি। ফলে আমি প্রতিবাদের ধরন পালটে দিতে পেরেছি। বা 'ছহি বড় সোনাভান' গল্পে–শুধুমাত্র যৌন প্রবৃত্তির জন্য বিবাহিত থাকা। কারো জন্য কারো দায় নেই, পরোয়াও নেই–শুধু স্বামীটির ইচ্ছা হলেই সে আসছে। এবং দিনে দুপুরেই আসছে-কারণ সে নাইটগার্ডের চাকরী করে। রাতে তার আসার সময় নেই। বা অন্য কোনো টানও তাঁর নেই। এরকম অনেক নগ্নতা, প্রকট বাস্তবতা, সংগ্রাম, বিবমিষা, দ্রোহ, ক্ষরণ, বেদনা, অস্থিরতা এ সময়ে ক্রিয়াশীল। আমাদের এই জীবনের যাপন কি রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন? দেখেননি। ফলে এইসব নানান মনস্তত্ত্ব তাঁর গল্পে আসেও নি। তাঁর গল্পে আছে তাঁর সময় বা তাঁর জীবন। বা রবীন্দ্রগল্পের যে শান্ত-স্নিগ্ধ শ্রী, যে পরিমিতি বা স্থিতি তা আমার গল্পে নেই। অথবা তাঁর গল্পে যে মনোরম ভাষাভঙ্গিটি, তাও আমার নেই। আমি তো প্রতিনিয়ত যাচ্ছিই অস্থিরতার ভেতর দিয়ে। নগ্নতা, প্রকট বাস্তবতা, বিবমিষা , দ্রোহ, সংগ্রাম, বেদনা, ক্ষরণের ভেতরে থেকে থেকে একজন লেখক তো এমনি লিখবে।হয়তো তাঁর সময়েও এসব ছিল, কিন্তু তা এমন প্রকট দৃশ্যমানভাবে ছিল না। বা তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এমন অস্থিরভাবে ছিল না। এখন যেমন আমার চারপাশে আছে। ফলে তাঁর মনোজগত ছিল ভিন্ন। এদিকে আমার মনোজগতও ভিন্ন। স্বাভাবিকভাবেই আমার গল্পের বুনন বা কৌশল, জমিন, বার্তা বা চরিত্র–সবই রবীন্দ্রগল্প থেকে আলাদা হবেই।

যদিও রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য রচনাবলীর চাইতে তাঁর গল্পের প্রতিই আমার অধিক প্রেম, অধিক আসক্তি। সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথের গল্পভাণ্ডার আমাকে মুগ্ধ করে। পরিতৃপ্তও করে। তারপরও কম বেশি পক্ষপাত তো থাকেই। সেক্ষেত্রে বলা যায় – নষ্টনীড়, শাস্তি, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, কংকাল, ল্যাবরেটরী, স্ত্রীর পত্র, মধ্যবর্তিনী ইত্যাদি।

মশিউল আলম

(জন্ম: ২৬ নভেম্বর ১৯৬৮)

রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা ছোটগল্পের জন্ম এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে। একশ বছরে যে-কোনও সাহিত্য মাধ্যমে অনেক পরিবর্তন ঘটা স্বাভাবিক। বাংলা ছোটগল্পেও সেটা ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের নিজের গল্পই শুরুর দিকে যেমন ছিল, শেষের দিকে তেমন থাকেনি, বদলে গিয়েছে। তাঁর পরে, বিশেষ করে গত শতকের তিরিশ ও চল্লিশের দশকে প্রচুর গল্প লেখা হয়েছে, সেগুলো আঙ্গিক, কথনভঙ্গি ও বিষয়ের দিক থেকে বিচিত্রমুখী। ষাট দশকের পর থেকে পরিবর্তন আরও বেশি হয়েছে। বাঙালি লেখকরা বিদেশি ছোটগল্পের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সেসবের প্রভাবও পড়েছে। আমার মনে হয়, পরিবর্তন বেশি ঘটেছে ভাষায় ও বর্ণনাভঙ্গিতে।

সহজ সরল ভাষাভঙ্গি রবীন্দ্রনাথের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। উপমার ব্যবহার বেশি, এবং তিনি তা করেছেন খুব দক্ষতার সঙ্গে। কাহিনী বিন্যাসে তিনি প্রধানত একরৈখিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তাঁর উপন্যাসের মতো তাঁর ছোটগল্প বক্তব্য প্রধান নয়, আইডিয়া-নির্ভর নয়।

রবীন্দ্রনাথের নিজের গল্পই শুরুর দিকে যেমন ছিল, শেষের দিকে তেমন থাকেনি, বদলে গিয়েছে।… সহজ সরল ভাষাভঙ্গি রবীন্দ্রনাথের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। উপমার ব্যবহার বেশি, এবং তিনি তা করেছেন খুব দক্ষতার সঙ্গে। কাহিনী বিন্যাসে তিনি প্রধানত একরৈখিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তাঁর উপন্যাসের মতো তাঁর ছোটগল্প বক্তব্যপ্রধান নয়, আইডিয়া-নির্ভর নয়।

রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো যখন প্রথম পড়ি, স্কুলে পড়ার সময়, তখন বেশ নাড়া খেয়েছি। ছুটি গল্পের ফটিকের জন্য কেঁদেছি, কাবুলিওয়ালার জন্য মন খারাপ হয়েছে; খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন গল্পের রাইচরণের দুঃখে দুঃখ পেয়েছি। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথই সেই ছোটগল্পকার, যাঁর অনেকগুলো গল্প অনেক বছর ধরে আমার মনে আছে, অর্থাৎ সেগুলো আমার মনে গভীরভাবে দাগ কেটে আছে দীর্ঘ সময় ধরে। এখনকার গল্পগুলি তো পড়ার পরেই ভুলে যাই, মনে দাগ কাটে না। আমার নিজের লেখালেখির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কোনও প্রভাব পড়েছে কি না ভাবতে গিয়ে এই কথাগুলোই প্রথমে মনে এল। প্রভাব প্রায়শঃ অবচেতন প্রক্রিয়া। আমার গল্প লেখায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব যদি কিছু থেকে থাকে, আমি নিজে তা টের পাই না। আর নিজের গল্প নিয়ে আমি যেহেতু পর্যালোচকের মতো করে ভাবিনি, তাই আমার পক্ষে বলা খুব কঠিন সেগুলোতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আছে কি না। তবে সাধারণভাবে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের মেজাজের সঙ্গে আমার মেজাজের মিল নেই। তিনি চির-আনন্দবাদী, আগাপাশতলা সৌন্দর্যবাদী ও আশাবাদী একজন শিল্পী। আমি হয়তো সেরকম নই, আমার মধ্যে সংশয়বাদ, নৈরাশ্য ইত্যাদি আছে। সেকারণে হয়তো আমার গল্পে অনেক মর্বিডিটি এসেছে। রবীন্দ্রনাথের লেখায় বেশ উইট আছে, রসবোধ অসামান্য ছিল তাঁর। আমার লেখায় এই গুণটার বড্ড অভাব। আমার আগ্রহের বিষয়বস্তুও রবীন্দ্রনাথের থেকে আলাদা। এ ক্ষেত্রে জগদীশ গুপ্ত বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কিছু মিল থেকে থাকতে পারে। কথনশৈলীর দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী সময়ের দেশি ও বিদেশি অনেক লেখকের প্রভাব হয়তো আমার ওপর পড়েছে।

আমার প্রিয় রবীন্দ্রছোটগল্প অনেকগুলো। ছুটি, বলাই, কাবুলিওয়ালা, পোস্টমাস্টার, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, হৈমন্তি, এক রাত্রি…। এমনকি ঘাটের কথাও আমার বেশ প্রিয়। প্রথম জীবনের মুগ্ধতার পেছনে কিন্তু কোনও বিচার-বিশ্লেষণ ছিল না। নবীন পাঠকের কচি মনে যে-অভিঘাত সৃষ্টি হয়েছিল সেটাই প্রধান। তাঁর যেসব গল্প পড়ে আমি আলোড়িত হয়েছিলাম সেগুলো হয়তো তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প নয়।

চঞ্চল আশরাফ

(জন্ম: ১২ জানুয়ারি ১৯৬৯)

রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ছোটগল্পের পরিবর্তন হয়েছে অনেকখানি। বিশেষত বিষয়ের দিক থেকে, আঙ্গিকের দিক থেকে এবং ভাষার দিক থেকে। সব দিক থেইে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের পরে বাংলা ছোটগল্পের পরিবর্তন ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের যে প্রকরণ বা ভাষাশৈলী ছিল সেইটা থেকে বাংলা ছোটগল্প অনেকখানি এগিয়েছে। আজকে কেউ রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পকে সামনে রেখে গল্প লিখতে বসেন না বা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়ে সেই গল্প পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে কেউ রসদ সংগ্রহ করেন বলে আমার মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথের গল্প এখন, মানে ইতিহাসগত কারণেই এর এখন একটা গুরুত্ব আছে কিন্তু আমি বলব যে প্রকরণ বৈশিষ্ট্য বা ভাষাগত কারণে এর গুরুত্ব এখন আগের চেয়ে অনেকখানি কম।

