ইয়াঙ্গুনে কয়েকদিনঃ ২য় পর্ব

সুকান্ত কুমার সাহা
Published : 24 Sept 2012, 06:21 AM
Updated : 24 Sept 2012, 06:21 AM

এখন মধ্যরাত, শ্রাবণের অঝোর ধারা ঝরছে। এই রকম বর্ষণমুখর রাত ঢাকায় অনেকদিন উপভোগ করেনি। রুম এসির শব্দে ঘুম আসছে না। হোটেল রুমের পিছনে বোধ হয় কোন টিনের চালের ঘর আছে, বৃষ্টির বড় বড় ফোটা চালে পড়ে ঝম ঝম শব্দ হচ্ছে যা বর্ষণের রাতটাকে মোহনীয় করে তুলেছে। রুমের দরজার ওপাশের লবি থেকে এক নাগাড়ে মেয়েদের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। জানিনা তারা কারা। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, তোর জানার দরকার কি "তারা আসলেই কারা"! ভীষণ শীত লাগছে, পাশের খালি বেডের কম্বলটা নিয়ে, আমারটা সহ দুই কম্বল এক করে মাথা মুড়ে শুয়ে পরলাম। আর মনে মনে বললাম, ইয়াঙ্গুনের রাত সত্যিই মোহনীয়।

আমার কাছে এখানকার ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশী কর্মজীবী মনে হয়েছে, দোকান থেকে শুরু করে থেকে ছোট বড় অফিস সব জায়গায় মেয়েদের প্রাধান্য। ব্যবসার উদ্যোক্তা, পরিচালকও অনেক মেয়ে। দুই একজনের সাথে এই বিষয়ে কথা বলে বুঝলাম যেসব কাজে শ্রমের বেশী প্রয়োজন সেখানে পুরুষরা আর যেখানে কম শ্রমের প্রয়োজন সেখানে মেয়েরা কাজ করে। মনে মনে বললাম, ভাল সিস্টেম।

পুরুষ ও মেয়ে প্রায় সবাই শারীরিক ভাবে খুবই হালকা পাতলা ধরনের, মেয়েরা প্রায় সবাই সাইজ জিরো। এর জন্য ওদের কারিনা–ক্যাটরিনার মতো ডেইলি জিমে দৌড়াদৌড়ি আর মিডিয়া গসিপ তৈরী করতে হয়নি।
পোশাক আশাকে ওরা একেবারেই সাধারণ। মেয়ে পুরুষ সবাই ওদের জাতীয় পোশাক পড়ে। পুরুষরা সবাই আমাদের মতো লুঙ্গি পড়ে, তবে আমাদের সাথে ওদের পড়ার ধরনে পার্থক্য আছে। আমারা সাধারণত লুঙ্গি'র উপর শার্ট বা গেঞ্জি পড়ি আর ওরা পড়ে কিছুটা উল্টো, শার্ট বা গেঞ্জির উপর লুঙ্গি পড়ে, অনেকটা ইন করে শার্ট-প্যান্ট পড়ার মতো করে। ম্যান আর সুপারম্যানের পোশাক পড়ার ধরণে যেরকম পার্থক্য, প্রায় সেইরকম আর কি! কিছু কিছু মেয়ে মাথায় ফুলের মালা পড়ে। তবে সব মেয়েই মুখে চন্দন গুড়ো মাখে। এমনকি কিছু পুরুষকেও মুখে চন্দন গুড়ো মাখতে দেখেছি। এটা নাকি সূর্যরশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করার পাশাপাশি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। কিছু কিছু মেয়ের ত্বক এত সুন্দর যে, তা হতে ঠিকরানো সূর্যের আলোয় চোখ বুজে থাকা সত্যই কষ্টকর।

