আপগ্রেড চাইলে নিজেকে আপডেট রাখা চাই

সুকান্ত কুমার সাহা
Published : 25 June 2017, 08:56 AM
Updated : 25 June 2017, 08:56 AM

এটা আমার চতুর্থ চাকুরী। নতুন অফিস, নতুন ল্যাপটপ। সাথে মানুষগুলোও নতুন। শুধু চ্যালেঞ্জটা আর কাজটাই পুরাতন। আর পুরাতন আমার বস সহ এই প্রতিষ্ঠানে সদ্য যোগ দেওয়া আমার কিছু কলিগ, যাদের সাথে আমার পরিচয় চাকুরীজীবনের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানে। আর আছে আমার আগের চাকুরীজীবনে আমারই ডেভেলপ করা বিদেশী ক্রেতা বন্ধুরা। মূলত এরাই একজোট হয়ে আমকে এই প্রতিষ্ঠানে নিয়ে এসেছেন। তারা আমার বর্তমান প্রতিষ্ঠানের মালিককে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন এই বলে যে, যদি আপনি আপনার এই পণ্য বিদেশে রফতানী করতে চান তাহলে সুকান্তকে লাগবে। ব্যাস, আমি পরে গেলাম দেশের সবচেয়ে বড় পাঁচটা শিল্পগোষ্ঠীর অন্যতম দুইটির মালিকদ্বয়ের সরাসরি চাপের মধ্যে।

গত চাকুরীটাতে মানে আমার চাকুরী জীবনের তিন নম্বরটাতে আমি ভালই করছিলাম বলে অফিসের অনেকেই বলাবলি করছিলেন। দেড় বছরের মধ্যে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সৌদি আরব আর কুয়েতের মত টাফ মার্কেটগুলো থেকে আমি রেজাল্ট বের করে এনেছিলাম। কাজেই আমার উপর আমার বস সহ প্রতিষ্ঠানের টপ ম্যানেজমেন্টও খুশী ছিল। তারা চাচ্ছিলেন আমাকে পাকাপাকিভাবে মালয়েশিয়ায় পোস্টিং দিয়ে দিতে। যাতে করে আমি পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারটা ভালভাবে ডেভেলপ করতে পারি। সেই সূত্রে আমার প্রোমোশন প্রপোজাল চলে গিয়েছিল, পেয়েছিলাম আমাদের বিভাগের সবার চেয়ে বেশী ইনক্রিমেন্টও। আবার এডিশনাল হিসেবে আফ্রিকা মার্কেটের দায়িত্বও দেওয়া হচ্ছিল।

এই চাকুরীর বস সালাউদ্দিন ভাইও ছিল আমার পূর্ব পরিচিত। যেহেতু আমরা উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনেক বছর ধরেই দেশীয় পন্য বিদেশে রফতানীর কাজে নিয়োজিত আছি, তাই আমরা একে অপরকে চাকুরী জীবনের শুরু থেকেই চিনি-জানি। ইনি আমার বন্ধু স্থানীয়ও কিন্তু ইনিই আমাকে আবার এই চাকুরীতে নিয়ে এসেছিলেন। দিয়েছিলেন তারই আন্ডারে এশিয়া রিজিয়নের সেলস ও বিজনেস ডেভেলপমেন্টের কাজ। কারণ আমি আগের চাকুরীতে তথা দুই নম্বরটায় ম্যানেজমেন্টের একটা সিদ্ধান্তে কমফোর্ট ফিল করছিলাম না এবং সেটা ওনাকে জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমার একটা চাকুরী লাগবে। সেখানে আমার দোষ ছিল অতিরিক্ত ভাল করে ফেলা! যদিও চাকুরী নিয়ে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু আমি সেখানে আর থাকবো না বলে মনস্থির করে ফেলেছিলাম। তাই তাদের দেওয়া পালটা কোন প্রস্তাবই আমি গ্রহণ করিনি। উল্টো আমি তাদের কোন "সমজাতীয় পন্যের" কাজে যাচ্ছি না বলে কমিটমেন্ট করে এসেছি। পাশাপাশি তারাও আমার সার্ভিস বেনিফিটের পুরোটাই দিয়েছে।

বর্তমান চাকুরীতে আমি ছয় মাস আগেই ডাক পেয়েছিলাম কিন্তু আমাদের আগের বস সালাউদ্দিন ভাইকে ছেড়ে আসতে মনে সাই দিচ্ছিল না। অপরদিকে, আমার পুরাতন বস, মজিবর রহমান স্যারের ডাকও ফেলতে পারছিলাম না। কারণ তার সাথেও আমি প্রায় দশবছর একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। তিনিই আমাকে প্রথম এক্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। পুরো একটা দোলাচালের মধ্যে পরে গিয়েছিলাম। আর ছিল বায়ারদের চাপ। কারণ বাংলাদেশ থেকে কাগজ ও কাগজজাত পন্য বিদেশে রফতানীতে এই মুহূর্তে যারা নিয়োজিত আছে, তাদের মধ্যে আমাকেই সবচেয়ে অভিজ্ঞ বলে ধরে নিয়েছেন তারা। তাদের দেওয়া এই ট্যাগই মূলত আমার পনের বছরের কাজের সবচেয়ে বড় এচিভমেন্ট।