কিন্তু তাই বলে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের যে ঐশ্বর্য তাতে কোন ভাটা পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ যখন ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন তখন সারা পৃথিবীতে তিন চারটা ভাষার বাইরে আর ছোটগল্প লিখিত হত না। সেই অর্থে ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের অবদান বিপুল। তা সত্ত্বেও সাহিত্যের যে গতিশীলতা, ছোটগল্পের সে গতিশীলতা সেটার একটা নিজস্ব ধর্ম আছে। সেটা এক জায়গায় স্থির থাকে না, কালে কালে দিক বদলায় এবং এই বদলানো থেকেই বৈচিত্রের সৃষ্টি হয় এবং সেই বৈচিত্রই সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথের পরে যারা গল্প লিখেছেন বিশেষত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দ্বীপন চট্টোপাধ্যায়, তারপর দেবেশ রায় পর্যন্ত যদি আমরা ধরি, এমনকি হাসান আজিজুল হক বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকেও যদি আমরা ধরি তাহলে দেখব যে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ছোটগল্প অনেক অনেক দূর এগিয়েছে। আর সেই আগমনটা খুবই সদর্থক।

ইতিহাসগত কারণেই এর এখন একটা গুরুত্ব আছে কিন্তু আমি বলব যে প্রকরণ বৈশিষ্ট্য বা ভাষাগত কারণে এর গুরুত্ব এখন আগের চেয়ে অনেকখানি কম।… রবীন্দ্রনাথের পরে যারা গল্প লিখেছেন বিশেষত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দ্বীপন চট্টোপাধ্যায়, তারপর দেবেশ রায় পর্যন্ত যদি আমরা ধরি, এমনকি হাসান আজিজুল হক বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকেও যদি আমরা ধরি তাহলে দেখব যে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ছোটগল্প অনেক অনেক দূর এগিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মাঝে প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে যে সম্পর্ক এবং মানুষ প্রকৃতির যে একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ সেই জিনিসটা এত বেশি এসেছে যা আর কোন বাংলা ছোটগল্পে এত বেশি দেখা যায় না। এটা তাঁর গল্পের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। আরেকটা হল রবীন্দ্রনাথ তার ছোটগল্পে অনেক বড় ঘটনা খুব সহজেই বর্ণনা করতে পারতেন। যেমন মৃত্যুর মত একটা বড় ও বেদনাদায়ক ঘটনা রবীন্দ্রনাথ কিন্তু খুব সহজে এবং পরিমিতভাবে বর্ণনা করে গেছেন। তার চরিত্রগুলোর মাঝেও অনেক বৈচিত্র আছে। একেবারে কেরানী থেকে শুরু করে ডাক্তার, অধ্যাপক পর্যন্ত সব রকমের চরিত্রই তাঁর গল্পের মধ্যে আছে। তাঁর চরিত্রগুলো ˆবৈচিত্র্যময় এবং চরিত্রগুলো প্রকাশের মধ্যেও তার অনেক বৈচিত্র্য আছে। তার ঘটনার বিন্যাসে একটা বিশেষ দক্ষতা ও ডিসিপ্লিন বা প্রপোরসনের বিষয়গুলো আছে। এই বিষয়গুলোই তাঁর ছোটগল্পের বিশেষ দিক বলে আমি মনে করি।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের যে ধারা বা যে প্রকৃতি এবং এখনকার ছোটগল্পের যে ধারা বা প্রকৃতি তা একটু আলাদা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এখনকার যে জীবনধারা, এখনকার জীবনের যে জটিলতা সেগুলো তো বিশ শতকের প্রথমার্ধের থেকে একেবারেই আলাদা। মৌলিক বিষয়গুলো যেমন প্রেম, ঘৃণা বা একাকিত্ব এই বিষয়গুলোতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। যদিও মূল বিষয়গুলো এখনও একরকমই আছে কিন্তু পারস্পরিক আচরণের ধরনগুলো পাল্টে গেছে। সেই দিক থেকেও বলতে পারি শুধু আমি কেন আর কেউ যদি গল্প লেখেন এবং যদি একই বিষয় নিয়েও লেখেন তবুও সেটার চেহারাটা ভিন্ন হতে বাধ্য। যদি বাধ্য না হয় তাহলে বুঝে নিতে হবে যে তাঁর মধ্যে সমকালীনকে ধারন করা এবং তাকে ধাতস্থ করে অতিক্রম করার যে স্বাধীনতা, সেটার অভাব আছে। আর আমার ছোটগল্পের বিষয়ে আমি বলতে পারি যে আমার গল্প রবীন্দ্রনাথ থেকে আলাদা তো বটেই এবং বিষয় ও উপস্থাপনার দিক থেকেও একেবারে স্বতন্ত্র। আমি আমার লেখার ব্যাপারে নিরীক্ষাধর্মী এবং বিষয় নির্বাচনেও আধুনিক। মানুষের দৈনন্দিন জটিলতার যে টার্মগুলো আমার গল্পের বিষয় সেগুলো রবীন্দ্রনাথের ছিল না এবং থাকাটা সম্ভবও ছিল না। কারণ, আধুনিক মানব জীবনের একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা বা বিচ্ছিন্নতাবোধ–এটাই কিন্তু আমার গল্পের মূল বিষয়। আমার চরিত্রগুলোর যে বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং তার সে নিজস্ব একটা অবস্থা, সেখানে তার একটা ক্ষয় আছে, পতন আছে, সে পতন থেকে উত্তরণের আকাংখা আছে, সে আকাঙ্খা মেটাবার সংগ্রাম আছে, এ বিষয়গুলো আমার গল্পে স্থান পেয়েছে। এগুলো আমার মনে হয় না যে রবীন্দ্রনাথের গল্পে এভাবে ছিল। আর আমার ভাষাও তার থেকে আলাদা। আমি মনে করি যে বিষয়-আশয় নিয়ে আমি কাজ করেছি, যে কাল বা যে ব্যক্তি বা যে সমাজকে আমি ধারন করেছি সেটা যেহেতু রবীন্দ্রনাথের ছিল না, ফলে আমার গল্পগুলোও তার মত নয়।

