বড়দি’র মৃত্যু

সুকান্ত কুমার সাহা
Published : 21 April 2017, 05:45 AM
Updated : 21 April 2017, 05:45 AM

এ মাসের পনের তারিখে হঠাৎ করেই আমার বড়দি' মারা গেলেন! কেউ বলে স্ট্রোক করে, আবার কেউ বলে ডাইবেটিস 'শুন্য' হয়ে যাওয়ায় মারা গেছেন। সত্যিটা জানলাম বড়দিদির ছোটছেলে আশীষ মামার কাছ থেকে। তার হার্টএটাক হয়েছিল। বলতে গেলে এটা আমাদের পারিবারিক রোগ। আমাদের বংশের অধিকাংশ মৃত্যুই হয়েছে এই রোগে। আমার বড় মামা ও এই মামারই বড় ছেলে মারা গেছেন এই রোগে। এই বড়দিদিও এই মামারই বড় মেয়ে। আমার বড় দাদাও মারা গেছেন এই রোগে। অপারেশন করে আমার দিদি বেঁচে গেছেন; ডাক্তারের ভাষায় এই বেঁচে যাওয়াটা ছিল 'বাই চান্সে'। সেটাও জানলাম হঠাৎ করেই!

দিদির অপারেশনের প্রায় ২০ বছর পর একদিন দিদিকে রুটিন চেকাপ করতে নিয়ে গেছি ডাঃ বরেন চক্রবর্তীর কাছে। তিনি দিদিকে দেখামাত্রই চেয়ার থেকে প্রায় লাফ দিয়ে উঠতে উঠতে বলেছিলেন, আপনি এখনো বেঁচে আছেন? আমরা ভেবেছিলাম! – বলেই তিনি হেসে ফেললেন! বললেন, আসলে আপনার যখন অপারেশন করা হয় তখন আমি ছিলাম ট্রেইনি ডাক্তার। ডাঃ মালেক স্যারের টিমে ছিলাম। ওটা ছিল আমাদের এক্সপেরিমেন্টাল অপারেশন! যেখানে আপনার বেঁচে যাওয়ার সম্ভবনা ছিল খুবই কম! যাকগে, আপনাকে দেখে ভাল লাগলো! আমার দিদিও খুব সপ্রতিভ, তিনিও হেসে বললেন, চিন্তা করবেন না, আমি আরও অনেকদিন বাঁচবো এবং ছেলেকে ডাক্তার বানিয়ে রেখে যাবো! বলেই সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কলেজে পড়ুয়া জয়কে দেখিয়ে দিলো! ডাক্তার বাবু ভাগ্নেকে দেখে আরও অবাক হয়ে বললেন, আপনার এর পরে বাচ্চাও হয়েছে? আপনি তো দেখি আমাদের মেডিক্যাল সাইন্সের একটা জীবন্ত স্টোরি! আমার বড়দা'র মৃত্যুও হয়েছেন ডাঃ ব্রিগেডিয়ার মালেক স্যারের তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায়; মাত্র ২৪ বছর বয়সে। তখন এর রোগের চিকিৎসা বের হয়নি! ডাক্তার সাহেব বাবাকে চিনতেন এবং সব জেনেই হার্ট ফাউন্ডেশনে দিদির অপারেশনের দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন।

এখানে আরও একটা কথা জানিয়ে রাখি- আমার ঠাকুরদা ও বড় জেঠাও হঠাৎ করেই মারা গেছেন! যদিও সবাই বলে তাদের স্ট্রোক করেছিল কিন্তু আমার মনে হয় ওগুলোই ছিল এই একই অসুখ। আর এই কারণেই আমাদের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মকে ডাক্তার বানানোর নেশায় পেয়ে বসেছে। ইতিমধ্যেই পাঁচজন লাইনে এসে গেছে।

দিদি কথা রেখেছেন! তার মেয়ের জামাই আর ছেলে দুইজনই ডাক্তার হয়েছে! একজনকে খুঁজে বের করেছে আর অন্যটাকে নিজের হাতে বানিয়েছে। অবশ্য ভাগ্নেকে ডাক্তার বানাতে যেয়ে একজন উঠতি ক্রিকেটারকে নষ্ট করেছে সে! এনিয়ে জামাইবাবুর সাথে আমার ক্যাঁচাল হয়েছে মাঝে মাঝে। আমি নিজে ক্রিকেটার হতে না পারার আকাঙ্খা পূরণ করতে চেয়েছিলাম ভাগ্নেকে দিয়ে।