আরও একটা এচিভমেন্ট আছে। সেটা আর কারো ক্ষেত্রে ঘটেছে কিনা তা আমার জানা নেই। আমি আগের চাকুরীতে রিজাইন দেওয়ার পর আমার বস সালাউদ্দিন ভাই, "আমি যেন চাকুরীটা না ছাড়ি, আর এখানেই আমার ভবিষ্যৎ উজ্জল" সেটা বোঝাতে তিনি এক ছুটির দিনে আমার বাসায় এসেছিলেন রূপাকে মোটিভেট করতে এবং পেরেছিলেনও। কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করবো বলে মনস্থির করে ফেলেছিলাম আমি। এবং ফাইট করবো আগে বলা দেশের সবচেয়ে বড় পাঁচ শিল্পগোষ্ঠীগুলোর তিন নম্বরটার সাথে। অর্থাৎ আমার দ্বিতীয় চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে।

বাকীটা দেখা যাক।

এথেকে লার্নিং কী?

১) নিজের কাজকে ভালবাসতে হবে। জানতে হবে এর যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ও। নিজে না জানলে অন্যের কাছ থেকে শিখতে হবে। পাশাপাশি নিজের আওতার বাইরেও কাজ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে এবং তা জানতে হবে, শিখতেও হবে। পাশাপাশি সারাক্ষণ ডেভেলপমেন্ট নিয়ে চিন্তা করতে হবে।

২) লেগে থাকতে হবে। বাঁধা আসবে, পাছে লোকে কিছু বলবে, প্রতিষ্ঠানের মালিক ক্ষেপে যাবে, চাকুরী হারানোর ঝুঁকি আসবে, তারপরেরও নিজের কাজ থেকে পিছনে হটা যাবে না।

৩) দেশীয় পন্য বিদেশে বিক্রয় করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। আরও কঠিন কাজ সেই বিক্রীত পন্যের টাকাটা ঠিকমত দেশে নিয়ে আসা। যদিও এক্ষেত্রে বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো ইনভল্ভ থাকে তবুও নিজে ডকুমেন্ট না বুঝলে বা ভুল করলে, তা থেকে রেমিটেন্স না আসার সম্ভবনাও আছে। তাই ব্যাংক বুঝতে হবে, এলসি পড়তে জানতে হবে। ধারণা থাকতে হবে বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পাদিত নিজ দেশের করা বানিজ্যিক চুক্তিগুলোও।

৪) ইন্টারনালের সাথে নানাধরনের এক্সটার্নাল বাঁধাও আসবে। যেমন, আমদানীকারক দেশের সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের ট্যারিফ, নন ট্যারিফ বাঁধা আসবেই। সেটা পাশ কাটানোর মত বিকল্প চিন্তা ডেভেলপ করার মত বুদ্ধি ও সাহস রাখতে হবে। ইন্টারনাল বাঁধার ক্ষেত্রে চিত্তে নরম-গরমভাব ফুটিয়ে তোলার সামর্থ্য থাকতে হবে।

এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দেই-

২০০৫ সালের নির্বাচনের আগে যে অবরোধ চলছিল, সেই সময়টায় চলছিল আমাদের রফতানির পিক সিজন। টানা অবরোধ আর পেট্রোল বোমার আক্রমণে রাস্তায় বের হওয়াটাই তখন আতংক। আর ট্রাক-বাস হলে তো কথাই নেই। সেই সময়টাতে আমাদের হাতে থাকা অর্ডারগুলো ডেলিভারি দিতেই হবে কিন্তু কোন ট্রাক-ট্রেইলার ড্রাইভারই তাতে রাজী হচ্ছিল না। তাদের চেয়েও বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো আমাদের নিজ প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র বসরাই। তাদের একই কথা, যদি কিছু হয় তাহলে দায়িত্ব কে নিবে, তুমি? ওদিকে আমি আছি বায়ারদের চাপে কারণ এলসিতে দেওয়া টাইমের মধ্যে ডেলিভারি না দিলে অর্ডার ক্যানসেলও হয়ে যেতে পারে, ফলে বানানো পন্যটা চলে যাবে নিজেদেরই লসের খাতায়। সেক্ষেত্রেও ডেক্সের দায়িত্বে থাকায় দোষ হবে সব আমার।