রবীন্দ্রনাথের অনেক ছোটগল্প আছে যেগুলো আমার প্রিয়। তবে চট্ করে আমার মনে আসছে 'মধ্যবর্তিনী' গল্পটির কথা। তারপরে 'শাস্তি' গল্পটিও আমার প্রিয়। এছাড়া 'নষ্টনীড় ' গল্পটাও আমার আরেকটি প্রিয় গল্প।

সুমন রহমান

(জন্ম: ০৩ জানুয়ারি ১৯৭০)

আমাদের দেশে অধিকাংশ ছোটগল্প মূলত সোশ্যাল রিয়েলিজমের ওপর লেখা হয়েছে এবং এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ, শেখভ, মোঁপাসা—এরা একেকজন একেকটা চূড়া স্পর্শ করেছেন পৃথিবীতে। তো আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথও তাই। পরে যাঁরা এসেছেন, আমরা যদি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর থেকে শুরু করে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—এদের কথা বলি, তারা বেসিক্যালি সেই ধারাটিকে ফারদার ন্যারিশ করে যাচ্ছেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটা লেখা আছে যে, 'বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে?' উনি আসলে যে বিষয়টাকে ঈঙ্গিত করেছেন সেটা হচ্ছে যে আসলে ছোটগল্প বলতে আমরা যে ফরম্যাটটাকে বুঝি বা যে ফরম্যাটটাকে দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করা হচ্ছে তাতে আর রহস্য বলে কিছু নাই। এটা প্রকাশিত; অর্থাৎ ছোটগল্প হচ্ছে এখন খুবই প্রকাশিত একটা ফরম্যাট, যে ফরম্যাটে একটা জিনিস ফেলে দিলে তা গল্প হয়ে বেরিয়ে আসে এবং এই প্র্যাকটিসটা আমরা দীর্ঘদিন আমাদের এখানে দেখেছিও। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ওই যে আশংকাটা—ছোটগল্প কি সত্যিই মরে যাচ্ছে, এর প্রমাণ আসলে আমরা পাই আমাদের পরবর্তীকালের ছোটগল্পে। কিন্তু তারপরে বিশ্বসাহিত্যে নান্দনিক চিন্তাভাবনা বোধের কিছু পরিবর্তন ঘটে। এর একটা হচ্ছে ম্যাজিক রিয়েলিজম। ম্যাজিক রিয়েলিজমের প্রভাব আমরা বাংলা ছোটগল্পে পাই শহীদুল জহিরের কিছু গল্পে। আবার অনেকেই আছেন যাঁরা শেখভিয়ান হিউমারকে আশ্রয় করে গল্প লিখেছেন এবং কিছু নতুন ফ্লেভার দেয়ার চেষ্টা করেছেন। যেমন শাহাদুজ্জামানের প্রথম দিককার কিছু গল্প। এরা আসলে বাংলা ছোটগল্পকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু আমাদের জন্যে নতুন যে গল্পের একটা ফর্ম তৈরি করা, সেটা আসলে এযাবৎকাল তেমন সুনির্দিষ্ট সুস্পষ্টভাবে কেউ করতে পারেননি। এ জায়গাটায় এখনো আমাদের অনেক কাজ বাকি আছে। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাদের চেষ্টাগুলো আমার মনে হয় আরও সময় গেলে আমরা বুঝতে পারব—যে, এটা আসলে কোন দিকে যাবে। রবীন্দ্র-উত্তর ছোটগল্পে আসলে আমরা এরকম একটি দশার মধ্যে আছি যে, আমরা রবীন্দ্রনাথের সোশ্যাল রিয়েলিজমকে উৎরাতে পারিনি আবার পরবর্তীকালে মার্ক্সিজম প্রভাবিত ছোটগল্প বাহিত সমাজবাস্তবতার বিশ্লেষণের ধারা, যেটাতে একসময় মানিক, তারাশংকর এরা একটা পিক স্পর্শ করেছেন, আমাদের বর্তমান কালের গল্প সেই চূড়ারও বাইরে যেতে পারেনি। ফলে আমার মনে হয় যে, এটা সম্পূর্ণই ফর্মের একটা ক্রাইসিস্, যে ক্রাইসিসটা আমরা এখন ফেইস করছি। তো সে জায়গাতে এখনো আমাদের অনেক হোমওয়ার্ক বাকি আছে এবং সেটা আমাদেরকে করতে হবে।