যেটা বলছিলাম, আমার ইমিডিয়েট বড়ভাইও ম্যাসিভ হার্ড এটাকে প্রায়ই গেছিলেন! বাবার উপস্থিত বুদ্ধি আর ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিতে পেরেছিলেন বলে রক্ষা পেয়েছে সে। আমি জানি এর পরের পালাটা আমার। আশীষ মামাকে বললাম, তোরাও সাবধানে থাক। খুনি বংশে ঢুঁকে গেছে, তোরাও আর নিরাপদ না! ট্রিটমেন্টের মধ্যে ঢুঁকে যা! আপাতত বেঁচে থাকার একমাত্র পথ এটাই।

দাদার অপারেশন করাতে যেয়ে- ঘাটাঘাটি করে আর ডাঃ দেবী শেঠির সাথে কথা বলে যতটুকু বুঝেছি, এই রোগটা অনেকটাই বংশগত অসুখ। যাদের বংশে এই রোগ ঢুকেছে তাদের এথেকে মুক্তি নেই। যদিও ডাঃ শেঠির ভাষায় মেয়েরা এই রোগ থেকে প্রাকৃতিক সুরক্ষা পায় কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের বংশের মেয়েরাও সেটা পাচ্ছে না।

যারা এই লেখা পড়ছেন, তাদের জন্য আরও একটা 'অন্যরকমের দুঃখজনক ঘটনা' অপেক্ষা করছে। নিশ্চয়ই আপনারা পত্র-পত্রিকায় পড়ে থাকবেন যে, পঞ্চাশ-ষাট বছর সংসার করার পর স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি সময়ে মারা যাচ্ছেন। বা ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে তার মা অথবা বাবা মারা যাচ্ছেন!

এক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, আমার বড়দির মৃত্যুর খবর শুনেই তার বড়'জাও স্ট্রোক বা হার্ট এটাক করে মারা গেছেন। মাত্র একঘন্টার ব্যবধানে একই বাড়ীতে দুই-দুটি মৃত্যু! তারা প্রায় একসাথে পঞ্চাশের অধিককাল সময় ধরে সংসার করেছেন, সাংসারিকভাবে পৃথক হলেও কোনদিন তাদের মধ্যে কোন সমস্যা হতে দেখিনি। দুই জা যেখানেই যেতেন একসাথে যেতেন! অভাব-অনটন, যুদ্ধ-বিগ্রহ আর নদীভাঙ্গন একসাথে সামলেছেন। আগলিয়ে রেখেছেন নিজেদের সংসারকে! এবং পৃথিবী থেকে যাওয়ার সময়ও একই সাথে গেলেন!

আর এই দুই দিদিই ছিল আমার খুব প্রিয়! আমি কী পছন্দ করি, কী খেতে ভালোবাসি তা তারা জানতো। আমার প্রিয় দিদিরা আর নেই! তাদের হাসিমাখা সেই মুখে আর শুনবো না, সুকান্ত, আমাদের বাড়িতে যাস না কেন? এবার যাওয়ার আগে খেয়ে যাবি কিন্তু!

বড়দির মৃত্যুর সাথে সাথে আমার মামার বাড়ির সর্বশেষ স্মৃতিটুকুও হারিয়ে গেল। আমার মা'র কাছে এই শোক ভয়াবহ। আমাদের পাশের গ্রামে দিদির বিয়ের মূল উদ্যোক্তা ছিল আমার বাবা-মা। আর আমার বড় মামা-মামী দেশত্যাগ করার আগে, যারা ছিল আবার আমার মায়ের বাবা-মায়ের মত, বলেছিল, "স্বর, আমাদের গীতাকে দেখে রাখিস!" সেই থেকে আমার মা তার ভাইঝিকে ছাড়া কিছুই বোঝে নাই, আর বাবা-মা হারা ভাইঝিও তার বড় পিসি ছাড়া কিছুই চিন্তা করতে পারতো না!

আর সব খবর শুনে আমি মালয়েশিয়ায় কাজে ব্যস্ত! ফেসবুকে, ব্লগে জোকস করে যাচ্ছি!

এটাই বোধহয় জীবন অথবা হারামীপনা!

২০/০৪/২০১৭