বিমানবন্দর থেকে সরাসরি গাড়ীতে এসে আগে থেকেই বুকিং করে রাখা হোটেল ক্রিস্টাল প্যালেসে চেক-ইন করলাম। রুমে ব্যাগটা রেখেই গোছল করে ফ্রেস হয়ে নিলাম। ঢাকা থেকে ইয়াঙ্গুন যদিও এয়ার ডিসট্যান্স ১ ঘন্টা ২০ মিনিটের বেশী না কিন্তু ট্রানজিট ফ্লাইটের কারণে প্রায় ৮-৯ ঘণ্টা লেগেছে। থাইল্যান্ডের সূবর্ণভুমি এয়ারপোর্টে আমাদের প্রায় ৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে পরবর্তী ব্যাংকক-ইয়াঙ্গুন ফ্লাইট ধড়ার জন্য। ঢাকায় ব্যাংকক এয়ারওয়েজে রাত ১ টায় উঠে হোটেলে আসতে আসতে পরদিন দুপুর ১২ টা বেজে গেছে। রাতজাগা ভীষণ ক্লান্ত শরীরে খুধাও লেগেছে বেশ। যদিও সূবর্ণভুমি এয়ারপোর্টে ব্যাংকক এয়ারওয়েজের রেস্ট-রুমে গোগ্রাসে খেয়েছি। ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারদের জন্য এখনে পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা আছে, যত পারো তত ভিত্তিতে। একদম ফ্রি। আর বুজতেই পারছেন, বাঙ্গালীর ফ্রি পেলে কি দশা হয়! কেক, পেটিস, সমুসা থেকে শুরু করে চা-কফি পর্যন্ত সবকিছু সুন্দর করে সাজানো, তবে ঝড়টা গেছে কেকের উপর দিয়ে। কেকটা ছিল সত্যিই অসাধারণ। আর বিমান দুটিতে পরিবেশিত খাবারও খারাপ ছিল না, বিমানে টপবস'রা থাকায় বিমান বালিকাদের সুন্দর হাত থেকে ফ্রি "ওয়াইন পেগে"র কাঁচের পেয়ালাগুলো হাতে নিয়ে পারিনি বলে মনে খুব ব্যথা পেয়েছি!

রুমে ঘণ্টা খানেক রেস্ট নিয়ে লিফটে নিচে নেমে এসে হোটেলের রেস্টুরেন্টে খেতে বসলাম। রিসিপশন কাম রেস্টুরেন্ট। খাবার মেন্যু হাতে নিয়েই একটু থমকে গেলাম। ওয়েটারকে ইশারায় কাছে ডেকে, বললাম, আমাকে ভেজ মেন্যু দাও। সে আধো আধো ইংরেজিতে বলল, স্যার ভেজ মেন্যু নাই। সাক্ষাৎ বিপদ যদিও আমি এই ব্যাপারে মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি। পরে অনেক খুঁজে এগ ফ্রায়েড রাইসের মেন্যু বের করে শুধু তাইই খেলাম। আর দাম, সেই আগের মতই, মাথা ঘোরানো! তবে জলের দামের তুলনায় বিয়ার সস্তা। কি আর করা যাবে? পয়সা অসুলের চিন্তা বাঙ্গালীর মাথায় সবসময় ঘোরে, আমারও ঘুরলো। রেড ওয়াইনের ব্যথা কিছুটা ঘুচলো।

খেতে আসা পাশের টেবিলগুলোতে হোটেল বাসিন্দাদের দেখেই বুজলাম, যা শুনেছি তা ঠিক, চীনাদের আধিক্য এখানে ব্যাপক। খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে কানে মাইক্রোফোন লাগিয়ে ছেলে মেয়ে সবগুলো ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত। কোনদিকেই ওদের কোন খেয়াল নেই। চুল খাড়া করে ছাঁটা কম বয়সী একটাকে দেখলাম চাইনিজ ভাষায় চ্যাটিং করতে করতে একবার চেয়ারে পা তুলে বসছে আবার নামাচ্ছে, ল্যাপটপ একবার কোলে নিচ্ছে আবার টেবিলে রাখছে। দুই একবার ওর পায়ের নড়াচড়া করার ভঙ্গী দেখে মনে হোল এই বুঝি ও লাফ দিয়ে টেবিলে উঠে বসলো। কখনো কখনো মাথাটাকে ল্যাপটপের স্ক্রিনের এত কাছে নিয়ে চ্যাটিং এর উইন্ডোর ভিতর তাকাচ্ছে যে, দেখে মনে হলো, শালা কানা! চাইনিজ মেড চ্যাটিং-এর এই নতুন ভার্সনটির নাম দিলাম "বান্দর চ্যাটিং"।