রবীন্দ্র-উত্তর ছোটগল্পে আসলে আমরা এরকম একটি দশার মধ্যে আছি যে, আমরা রবীন্দ্রনাথের সোশ্যাল রিয়েলিজমকে উৎরাতে পারিনি আবার পরবর্তীকালে মার্ক্সিজম প্রভাবিত ছোটগল্প বাহিত সমাজবাস্তবতার বিশ্লেষণের ধারা, যেটাতে একসময় মানিক, তারাশংকর এরা একটা পিক স্পর্শ করেছেন, আমাদের বর্তমান কালের গল্প সেই চূড়ারও বাইরে যেতে পারেনি। ফলে আমার মনে হয় যে, এটা সম্পূর্ণই ফর্মের একটা ক্রাইসিস্, যে ক্রাইসিসটা আমরা এখন ফেইস করছি।

রবীন্দ্র-উত্তর ছোটগল্পের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য যেটা আমার মনে হয়–উনার ছোটগল্প খুব ডিফাইনড। মানে ছোটগল্প কাকে বলে—রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিজেই এটার একটা প্রমাণ যে ছোটগল্প হচ্ছে এরকম। একদম আদর্শ একটা ফরম্যাটের মধ্যে উনি গল্প লিখেছেন। কাজটা তার সমসাময়িক বা একটু সিনিয়র যাঁরা বিশ্বসাহিত্যে শেখভ বা মোঁপাসা তারাও এটা করেছেন যে ছোটগল্প বলে ফর্মটাকে তারা স্ট্যাবলিশ করেছেন। এর আগে আসলে ওই ফর্ম ছিল না। ন্যারেটিভকে ভেঙে, ব্যালাড ফর্মকে ভেঙে ছোটগল্পের যে গদ্য ফর্ম অর্থাৎ আঁটোসাঁটো একটা গদ্য ফর্ম তৈরি করা, সেটা রবীন্দ্রনাথ করেছেন। আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সোশ্যাল রিয়েলিজমের প্র্যাকটিসটা ছিল। উনি ছিলেন সোশ্যাল রিয়েলিস্টিক, ফলে সোসাইটি এবং পারিবারিক যে বাস্তবতা, সে বাস্তবতা এবং মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার নানারকম নিদর্শন আমরা তার গল্পে পাই। আরেকটা বিষয় হচ্ছে কাব্যিকতা। তাঁর অনেক গল্প আছে খুব কাব্যিক। আবার একেবারেই কাব্যিকতা নেই, এরকম গল্পও তাঁর আছে। আসলে রবীন্দ্রনাথের গল্প কোনো একটা বিষয় টাচ্ করে নাই, এরকম দিক খুব কম আছে। ওই অর্থে রবীন্দ্রনাথ ডেফিনিটলি আমাদের জন্য তো বটেই, বিশ্বসাহিত্যেও ছোটগল্পের জন্য একটা আদর্শ উদাহরণ।

ছোটগল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে কাব্যিক সংজ্ঞা আছে, 'শেষ হইয়াও হইল না শেষ', 'ছোট প্রাণ ছোট কথা'—আমরা সাধারণত এই সংজ্ঞাটাকে ধ্রুব জ্ঞান করেই ছোটগল্প লিখে থাকি। তো আমি আসলে এই সংজ্ঞার বাইরে অবস্থান করছি বলে আমার ধারণা। এটা যে আমি ইচ্ছা করে যাচ্ছি, তা না। আসলে গল্প লিখতে গিয়ে আমি দেখলাম যে আমি আর এই সংজ্ঞার ভেতরে থাকতে পারছি না। তখন আমি আমার গল্প নিয়ে নিজেই ভাবতে শুরু করলাম—যে, আমি কেন ওভাবে গল্প লিখছি। আমি দেখেছি আমার গল্পে আসলে ভিন্ন ভিন্ন দুটা ন্যারেটিভ থাকে। একটা ন্যারেটিভ থাকে–যেটা প্রকাশ্যে গল্পটা বলে, আর আরেকটা ন্যারেটিভ থাকে ওটার আন্ডারনিথ। দুইটা ন্যারেটিভকে আমি প্যারালাল রান করাই বা করতে দেখতে পছন্দ করি এবং দুটা ন্যারেটিভের একটা দ্বন্দ্ব আমার টোটাল গল্পের মধ্যে থাকে। দুটা ন্যারেটিভ কখনো তারা একই কথা বলে আবার কখনো দু'টা ভিন্ন কথা বলে। এরকম একটা বিষয় আমার গল্পের মধ্যে থাকে যেটা আমি আসলে আমার পড়া অন্য কোনো গল্পের মাঝে পাই নি। সেটা শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, তার পরবর্তী বাংলা ছোটগল্পেও এমনকি বাইরের যেসব গল্প আমি পড়েছি সেগুলার মাঝেও আমি খুব রেয়ারলি এরকম ধারা দেখেছি। তো এটা যে আমি খুব কনশাসলি করেছি তা আসলে নয়। আর রবীন্দ্র ছোটগল্পের ব্যাপারে আমি বলব যে আমি রবীন্দ্র ছোটগল্প পড়েছি, তাঁর গল্প অনেক পছন্দও করেছি; কিন্তু ছোটগল্প লেখক হিসেবে যখন আমি ছোটগল্প লিখতে বসি তখন ঠিক রবীন্দ্রনাথ আমার মাথায় থাকে না বা আমি তাঁর কথা ভাবি না। কিন্তু অবশ্যই তাকে আমি অনেক বড় গল্পকার বলে মনে করি। তাই আমার ধারণা আমি আসলে তার দ্বারা প্রভাবিত নই।