অগত্যা আমি বিকল্প চ্যানেলে এসওএস মেসেজ পাঠালাম আমাদের গ্রুপ চেয়ারমান স্যারের কাছে, জানালাম প্লাস-মাইনাস সব বিষয়। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন, বললেন, আগুনে পুড়ে গেলে কী আর করা যাবে? যদি আগামী একবছর এই অবরোধ চলে তাহলে কী করবে? ব্যবসা তো আর বন্ধ করা যাবে না, সো গো এহেড। পরক্ষনেই আমি ট্রান্সপোর্ট এজিন্সির ম্যানেজারকে ডেকে বললাম, ড্রাইভারদের বলে দেন, কেউ যদি তাদের চলতি পথে ট্রাক থামাতে সামনে দাঁড়ায় অথবা পেট্রোল বোমা মারতে চায়, তাহলে তারা যেন "ট্রাকে ব্রেক না চাপে আর তেনারা যদি রাস্তার পাশে থাকে তাহলে যেন একটা ডলা দিয়ে যায়"। এছাড়াও সব ট্রাককে একসাথে দিনের বেলায় চলতে বলুন। সাথে রাখুতে বলুন বালি আর জল। যেন একজন বিপদে পরলেও অন্যরা তাকে হেল্প করতে পারে। এই কথায় ড্রাইভাররা সাহস পেলেন, আমি দিলাম সেই মাসেই ৫০টার বেশী ট্রেলার শীপমেন্ট যা গেছে সেই সময়ের আতংকের জনপদ সীতাকুন্ডুর উপর দিয়ে আর অনেকগুলো ট্রাক গেছে বেলাপোলে। আমাদের একটা গাড়ীও সেই সময়ে তেমন ক্ষতির শিকার হয়নি, ঢিলে কয়েকটার গ্লাস ভাঙ্গা ছাড়া।

৫) বায়ার খুঁজে বের করতে হবে। সামান্য একটা ছোট সুযোগও হাতছাড়া করা যাবে না। একটা ইমেইল এড্রেসও ব্যবসার একটা বড় দরজা খুলে দিতে পারে। এমনকি একটা বায়ার ডেভেলপ করতে বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে।

৬) সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যেন বিদেশী ক্রেতারা ভাবে হ্যাঁ, এই লোকটার উপর বিশ্বাস রাখা যায়। কারণ তাকে কোটি টাকার ঝুঁকি নিতে হবে।

৭) বিদেশের বাজারে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমনিতেই অনেক নেগেটিভ ভাবধারা রয়ে গেছে। শুধুমাত্র ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উপস্থাপনাই পারে এই ডেডলককে ভেঙ্গে ফেলতে।

8) যোগাযোগের ক্ষেত্রে হতে হবে দুর্দান্ত স্মার্ট। যেকোন সময়ই বায়ারের কল বা মেসেজ আসতে পারে। তাই রেডি থাকতে হবে তাকে তখনই সঠিক তথ্য প্রদানের জন্য। অথবা তাকে ম্যানেজ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। অন্যথ্যায় তাদের পরের মেসেজটা যাবে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অথবা সিইও'র কাছে। যা একজন কর্মীর জন্য সুখকর নাও হতে পারে।

৯) অনেকে বলে আমি সেলসে কাজ করি আমি কেন প্রোডাকশন বুঝতে যাবো? আবার প্রোডাকশনের অফিসার বলে, আমি কেন ফরেন পারচেজের খবর নেব? এই ধারণা এখন অচল। নিজের আপগ্রেড চাইলে কমবেশী সববিষয়েই নিজেকে আপডেট রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নিজের কথা বলি, আমি শতভাগ ফরেন সেলসের লোক হওয়া সত্যেও আমার মূলশক্তি প্রোডাকশন ও কোয়ালিটি কন্ট্রোলে। আর এরই কারনে আমার বায়াররা আমার উপর শতভাগ নির্ভর করে। দিনের পর দিন সবার সাথে মিশে এগুলো আমাকে শিখতে হয়েছে।

১০) সবশেষে, কাজ, আর্থিক ও চারিত্রিক দিক থেকে শতভাগ সৎ হতে হবে। এক্ষেত্রে নিজের আরও একটা উদাহরণ দেই-

বছর পাঁচেক আগে আমার এক বায়ার, আমার কাজের আওতা দেখে একদিন গাড়ীতে চলতে চলতে বললেন, সুকান্ত, আমি যদি চাই একটা শীপমেন্ট ভারত থেকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে চিনে যাবে, ব্যবস্থা করতে পারবেন? বললাম, এটা আমার কাছে ডাল-ভাত। তা কী পাঠাবেন? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আপনি পারবেন সেটা জানি কিন্তু শীপমেন্টটা 'ফুলপ্রুফ' হতে হবে। তার কথায় সন্দেহ হলেও বুঝতে না দিয়ে বললাম, যাবেটা কী? উত্তরে তিনি বললেন, মাত্র একটা শীপমেন্ট পার করে দিবেন, আপনাকে কিছুই করতে হবে না শুধুমাত্র সুপারভাইস করবেন। আর এই একটা কাজেই আপনাকে আর চাকুরী করতে হবে না। রাজী আছেন? বললাম, না! আমি রাজী নই!

এই নিয়মগুলো মানলেই এবং লোভ ছাড়লেই- সেই চাকুরীটা আপনাকেই খুঁজবে।

সো, আপগ্রেড চাইলে নিজেকে আপডেট রাখা চাই!

২৩/০৬/২০১৭