ঘুম থেকে উঠেই একটু ফ্রেস হয়ে ঝটপট রেডি হয়ে গেলাম আমার আসল কাজ করার জন্য। হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় হোটেল রিসিপশনে রুমের চাবিটা দিতেই একটা মেয়ে জিজ্ঞাসা করলো, স্যার কি বের হবেন? আমি বললাম হ্যাঁ, শহরটা একটু হেঁটে ঘুরবো, এখানে দোকানপাট, বাজার কোন দিকে? মেয়েটি বলল, ডান দিকে স্যার। শুনে আমি সদর দরজার দিকে এগোতেই আর একটা মেয়ে আমার দিকে একটা ছাতা এগিয়ে দিলো। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ছাতা দিচ্ছ কেন? আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটি সহ রিসিপশনের আর সবাই একযোগে হেসে উঠলো। আমাকে যে মেয়েটি ছাতা দিচ্ছিল সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলল, স্যার এখানে যখন তখন বৃষ্টি হয়, এটা খুবই কাজে দিবে।

সদর দরজা দিয়ে বের হয়েই প্রথমে হোটেলের নাম ও তার গেট-আপটা ভাল করে দেখে নিলাম যেন চিনতে ভুল না হয়, তারপর আশেপাশে দেখতে থাকলাম মনে রাখার মত কিছু পাই কিনা। হোটেলের বিপরীতে রাস্তার উল্টোদিকে দেখলাম বড় বড় হা করে লকলকে জিহ্বা বের করা সোনালী রঙের দুটো ড্রাগন মূর্তি। যারা তাদের পা দুটো সামনের দিকে খাড়া করে আক্রমণ বা স্বাগতমের ভঙ্গীতে বসে আছে অথবা উপরের দিকে বড় পাহাড়ে উঠে যাওয়া সিমেন্টে বাঁধানো একটি পুড়নো সিঁড়িকে পাহারা দিচ্ছে। কয়েকজন গেরুয়া বসনের বৌদ্ধ ভিক্ষু সিঁড়ির ধাপ ভেঙ্গে উপরে উঠে যাচ্ছে। যা নির্দেশ করছে, সিঁড়িটার গন্তব্য নিচ্ছিতভাবেই পাহাড়ের উপরে স্থাপিত কোন এক বৌদ্ধ মন্দির বা প্যাগোডা। প্রচুর গাছপালার কারণে প্যাগোডাটি আমি দেখতে পাচ্ছিনা।

শার্ট-প্যান্টের পকেটগুলো চেক করে দেখে নিলাম হোটেলের কার্ড, ভিসাসহ পাসপোর্টের ফটোকপিটা আছে কিনা। মানিব্যাগের খুচরো চাট গুলোর কি অবস্থা তাও দেখে নিলাম, সাথে হোটেলের কার্ডটাও, এখানে খুচরো মানেই ৫০০ চাট । চেকইন করার সময়ই আমি হোটেলের কার্ডগুলো চেয়ে নিয়েছি যা বিপদে ব্যাকআপ হিসেবে কাজ দিবে। আমার ব্যাগ গুলোতেও একটা করে রেখেছি। বিদেশের মাটিতে হোটেল কার্ড বিপদে সেফগার্ড হিসেবে কাজ করে, তাছাড়া ইংরেজি কম জানা দেশে একটু বেশীই সতর্কতা নিতে হয়।

আগামীকাল বায়ার'দের সাথে জরুরী মিটিং, মিটিং-এ আমদের টপবস'রাও থাকতে পারেন কিন্তু এখানকার মার্কেট ইনফরমেশন বলতে তেমন কিছুই নেই আমার কাছে। কিছু তথ্যতো অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে, না হলে মিটিং-এ বোকা সাজতে হবে। ঠিক করলাম শুধুই ডান দিকে হাঁটবো, কোন প্রকারেই রাস্তা ক্রস করবো না বা প্যাঁচানো কোন গলিতে ঢুকবো না। সন্ধ্যা হতে বড় জোড় আর দুই ঘণ্টা এর মধ্যেই আমাকে যা কিছু করার তা করতে হবে।