তাঁর একটা গল্প আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। গল্পটার নাম 'শাস্তি'। এই গল্পটা তাঁর অত্যন্ত ব্যতিক্রমী একটি গল্প। একান্ত নিম্নবর্গের জীবনের একটা ভয়াবহ চিত্র তিনি এখানে তুলে ধরেছেন এবং এত নিপুণভাবে তিনি এটা তুলে ধরেছেন যে তাতে এটা মনেই হয় না যে তিনি ওই শ্রেণীতে নাই; তিনি যে অন্য একটি শ্রেণীর লোক, সেটা মনেই হয় না। যে শ্রেণীতে তিনি কোনোদিনও অধিষ্ঠান করেননি, যে শ্রেণীটি আসলে তাঁর পক্ষে জানালা দিয়ে দেখাও বেশ দুরূহ, সেই শ্রেণীর একটা আলেখ্য এই গল্পে চলে এসেছে এবং এত গভীরভাবে, এত নিবিড়ভাবে এসেছে যে এতে বিস্মিত হতে হয়। এইখানেই হল প্রকৃত সাহিত্যিকের আসল সিদ্ধি।

অদিতি ফাল্গুনী

(জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪)

রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা ছোটগল্প অবশ্যই অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'প্রাগৈতিহাসিক,' বিভূতি ভূষণের 'পুঁইমাচা,' প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'তেলেনাপোতা আবিষ্কার,' অমিয়ভূষণের 'সাইমিয়া ক্যাসিয়া,' হাসান আজিজুল হকের 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ,' 'শকুন' বা 'পাতালে হাসপাতাল' কিম্বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'খোঁয়ারি' বা 'মিলির হাতে স্টেনগান' নাম্নী গল্পগুলোয় বাংলা ছোটগল্পের অনেক পরিবর্তন বা বাঁকবদল আমরা দেখতে পাই। তবে, এখানে একটি ছোট্ট 'কিন্তু' থেকে যায়। বিজ্ঞানীরা যেমন বলেন যে মানুষ তার পিতা-মাতা থেকে কিছুটা আলাদা চেহারা নিয়ে জন্মায় আবার পিতা-মাতার কিছু ছাঁচ বা আদলও থেকে যায়… এভাবে যতই প্রজন্ম যায়, ততই চেহারা আলাদা হয়… কিন্তু, তৃতীয় বা ষষ্ঠ পুরুষে এসে দেখা গেল তিন বা ছয় পুরুষ আগের কোনো পূর্বপুরুষ বা পূর্বনারীর হুবহু চেহারা পেয়েছে সেই উত্তর পুরুষ বা উত্তর নারী। বংশগতি বিদ্যা বা ডিএনএর এ এক মজার খেলা। সাহিত্যেও এমন বংশগতি বিদ্যা বা ডিএনএ রয়েছে। কাজেই, যতই আমরা সামনে অগ্রসর হই না কেন, হাজার বছর আগের চর্যাপদ, মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, বঙ্কিম-শরৎ-রবীন্দ্রনাথ, 'তিন বন্দ্যোপাধ্যায়,' 'দুই মজুমদার (কমল ও অমিয়)', এপার আর ওপার মিলিয়ে কয়েকজন 'সৈয়দ (ওয়ালীউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক,সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ)'… এই সবার প্রভাবই ছয় প্রজন্ম পরেও আমাদের লেখায় থেকে যাবে। এলিয়ট যখন লেখেন 'April is the cruellest month, breeding/ Lilacs out of the dead land…' হয়তো এই চরণে সুদূরতম অপ্রত্যক্ষতায় হলেও ধ্বনিত রয়েছে মধ্যযুগের চসারের 'Whan that aprill with his shoures soote/ The droghte of march hath perced to the roote…' কণ্ঠস্বর। ওসিপ মেন্দেলস্তামের কবিতা পুশকিনের থেকে অনেক আলাদা হলেও পুশকিনের কিছু ছাঁচ কিন্তু থেকে যাবে। কবিতায় তাই পূর্ববর্তীদের অনেক শব্দ আমরা ফেলে দিই, অনেক শব্দ ফেলে না দিয়ে নতুন অর্থে ব্যবহার করি। গল্পেও তাই। সাহিত্যে আসলে এভাবে 'বাইনারি অপোজিট' করে কিছু বলা যায় না।

