মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-৬

সুকান্ত কুমার সাহা
Published : 28 March 2015, 06:04 PM
Updated : 28 March 2015, 06:04 PM

আগের পর্বে লিখেছিলাম ইয়েমেনের চলমান সংঘাত সৌদি–ইরানের প্রক্সিযুদ্ধ থেকে সরাসরিকেও টেনে আনতে পারে। বাস্তবে তাইই ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে বা তারচেয়েও বেশী কিছু হতে যাচ্ছে! হতে যাচ্ছে বিভাজন বিশ্বশক্তির মধ্যেও।

গত তিনদিন ধরে সৌদি আরবের নেতৃত্বে গালফ দেশগুলোর জোট; একনাগাড়ে বিমান আক্রমণ করে যাচ্ছে ইয়েমেনের শিয়া মতালম্বি হোথি গেরিলাদের উপর। আর এটা কে না জানে যে এই হোথি গোষ্ঠী সম্পূর্ণরূপেই ইরানের সমর্থনপুষ্ট? তাই হোথিদের উপর আক্রমণ করা আর ইরানের উপর আক্রমণ করা একই কথা! এখন যদি ইরান সেটা নিজের দিকে টেনে নেয় তাহলেই বেঁধে যাবে আরও একটা ভয়াবহ যুদ্ধ। যা প্রকারান্তরে বিশ্বযুদ্ধকেও প্ররোচিত করতে পারে।


এই আক্রমণে সৌদি আরবের একশত বিমানসহ সর্বমোট ১৮৫ টি যুদ্ধবিমান অংশ নিচ্ছে। কুয়েত, কাতার, ওমান, আরব আমিরাত, জর্ডানসহ দশের অধিক দেশ ইতিমধ্যেই এই আক্রমণে অংশ নিয়েছে। পাশাপাশি সৌদিআরব তাদের দেড় লক্ষাধিক সৈন্য মোতায়েন করেছে ইয়েমেনের সীমান্তে। যা নির্দেশ করছে একটা বড় যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে। এখন যদি ইরানও একই ব্যবস্থা নিতে যায় তাহলেই বেঁধে যাবে আমাদের বড় ভাই ও তার দোসরদের সেই কাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ যা তাদের নিজদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে; হাতে পাবে তেলের মনোপলি সাপ্লাইও। যার ফলে নিজেরা তেল কিনবে কমদামে তাও অস্ত্রের বিনিময়ে আর আমাদের মত গরীব দেশগুলোকে কিনতে হবে বেশী দামে। দিতে হবে যুদ্ধের প্রিমিয়াম।

মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমান যে মেরুকরণ হচ্ছে তাতে করে এই ভূমি ক্রমেই সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বিভাজিত হচ্ছে। শিয়া, সুন্নি, কুর্দি, ইহুদী ও খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভূমি ভাগ হওয়ার সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে। ভ্যাটিকান নিজ থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের কথা বলছে যা নিকট অতীতে দেখা যায়নি। জাতিসংঘ উপযাচক হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ঘটে যাওয়া মানবতা বিরোধী অপরাধগুলো রুখতে না পারার জন্য শক্তিশালী দেশগুলোকে দুষছে। এতে করে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, নিকট অতীতে যারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থা নিয়েছে; সেই সংগঠনগুলোই এখন যুদ্ধ চাচ্ছে! এর মানে কি দাঁড়ায়?

সুন্নিরা আগে থেকেই এই অঞ্চলে শক্তিশালী হলেও বর্তমানে শিয়াবলয় ক্রমেই তার পূর্ণশক্তি নিয়ে আবির্ভাব হয়েছে। ইতিমধ্যেই তারা তেহরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের চার চারটা রাজধানী দখলে নিতে পেরেছে। ইরাক থেকে সুন্নি শাসক সাদ্দাম হোসেনকে সরাতে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা একযোগে আমেরিকাকে সমর্থন দিলেও এই সিদ্ধান্ত ইরানের জন্য শাপেবর হয়েছে; হয়েছে সৌদি আরবের জন্য বুমেরাং। যে শিয়ারা সাদ্দামের আমলে ছিল দৌড়ের উপর; এখন তারাই আছে বাগদাদসহ ইরাকের একটা বড় অংশের অধিকারে। যদিও আইএস তাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ইতিমধ্যেই একটা বড় অংশ নিজেদের দখলে নিতে পেরেছে। শোনা যাচ্ছে ইরাকে বর্তমানে ত্রিশ হাজারেরও বেশী ইরানী সেনা মোতায়েন আছে। যুদ্ধ করছে আইএসের বিরুদ্ধে। আবার ওদিকে ইরান-সৌদি আরবের পাশাপাশি আইএস-হিজবুল্লাহ'র মধ্যেও আর একটা যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে! যা হবে ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী!

আইএস ও আল-নুসরা'র কাছে সিরিয়ার একটা বড় অংশ হারালেও প্রেসিডেন্ট আসাদ এখন অনেকটাই নিরাপদে আছেন; লেবাননের শিয়া গেরিলা গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও তার সব সময়ের মিত্র রাশিয়ার সমর্থনে। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা আসাদকে ক্ষমতা থেকে হটানোর চেয়ে বরং তাকে এখন রেখে দিতেই বেশী পছন্দ করছে। এক্ষেত্রে মতবাদ হল- কিং কোবরাটাকে রেখে দাও ব্ল্যাক মাম্বা'র জন্য! যদিও তাতে বাগড়া দিচ্ছে ইসরাইল, তুরস্ক ও সৌদি আরব কিন্তু তাতে লাভ হবে না! আসাদ একপ্রান্ত আগলে দাঁড়িয়ে থাকবে দাবার 'নৌকা' হয়ে! আর তাকে সাপোর্ট দিবে কুর্দি, ইয়াজদী ও খ্রিস্টানরা যা তাকে ভ্যাটিক্যানের সাপোর্টও পাইয়ে দিতে পারে!

আবার পঞ্চ বিশ্বশক্তি ও জার্মানি পারমাণবিক আলোচনার উৎস ধরে ইরানের সাথে তাদের সম্পর্ককে নতুনভাবে ঝালাই করে নিতে চাচ্ছে; যা প্রকারান্তরে আসাদের পক্ষে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে সৌদি আরব নিজের খারাপ লাগাটা প্রকাশ করেছে। হয়েছে মনোমালিন্য আমেরিকার সাথেও। আর তাই তো তারা আমেরিকার মতের বিরুদ্ধে যেয়েও মিশরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জনাব মুসরিকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল সিসিকে ক্ষমতা দখলে উৎসাহ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে অবশ্য তারা পাশে পেয়েছে আমেরিকার আর এক বন্ধু ইসরাইলকে।

কিন্তু যুদ্ধ করা যাদের নেশা; তাদের এই নেশা মেটাতে যেয়ে আমাদের মত চুনোপুটিদের কি হবে?

আমরা কোন দিকে যাবো? আমাদের রেমিটেন্সের কি হবে? আমার এক্সপোর্টের কি হবে?

২৮/০৩/২০১৫ বিকালঃ ৪.২০

আগের লেখাঃ
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-৫
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-৪
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-৩
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-২
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-১

সুত্রঃ আল জাজিরা