মহেশখালীর পথে

সৌমেন গুহ
Published : 19 Oct 2017, 04:41 PM
Updated : 19 Oct 2017, 04:41 PM

সারা জীবন আমি ক্ষ্যামাপি করেই গিয়েছি। ঘরের প্রতি টান একটু কম। অবশ্য এজন্য বাইরের সৌন্দর্য কম দায়ী নয়! যত দোষ রূপবতী বাংলাদেশেরই! এ মায়ার টান অগ্রাহ্য করতে পারি না আমি। তাই ছুটি পেলেই ছুটে চলি কখনো পাহাড়ে, কখনো নদী তীরে, কখনো বা সাগরপাড়ে। এবার যাচ্ছি বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী।

কোরবানি ঈদের কয়েকদিন আগে। রাস্তাঘাটে ঘরফেরা মানুষজনের বিশাল লাইন। গাড়ি পাওয়া মুশকিল। রাস্তায় কিছুক্ষণ পরপর-"বিশাল গরু ছাগলের হাট।" আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, বীরপুরুষ! সব বাঁধা পেরিয়ে হলেও যাব। প্রথমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলে এলাম। এরপর ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেতে হয় মহেশখালী।

দুটো পথ খোলা যাওয়ার জন্যে- চকোরিয়া থেকে পেকুয়া হয়ে বাকখালী ব্রিজ পেরিয়ে  সোজা গাড়ি দিয়ে পৌঁছা যায়। আবার কক্সবাজার থেকে সোজা স্পিডবোটে মহেশখালী আসা যায়। দ্বীপে যাচ্ছি জাহাজে চড়বো না তাতো হতে পারে না! কিন্তু এবার ভাবলাম সাগরের বুক চিড়ে কত বার গিয়েছি এবার না হয় রাস্তা দিয়ে যাই।

কেরানিহাট থেকে চকরিয়ার কোনো গাড়ি পাওয়া গেলো না। কক্সবাজারের গাড়িগুলো কপাটবন্ধ করে রেখেছে- কারণ ঈদের সময় ছোটখাটো মানুষজন নেবে না। মহামুশকিল তো! তবুও জয় মা বলে উঠে পড়লাম আমিরাবাদের টেম্পুতে। মহাসড়কে থ্রি হুইলার চলে না। আজকাল তাই চার চাকার টেম্পুই চলে বেশ  বীরবিক্রমে । ওখান থেকে আবার আরেকটা টেম্পুতে করে চকরিয়া এলাম। চকরিয়ায় এসে মহেশখালী সোজা যাওয়া তো যাবে না। প্রথমে যেতে হবে বদরখালী। বদরখালী পর্যন্ত কিন্তু বাস আছে চকরিয়া থেকে । আমাদের কপালে তাও জুটলো না। এরমধ্যে আমার নাকের কাছে পানের বরজের মৌ মৌ গন্ধ চলে আসছে। নোনা হাওয়ার ঝাপটা তো আছে। আর বর্ষাকাল যা ভাবলাম তাই হলো- বৃষ্টি পড়ছে। তাও মুষলধারে। যাব যেহেতু বলেছি যাব!

সিএনজিওয়ালাদের স্ট্যান্ডে এলাম। এখালে ভুলেও এই খালি ডাক পারবেন না। বুঝে যাবে ঢাকা থেকে এসেছেন আর পকেটের উপর শ্রাদ্ধ হবে নিশ্চিত থাকুন। আমি বললাম, বদরখালী যাইবা না বদ্দা? চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। এর মানে, বদরখালী যাবেন বড় ভাই?

সিএনজিওয়ালা, 'বদ্দা জড় ফড়ের! ন যাইয়্যুম। আরেগগুয়া চ।' এর মানে হল, বৃষ্টি পড়ছে তাই সে যাবে না, অন্য কোথাও যেতে হবে। আমি ব্যাক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল মানুষ তবুও মনে মনে গালি না দিয়ে পারলাম না- যাও বৌয়ের শড়ির আঁচলে লুকিয়ে থাকো। আহা ! শোনেনি! এখানকার মানুষ কিন্তু ডেঞ্জারাস-দা বটি নিয়ে ঘুরে। একটু বাড়িয়ে বলেছি নাকি?

পরে কোনোমতে একটা সিএনজি নিলাম। বৃষ্টিতে কাকভেজা। তাও সিএনজিএর পর্দা টানলাম না। রাস্তাটা চলছে- অনেকগুলো মাছের ঘেরের মধ্যে। কোনো খানে লবণখেত। আবার মাছের ঘের। একটা ছোট্ট নৌকা বাঁধা। আবার পানির মাঝখানে ছোট্ট একটা মাচা-ওখানে পাহারাদার পলোয়ানের বাস। আমার মতো মৎস্যভুক বাঙ্গালির স্বর্গ এটা। কিছু দূর যাওয়ার পর মনে হবে- পানি মাঝখানে একটা নিঃসংগ রাস্তা চলে গেছে। আমি মানব একা ভ্রমিছি বিস্ময়ে। দুদিকে কেবল পানি। বর্ষাকাল বলে পানি রাস্তার ধার ছুয়ে ছুঁয়ে কখনোবা রাস্তাটা মুছে দিয়েছে দৃশ্যপট থেকে।

এই অপার্থিব ভ্রমণের পর এলাম বদরখালী। ওখান থেকে কষ্ট করে আবার সিএনজি নিলাম। মহেশখালী সদর গোরখঘাটা যাব।গোরকঘাটা যাওয়ার জন্যে ককবাজার থেকে সোজা স্পীডবোটে এলে এতো ঝামেলা হতো না ।কিন্তু কত কি অদেখা থেকে যেত।

সিএনজি বাকখালী নদী পার হয়ে কর্ণফুলীর সাম্পানওয়ালাদের ফাইনাল ডেস্টিনেশান- মহেশখালী পৌঁছালো। কিন্তু দীর্ঘ পথ বাকি। প্রায় দু ঘণ্টার মতো। আর রাস্তা তো নয় যেনো খানাখন্ড খুঁড়ে কলম্বাসের চেয়ে বড় এডভেঞ্চার করছি। মহেশখালীর ছোট ছোট পাহাড় দু'পাশে। কিছুক্ষণ পরপর জন বসতি। আবার দুর্গম, নির্জন পথ। গা ছমছম করবে। পাশে তাকালে দেখবেন-প্রথমে ছনের বন। তারপর বন খেকোদের হাত থেকে বেছে যাওয়া কিছু ছোটখাট পাহাড়ি গাছ। এরপর আরেকটু ঘন জংগল।

মাঝেমাঝে দেখবেন বড় বড় দা হাতে, পিঠে কাঠবোঝায় কাঠুরিয়ারা বন থেকে ফিরিছে। আর লাগামহীন গরুর পাল রাস্তা পার হচ্ছে। রাস্তার একপাশে হাঁটবে না ! এই রাস্তায় মানুষের তৈরি নিয়মকানুন তাদের জন্য প্রযোজ্য না। তাদের সংসদ প্রত্যাখান করেছে। তাই ঢিমেতালে গাড়ি চলছে। আর এদিকে আবার ভেড়ার পাল ছুটে আসছে ধানের খেতের আইল বেয়ে। বাংলাদেশের চরাঞ্চল আর দ্বীপাঞ্চল দেশিভেড়ার চারণভূমি। আমার কাছে মনে হচ্ছে-কি দরকার জীবনের মূল্যবান সময়গুলো ঢাকার খুপড়িগুলোতে কাটিয়ে দেবার? কোনো মেয়ে যদি রাজি থাকে এক্ষুণি বনের মাঝে সংসার পাতবো। দুমুঠো যোগাড় তো হবেই। আতঙ্কে রাত কাটাবো-বুনো হাতি এসে নাহয় আমার ঘরখানা তছনছ করে দিয়ে যাবে। বৌ আমার দুশ্চিন্ত। আমি দা হাতে বনে ছুটবো-ছন কাঠ দিয়ে আবার বানাবো আমাদের বাংলো। আহা জীবন!

এখনো এখানে আকাশ দেখা যায়। খোলা আকাশ। তাই হয়তো পুরাণে আছে, লঙ্কাপতি রাবণ শিবের মূর্তি নিয়ে স্বর্গ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় এই দ্বীপে একটু জিরিয়ে নিতে থামে। রাবণের অপর নাম দশগ্রীব! মানে দশটা মাথা! ভাবা যায়? একমাথা নিয়েই হিটলার-মুসোলিনী-ট্রাম্প দুনিয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে। বেচারা রাবণ দশ মাথা দিয়ে কি করবে? অতি বুদ্ধির ভাড়ে  রাবণ শর্ত ভেঙ্গে ফেলে শিব মূর্তিটা এই দ্বীপে রেখে প্রকৃতির  আহবানে সাড়া দিতে যায়। অথচ শর্ত ছিলো- লঙ্কা যাওয়ার আগে এটা কোথাও রাখা যাবে না। শিব অনড়! তাই রাবণের আর ঐ শিবমূর্তি নিয়ে লঙ্কা যাওয়া হয় নি। কিন্তু শিব রয়ে গেছেন-মহেশখালী! বিখ্যাত আদিনাথ মন্দির এখানে। তাই ভক্তদের আগমনে এই দ্বীপ মুখরিত। পাহাড়ের চূড়ায় এই মন্দির মনোহর। পাশে সাগর পাড়। আপনি উঠানে দাঁড়িয়ে সাগরের গর্জন শুনতে পাবেন। একই সাথে সাগরের উচ্ছ্বাস আর পর্বতের গাম্ভীর্য। মনের অজান্তেই আকুতি জাগে- দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এই নগর।

সারারাত তারাগুণে কাটিয়েছি। সাগরের গর্জন শুনেছি। সামুদ্রিক মাছ দিয়ে পেটভরে খেয়েছি। লইট্টা শুঁটকই আগুনে পুড়িয়ে যে খায় নি তার জীবন ঐ গ্রীলড চিকেনই। আর রূপচাঁদা মাছের ঝোল-এখনো মুখে লেগে আছে।

এই শান্ত তপোবন ছেড়ে সকাল বেলা সাগর পাড়ে ছুটছি। ছোট ছোট কাঁকরা কেউড়া বনের পাশে। অজস্র শ্বাসমূলের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় কাঁকড়া ছানা আর ছোট মাছের ঝাঁক। ইচ্ছে করবে, সারাদিন তাকিয়ে থাকি। কিন্তু ফিরতে হবে । এবার যাব কক্সবাজার হয়ে। তাই সোজা জেটিতে চলে এলাম।

স্পীডবোর্টে অবতরণ করা চাঁদে অবতরণের চেয়ে একটুও কম কষ্টের না। আমি কোনোমতে উঠলাম। মাত্র বিশ মিনিটের পথ। তবে স্থলের সৌন্দর্য আর জলের সৌন্দর্য দুটোরই আলাদা রূপ।

মাছধরার ট্রলার ছুটছে আবার কখনো দূরের জাহাজ এসে দৃষ্টি নিয়ে নিলেও দুপাশের ম্যানগ্রোভ বনগুলো থেকে চোখ ফেরানো দায়। আমি ছবি তুলি না, যত পারি মনে গেঁথে নিই। সাগরের পানি সবুজাভ। কিন্তু কক্সবাজারের কাছাকাছি আসতে আসতে লক্ষ করবেন একটা বিশাল রেখা সাগরকে দুভাগ করে গেছে।এর একপাশে সবুজ জলরাশি আরেকপাশে বালিরঙ্গের হলুদ জল্ধারা। বুঝেছি কোনো নদীর মোহনা এসে মিশেছে সাগরের কূলে।

কক্সবাজার পৌছালাম । সন্ধায় আবার ঢাকার বাসে উঠবো। তাই বিকালে সূর্যাস্ত দেখতে চলে এলাম সাগরপাড়ে। আরেকবার যদি জন্মাতাম-ঈশ্বরকে বলতাম-আমাকে দেখার মতো চোখ দিও! দিগন্ত থেকে আজ চোখ ফেরানোয় দায়! কয়েক মুহূর্তে আঁধার নামবে বেলাভূমিজুড়ে। সূর্য ডোবে কি-জানি না! অথচ ত্রিনয়নার জলচ্ছবি যে আঁকা হলো রক্তিম জল-স্থল-অম্বরে, তাতো আসছে আঁধারকে প্রজ্বলিত করে যায় সোনালি সুখে…।