পূর্ব বাংলার শিলাইদহের গ্রামাঞ্চলে দশ বছর জীবন যাপনের ফলে গ্রামীণ জীবনের এমন অভিজ্ঞতা 'জমিদার' রবীন্দ্রনাথের ছিল যা পরবর্তীকালে মানিক-হাসান-ইলিয়াস সহ বাংলা সাহিত্যের তাবৎ 'বামপন্থী' কিন্তু 'নাগরিক' লেখকদের নেই (পরবর্তী এই সব লেখকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি), কাজেই 'শাস্তি' গল্পের চন্দরার স্বামী বা দিনমজুর ছিদামের মত চরিত্র হাজার মার্ক্সবাদ পড়েও অধুনা আমরা যারা 'মার্ক্সবাদী' লেখক হবার কথা ভাবি-টাবি… আমরা পারি না! আমাদের অভিজ্ঞতা বা জীবন যাপনের দৌড় ত' শেষমেশ ঢাকায় শাহবাগ আজিজ মার্কেট বা কলকাতার লেখকদের ক্ষেত্রে হয়তো কফিহাউস।

প্রথমত অসম্ভব সুন্দর অথচ সহজ ভাষাশৈলী, দ্বিতীয়ত পূর্ব বাংলার শিলাইদহের গ্রামাঞ্চলে দশ বছর জীবন যাপনের ফলে গ্রামীণ জীবনের এমন অভিজ্ঞতা 'জমিদার' রবীন্দ্রনাথের ছিল যা পরবর্তীকালে মানিক-হাসান-ইলিয়াস সহ বাংলা সাহিত্যের তাবৎ 'বামপন্থী' কিন্তু 'নাগরিক' লেখকদের নেই (পরবর্তী এই সব লেখকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি), কাজেই 'শাস্তি' গল্পের চন্দরার স্বামী বা দিনমজুর ছিদামের মত চরিত্র হাজার মার্ক্সবাদ পড়েও অধুনা আমরা যারা 'মার্ক্সবাদী' লেখক হবার কথা ভাবি-টাবি… আমরা পারি না! আমাদের অভিজ্ঞতা বা জীবন যাপনের দৌড় ত' শেষমেশ ঢাকায় শাহবাগ আজিজ মার্কেট বা কলকাতার লেখকদের ক্ষেত্রে হয়তো কফিহাউস। তৃতীয়ত পূর্ব বাংলার সেই সময়কার বিস্তৃত নিসর্গের সাথে গল্পকার রবীন্দ্রনাথের গড়ে ওঠা এক নিবিড় আধ্যাত্মিকতা যা তাঁর গল্পকে একেবারেই ভিন্ন ব্যঞ্জনা দান করেছে তাঁর পূর্ব ও পরবর্তী বাংলা ভাষার অন্য সব গল্পকারদের থেকে। চতুর্থত অসম্ভব কৌতুক ও রসবোধ। পঞ্চমত: 'বার্ডস আই ভিউ' থেকে মানব-মানবীর আন্তঃসম্পর্ক ও চরিত্রগুলোর জটিলতা এবং দ্বন্দ্বের মূল্যায়ন।

