বিজ্ঞান ও সার্ন ভ্রমণ

সৌমেন রুদ্র
Published : 6 August 2017, 10:17 PM
Updated : 6 August 2017, 10:17 PM

আমার জেনেভা ভ্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল CERN (সার্ন ) ঘুরে দেখা। সার্ন শব্দটি আসলে এসেছে ফরাসি Conseil Européen pour la Recherche Nucléaire থেকে যার ইংরেজি আনুবাদ করলে দাঁড়ায় – ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ । সার্নকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা গবেষণাগার বলা হয়ে থাকে। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সার্ন প্রতিষ্ঠিত হয়। পদার্থবিষয়ক এই গবেষণাগারের অবস্থান ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডের সীমানা ঘিরে।

আমরা সবাই WWW (ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের) কথা শুনেছি। এই সার্নকে বলা হয় ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ এর জন্মস্থান, মূলত এখান থেকেই ইন্টারনেটের বিকাশ শুরু হয়। ২০১৩ সালের আগে সার্ন সম্পর্কে আমার ধারনায়ই ছিল না। ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ঘোষনার পর সার্ন সম্পর্কে অবগত হই। সার্নে 'ঈশ্বর-কণা' নামে পরিচিত হিগস–বোসন কণার অস্তিত্ব প্রথম প্রমান করার জন্য ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান ফ্রাঁসোয়া ইংলার্ত ও পিটার হিগস। পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগস ও সত্যেন বোস-এর নামে 'হিগস–বোসন' কণার কণার নামকরণ করা হয়। আর এই বাঙ্গালী বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্যই আমার সার্ন এর প্রতি আকর্ষণ।


সার্নএর ওয়েবসাইটে পড়েছিলাম সকালে ওদের একটা প্রেজেন্টেশন থাকে ইংলিশে। তাই আমরা সকাল সকাল ১৮ নম্বর ট্রাম ধরে ৯ টায় গিয়ে উপস্থিত। ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম, গাইডেড ট্যুরের জন্য ১৫ দিন আগে টিকেট করতে হয়। তো উপায় কি? তখন ওরা বলল, কোনো অসুবিধে নেই! আপনি নিজে নিজে আমাদের Microcosm এক্সচেরশন এবং The Globe of Science and Innovation মিউজিয়াম ঘুরে দেখতে পারেন। ঘুরে দেখতে গিয়ে দেখলাম, ওখানে সব কিছুর ব্যাখ্যা ও ভিডিও দেয়া আছে! আপনি চাইলে পড়ে দেখতে পারেন, না হয় ভিডিও দেখতে পারেন।


বিগত বছরগুলোতে মহাবিশ্বের গঠনপ্রকৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভের উদ্দেশ্যে সার্নে অনেক কিছু নিয়ে গবেষনা হয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে অন্যতম বিস্ময় 'ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি। বিস্ময়কর এ পদার্থের সন্ধান পেতে বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানীরা কোনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সার্নে এ নিয়ে কাজ চলছে।


ঈশ্বর কনা বা গড পারটিকেল আবিষ্কার সার্নের অন্যতম অর্জন। সার্নে এক বিশাল সুড়ঙ্গ আছে। যা লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের (এলএইচসি) নামে পরিচিত। এই সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭ কিলোমিটার। এটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়। সাম্প্রতিক দেখা মিলল আরও এক ধরনের 'ঈশ্বর কণা'র। যার ভর বছর দু'য়েক আগে খোঁজ মেলা 'ঈশ্বর কণা' বা হিগ্‌স বোসনের চেয়ে অনেকটাই বেশি। গানিতিক মানদণ্ডে ১৪৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট (জিইভি)যেখানে হিগ্‌স বোসনের ভর ছিল ১২৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্ট (জিইভি)।

গ্লোব অব সায়েন্স মিউজিয়ামে গিয়ে থিয়েটারের মত মনে হল। এখানে ও পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া আছে সব কিছুর। এখানে আমার চেয়ে বেশি মজা পেয়েছে মনিকা। কিছুক্ষন পর পর বলছে- আহা! এখানে না আসলে ত অনেক কিছুই মিস করতাম!

সাধারন জনগনের বুঝার সুবিধার্থে বিগ ব্যাং অর্থাৎ এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় ৫ মিনিটের একটা ডকুমেন্টরি দেখিয়েছিল। ১৯২৯ সালে বিজ্ঞানী এডউইন হাবল তার বিখ্যাত টেলিস্কোপের সাহায্যে আকাশের গ্যালাক্সিগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন গ্যালাক্সিগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই দূরে সরে যাওয়ার প্রবনতা দেখেই তিনি ধারনা করেন যে, দূর অতীতে নিশ্চয় তারা খুব কাছাকাছি ছিল, খুব ঘন সন্নিবদ্ধ অবস্থায় একে অপরের সাথে লেগেছিল। আর সেই গাঁট-পাকানো অবস্থা থেকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এটাই সেই বিখ্যাত 'বিগ ব্যাং'- নামে পরিচিত।

বিজ্ঞানীরা যে কত নতুন নতুন গবেষণা করছে, তারই একটি নমুনা এই সার্ন। সার্নের মত আরো অনেক গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে। বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রর নব নব আবিষ্কার এগিয়ে নিয়ে যাক বিজ্ঞানকে আর আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীকে!

আরও অনেক কিছু ছিল, যা এখনো আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে! ভবিষ্যতে আবার লিখব অন্য কিছু নিয়ে।