আসলে সময়, বেড়ে ওঠার পরিবেশ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের অবিভক্ত বাংলা ও ১৯৭১ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ), লৈঙ্গিক ভিন্নতা… নানা কারণেই আমি তো আর রবীন্দ্রনাথের মতো গল্প লিখতে পারব না। চাইলেও তেমন হবে না। কিন্তু, বড় লেখকদের বা নিজ ভাষায় (সম্ভব হলে ভিন্ন ভাষারও) ধ্রুপদী সাহিত্য পাঠের একটা বড় সুবিধা হলো টেবিলে বসে যখন আপনি মাঝে মাঝে আটকে যাবেন… তখন হঠাৎ তাদের একটি লাইন বা ঠিক নির্দিষ্ট কোন লাইনও নয়… ধ্রুপদী লেখকদের ভাষাশৈলী… তাদের লেখায় বর্ণিত মেঘ, রৌদ্র, নদী বা গাছপালার বর্ণনার ব্যঞ্জনাই আবার আপনার কলমকে সচল করতে সাহায্য করবে। আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এক্ষত্রে বলি। ২০০২-এর ঈদ সংখ্যা 'প্রথম আলো'য় গল্প চাওয়া হয়েছে। মাঝে মাঝেই ফোন আসে, 'কী অবস্থা? লেখা কতদূর?' আমার এই গল্পের নায়িকা হলেন টানবাজার পতিতা পল্লীর এক মুসলিম পতিতা। শৈশবে যে ছিল পর্দানশীন ও ধর্মভীরু। ইসলামী শাস্ত্রমতে 'শব-ই-বরাত'-এর রাত বা পবিত্রতম রজনী বা সৌভাগ্যের রজনীতে জন্ম বলে তার নাম রাখা হয়েছিল শাবানা। তবে, পতিতা পল্লীর একটি রিচ্যুয়াল হলো শবেবরাতের রাতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী পতিতারা কেউ কোনো খদ্দের গ্রহণ করে না ও গোটা পল্লী ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে। তো গল্পটা লিখতে গিয়ে একটা জায়গায় কলম আটকে আছে দু'দিন। হঠাৎই গল্পগুচ্ছ-এর পাতায় পাতায় রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় যেমন পড়া যায় যে 'গাছের পাতায় চঞ্চল রৌদ্র ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে' ইত্যাদি ইত্যাদি… আমি লিখলাম যে টানবাজারের প্রতিটা ঘরের জানালায় সকালের রোদ ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এরপর আবার ফ্লো চলে এলো। টেরি ঈগলটন একেই বলেন যে তরুণ লেখকরা যখন আটকে যায়, কাঁধের ওপর দেবদূতের মতো পূর্বসুরী লেখকেরা থাকেন। তাঁরাই হাত বাড়িয়ে কাদায় আটকে যাওয়া তরুণ লেখকের গাড়িকে আবার সচল করেন। গল্পগুচ্ছ পড়ার অভিজ্ঞতা না থাকলে সেবার আমি ঐ গল্পটা সত্যিই শেষ করতে পারতাম না! ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক বা অমিয় ভূষণ এমন সাহায্য কতবার করেছেন! সবটা বলবো না বা স্বীকার করবো না… হা হা–বুদ্ধিমান পাঠক পড়লেই বুঝে নেবেন।

গোটা গল্পগুচ্ছই আমার অনেক প্রিয়। আমার শৈশব কৈশোরে আমি সব মিলিয়ে পঞ্চাশ ষাটবারের মতো গোটা বইটা পড়েছি। রবীন্দ্র ও সুকুমার সাহিত্য পড়া থাকলে যে কোন তরুণ ভালো বাংলা লিখতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের সমসাময়িক বা সতীর্থ অনেক লেখকের লেখা পড়েই আমি চোখ বুঁজে বলে দিতে পারি কে বা কারা শৈশবে রবীন্দ্রনাথ ভাল ভাবে পড়েছেন আর কারা পড়েন নি। যারা পড়েছেন তাদের জন্য দৌড়টা সবসময়ই সহজতর হবে।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে আর্টস-এর আরো লেখা
ব্রুকলিনে রবীন্দ্রনাথ / এস এম রেজাউল করিম
ফ্রান্সে রবীন্দ্রনাথ / এস এম রেজাউল করিম
রবীন্দ্রনাথের অমূল্য রচনা সম্বন্ধে আমাদের উপলব্ধি / খোসে পাজ্ রড্রিগেজ
আলাপচারিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | এইচ. এন. ব্রেইলসফোর্ডের সঙ্গে
/ অনুবাদ: সাহানা মৌসুমী

রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে এ সময়ের গল্পকাররা / প্রমা সঞ্চিতা অত্রি
রক্তমাংসের রবীন্দ্রনাথ / রাজু আলাউদ্দিন
তুলনাহীন রবীন্দ্রনাথ / কবীর চৌধুরী
বঙ্কিমচন্দ্র–রবীন্দ্রনাথ ধর্মতর্ক
'পারস্যে': মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা / অদিতি ফাল্গুনী
গণশিক্ষায় কেসস্টাডি: 'হৈমন্তি'র অপুরুষ বনাম 'সমাপ্তি'র পুরুষ / এস এম রেজাউল করিম
উত্তরাধুনিকের চোখে রবীন্দ্রনাথ (সেমিনার) / আজিজ হাসান
(আমার) রবিভাব… ভাব ও অভাব / মানস চৌধুরী
একজন তৃতীয় সারির কবি": রবীন্দ্রকবিতার বোর্হেসকৃত মূল্যায়ন / রাজু আলাউদ্দিন
রবি সান্নিধ্যে / মার্গারিট উইলকিনসন (অনুবাদ: প্রিসিলা রাজ)
অশেষ রবীন্দ্র প্রীতি / সাইমন জাকারিয়া
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে ও গদ্যে মুসলমানের কথা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা / সাদ কামালী
ভাঙা গড়ার রবীন্দ্রনাথ: প্রাচ্যনাট-এর 'রাজা …এবং অন্যান্য' / ব্রাত্য রাইসু

—–

লেখকের আর্টস প্রোফাইল: প্রমা সঞ্চিতা অত্রি
ইমেইল: pshanchita@gmail.com


ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts