ছুটির দিনের রান্না

সুকান্ত কুমার সাহা
Published : 29 June 2017, 01:35 PM
Updated : 29 June 2017, 01:35 PM

মনে আমার অনেক ইচ্ছে ছিল কিন্তু তার বেশীরভাগেরই 'ইচ্ছে পূরণ' হয়নি। সবচেয়ে বেশী মার খেয়েছি বড় বড় ইচ্ছেগুলিতে। বলতে গেলে বলতে হয়- বড় ইচ্ছেগুলোর একটাও পূরণ করতে পারিনি। তারপরেও আমি চেষ্টা করি ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো- যা এখনো হাতের কাছে পাওয়া যায়- তা পূরণ করতে। তারই একটা হলো নিজে রান্না করা।

হ্যাঁ, এই শখটা আমার সেই ছোটবেলা থেকেই ছিল। যখন বাড়ী-ঘরের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে চুপিচুপি মাটির খুঁটি-মুচি দিয়ে খেলতাম, ঠিক তখন থেকেই। সেই সময়গুলোতে আমার সাথে থাকতো ছোটবেলার সেই খেলার সাথীরা। সেই সময় আমরা যার যার ঘর থেকে চাল-ডাল চুরি করে নিয়ে এসে জোলামুনি খেতাম। অনেক সময় এতে দিদিরাও ভাগ বসাতো। কখনো কখনো দেখা যেত পাড়ার খুদেদের ছোট একটা জোলামুনির আয়োজনই দিদি-দাদাদের যোগে বড়সড় একটা পিকনিকের রুপ নিতে। আজ সেই পাড়াও নেই সেই বন্ধুরা নেই।

ঈদের ছুটি হয়েছে। আমিও অনেক দিন পর একটা বড়সড় ছুটি পেয়েছি। তাতে আমার খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল কিন্তু দেখা গেল মনের ভিতরে সেই খুশির রেশটা তেমন একটা বড় হচ্ছে না। এর কারণও আমার জানা। গত দুই বছরে আমি বলতে গেলে ছুটিই পাইনি। নতুন চাকুরীতে এসে হঠাৎ করেই ছুটি পেয়ে যাওয়ায় আমি একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছি। তাছাড়া এই ছুটিতে আমি কী করবো, কোথায় যাবো তার কোন পূর্ব পরিকল্পনাও নেই। আর আছে রাস্তায় জ্যামের ভয়। এরই কারনে কোথাও যেতেও ইচ্ছে করে না।

মেয়ের স্কুল ছুটি হয়েছিল অনেক আগেই। রূপাও বাবার বাড়ী বেড়াতে যেতে চাচ্ছিল। ছেলেটার হঠাৎ করেই জ্বর হওয়ায় চিকিনগুনিয়ার আতংকে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর সে সুস্থ হলে, গত পরশু মহাখালীর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে তুলে দিয়ে ওদের মামার বাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছি। তারপর থেকেই আমি বাসায় একা। এরই মধ্যে প্ল্যান করেছি- এই ছুটিতে ফ্যাক্টরিতে থাকবো, কারণ সেখানে আমার এই চাকুরীর প্রথম বৈদেশিক অর্ডারের প্রোডাকশন শুরু হবে। এবং আমি নিজে থেকে সেখানে এর মনিটরিং করবো। যাতে করে তাতে কোন ভুল না হয়।

প্রতিবার রূপা বাসায় আমাকে একা রেখে কোথাও গেলেই পই পই করে বলে যায় আমি যেন তার কোন বাসনকোসন নোংরা না করি। এবারো তার ব্যতিক্রম হলো না। এমনকি বাবার বাড়ীতে থেকেও সে ফোনে আমাকে মনিটরিং করছে, স্পেশালী রান্নার বিষয়ে। ও জানে, সে না করলেও এই একটা কথা আমি শুনবো না। রান্না আমি করবোই। আর ওর মনিটরিং এর উদ্দেশ্যই হলো কী রান্না করছি তা জেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী ঘরের কোথায় কোন কোন জিনিসটা পাওয়া যাবে তা বলে দেওয়া।

ওরা বাসায় থাকা অবস্থায়ও আমি মাঝে মাঝে রান্না করি। সেই সময়ে আমাকে রান্না করতে দেখে আমাদের বাচ্চাদুটো খুব মজা পায়। মায়ের ধমক খেয়েও ওরা সারাক্ষণ আমার সাথে লেগে থাকে। আর আমার ফুট ফরমায়েশ খাটে। কে আগে কোন কাজটা করবে সেটা নিয়েও দুই ভাইবোনের মধ্যে ঝগড়া লাগে। যার কারনে তারা ফাও হিসেবে মায়ের হাতে আবার উত্তমমধ্যমও খায়। তারপরেও ওরা বাবার কাজে সবচেয়ে বেশী আনন্দ পায়।

আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলেও ঈদের ছুটি হয়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই আমি বেকার। প্রতিদিনের মত খুব ভোরেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, এদিকে বাসায়ও কেউ নেই। ঢাকায় থাকা বন্ধুরাও সব যে যেদিকে পারছে ছুটছে। বাসায় শুয়ে শুয়ে ফেসবুকে তাদের চলতি পথের টাইম টু টাইম আপডেট পাচ্ছি। তারপর হটাৎ করেই আড়মোড় ভেঙ্গে উঠে পড়লাম। দুধ চা বানিয়ে খেতে খেতে প্ল্যান করলাম এই ছুটিতে ব্লগে কমপক্ষে দশটা পোষ্ট দেব। ল্যাপটপ চালু করলাম। হটস্পট দিয়ে নেটে ঢুকলাম।

মাথায় অনেক চিন্তা পেন্ডিং। ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কোন বিষয়ে লিখবো। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি আকাশে মেঘ। তা দেখেই রান্না করার ঝোঁক চেপে বসলো। রান্না ঘরে যেয়ে দেখি রূপা আমার জন্য প্রায় সবকিছুই সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে গেছে। তা দেখে ঝোঁক আরও বেড়ে গেল। কী রান্না করবো তা নিয়ে না ভেবেই সোফার নিচে রাখা ঝুড়িটা বের করে তা থেকে পেঁয়াজ-রসুন নিয়ে কাটতে বসে গেলাম। ঠিক সেই সময়ই, আমাদের প্রিয় ব্লগার কাজী বদনা চেয়ে আমাকে তাগাদার মেসেজ পাঠালো। আমিও কিছুটা রাগত স্বরে তাকে উত্তরে জানালাম, "খিচুড়ি রান্না করছি, নো ডিস্টার্ব।" আর সেই মেসেজ থেকেই ঠিক করলাম, আজ খিচুড়িই রান্না করবো। ফ্রিজে দেখেছিলাম একটা ডিমও আছে। তারপরের চ্যাপ্টারগুলো এক এক করে ছবিতে দেখে নিন।

রান্নার শুরু হয়েছে পেঁয়াজ ছোলা দিয়ে, তারপর রসুন। কাঁচা মরিচ কাটলেও চলে, আবার না কাটলেও চলে। তবে কাটলে ঝাল দ্রুত বের হবে, না কাটলে খুচুড়ী তা নিজেই চিবিয়ে বের করে নিবে। আমি আবার ঝাল একটু বেশীই খাই। তাই ছবিতে কাঁচামরিচের আধিক্য দেখা যাচ্ছে।


ঈদের ছুটি সবাই যেহেতু ঢাকার বাইরে যাচ্ছে; তাই এই সুযোগে বন্ধুদের ডেকে বাসায় আড্ডা বসাবো তারও চান্স নেই। ভেবে নিলাম আজ একজনের জন্য রান্না করবো, আর খাবো শুধুই আমি।


যাদের হঠাৎ হঠাৎ আমার মত রান্না করার শখ হয় এবং নিজের কাজ, কাজের বুয়াকে দিয়ে না করিয়ে নিজেই করেন, তাদের ফ্রীতে একটা উপদেশ দেই। ধরেন, দা দিয়ে কাঁচামরিচ কাটতে বসেছেন হঠাৎ করেই আপনার ছোট-বড় টয়লেটের যেকোন একটা চেপে গেল। আপনাদের বলছি, ভুল করেও হাত দুখানা ভাল করে সাবান দিয়ে না ধুয়ে টয়লেট সারবেন না। বিশেষ করে বাঁ হাতটা। এই সুবুদ্ধি আপনাদের কেউ দিবে না, কেকাফাও না।


সবজী কাটা ও তার প্রেজেন্টেশন হলো একটা আর্ট। এই আর্টই নির্ধারণ করে দেয় কে হবে মাস্টার সেফ। আমার অবশ্য অত জ্বালা নেই। নিজের মন যেভাবে চায়, সেভাবেই সবজি কাটি। তবে যদি মাথায় রাখেন, আজ যা যা করবেন তার প্রতিটা ধাপের ছবি ফেসবুকে দিয়ে বন্ধুদের কাছে পাইট নিবেন? তাহলে কিন্তু ভাল করবেন। দেখবেন কাজটা করতে আপনার আমার মতই ভাল লাগছে। এক একটা লাইকে দ্বিগুণ উৎসাহ পাচ্ছেন। "রান্না করাটা বুয়াদের কাজ"- এটা আপনার মনেই হচ্ছে না! আর রান্নাটা যদি আমার পুরুষ বন্ধুরা করতে থাকেন, তাহলে দেখবেন পাশের ফ্লাটের সুইট, সুইট ভাবীরাও আপনার প্রশংসা করছে। এতে করে আপনার ভাল লাগাটা আরও বেড়ে যাবে। "সামনের ছুটিতে বাসায় একা থাকলে সুইট ভাবীদের একজনকে নিমন্ত্রণ করে আপানার রান্না খাওয়াবেন"- এটা ভেবে ভেবে পুলকিতও হতে পারবেন।


সেই হাওয়াযুগে রাজপুত্রের কল্যাণে 'লন্ডনের টমি মিয়া' শেফ হিসেবে এই বঙ্গদেশে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। ঠিক তখনই জেনেছিলাম, শুধু সবজী কাটা নয়, রান্নার মসলা সাজানোও একটা আর্ট। বিষয়টা এতদিন মাথায় না নিলেও আজ নিলাম কারণ ওই একটাই, লাইক কামানো। সদ্য নেপাল থেকে কিনে আনা কাঁসার থালাটাকে কাজে লাগালাম। কিন্তু সাজাতে গিয়ে দেখি এলাচি নাই। ঘরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেটা পেলাম না। ফলে একটা খুঁত রেখেই থালাটা সাজালাম। যদিও আমি জানি, না বললে এত সহজে আপনারা সেটা ধরতে পারতেন না। কিন্তু আমি ভাই সব বিষয়েই অনেস্টি দেখাই। এটা অবশ্য একটা রোগ।


হারাধরনের একটা ছেলের মত ফ্রিজে একটা ডিম থেকে গেছে। ছুটির দিনগুলোতে আমি আবার দুই ডিমের মামলেট খেতে পছন্দ করি। যদিও তাতে ডাক্তারের মানা আছে, পাশাপাশি রূপাও এতে চোখ রাঙায়। অবশ্য সেসবে ভ্রূক্ষেপ করার মত পোলা আমি না। কিন্তু নিচে নেমে ডিম কিনে আনতে মনের সায় পেলাম না। বেসিক্যালী আমি একটা অলস মানুষ। তাই এক বৌয়ের মত এক ডিমেই সন্তুষ্ট থেকে সেটা ভেঙ্গে ফেললাম, বেছে নিলাম নেপাল থেকে কিনে আনা পিতলের বাটিটাকে। কারণ এতে ছবিটা ভাল দেখাচ্ছে। ছবি তোলার সময় মনে মনে ভাবলাম, ক্যাপশন ছাড়া এই ছবি ফেবুতে পোষ্ট দিলে অনেকেই এটা কি তা জানা সত্যেও বাটিটাকে 'সোনার বাটি' বলে ত্যানা পেছাবে। আমিও তখন স্পষ্ট করে কিছু না বলে পোস্টে লাইক-কমেন্ট বাড়তে পারবো। যেই ভাবনা সেই কাজ। ক্লিক।


ডিম ভেঙ্গে সরাসরি কড়াই-এর গরম তেলে ছেড়ে দিলে যেটা হয় সেটাকে বলে ডিম পোচ। আমার পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ঘুটে তেলে ছেড়ে দিলে যেটা হয় সেটাকে বলে অমলেট কিন্ত আমরা বাঙালরা বলি মামলেট। তবে যেটাই হোক না কেন, ডিম ভাজাটাও কিন্তু একটা আর্ট। আর খিচুড়ির সাথে এটা মানায়ও বেশ। এ যেন 'বৌয়ের সাথে শ্যালিকা ফ্রী'র রেসিপি-কম্বিনেশন।


এবার আসা যাক মূলপর্বে। আমি রেসিপি সাজিয়েছি 'মুসুর ডালের ভুনা খিচুরী'র, কিন্তু চাল নেওয়ার পর ডাল নিতে যেয়ে দেখি মুসুর ডাল নেই। বৌয়ের সব ভান্ডার ঘাঁটাঘাঁটি করেও সেটা পেলাম না। অগত্যা মুগের ডাল নিলাম। "মসুরের ডালের রেসিপিতে মুগের ডাল দিলে স্বাদ হবে না" এই ভাবনা সম্ভবত আপনাদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই, এটা আমিও ভেবেছি, আবার এটাও ভেবেছি, "খাবো তো আমিই।" সো, চিন্তা করবেন না। আর রান্না জানলে নুডলস দিয়েও খিচুড়ি রান্না করা যায়। এমনকি কেকাফা নুডলস দিয়েও ডিম পোচ বানায়। জানেন তো- তিনি হলেন আমাদের 'বস রাঁধুনি'! সামনের নোবেলটা তার জন্য খাড়া।


সর্ষে তেলে যখন পেঁয়াজ, রসূন, আলু, তেজপাতা, লবন, শুকনো ও কাঁচা মরিচ ঢেলে তাতে মসল্লা দিয়ে ভেজে নিচ্ছিলাম, ঠিক তখনই তা থেকে দারুণ একটা ফ্লেভার উঠে আসছিল। একই সাথে ঝাঁজে চোখ-নাক পুড়লেও যেহেতু ছবিটা ফেবুতে দেব, তাই বেশ আরামও লাগছিল। বলছিলাম কী, জীবনে যাই কিছু আমরা করি না কেন, তারজন্য একটা মোটিভেশন দরকার। আগের যুগে যাই হোক না কেন, এযুগের মোটিভেশন হচ্ছে ফেবুর লাইক। মনে রাখবেন বিষয়টা।


মসল্লার ভুনাতে এবার চাল-ডাল মিশিয়ে খিচুড়ির ফাইনাল স্টেজের কাছাকাছি চলে এলাম। এটা যখন ভাজা ভাজা হচ্ছিল সেই সময়টায় আমি কতটুকু জল দেব তা মেপে নিচ্ছিলাম। আমি সাধারণত ভাত রান্নার সময় চালের উপর মধ্যম আঙ্গুলের তিন কড় পর্যন্ত জল দেই। তাতে করে ভাতের ফ্যান ফেলতে হয় না, আর ভাতও ঠিক ঠিক হয়ে যায়। আজ যেহেতু খিচুড়ি রাধছি, তাই এতে জল একটু বেশী দিয়ে ঢেকে দিলাম।


পাশের চুলায় একই সাথে আলু আর পেঁয়াজ দিয়ে একটা ঝাল সবজি রান্নায় হাত দিলাম। ভেবে দেখলাম, এতে স্বাদ বাড়বে। খিচুড়ির সাথে এটা যায়ও ভাল।


একটা লম্বা সময় ধরে রেসিপি নিয়ে কেরিকেচারের পর, আমার প্রিয় 'ভুনা খিচুড়ি'টা রেডি হয়েছে। হাতের কাছে স্মার্ট ফোনটা রেখে ঈদের ছুটিতে আপনারাও ট্রাই করুন। নিজের কাজ নিজে করুন, আর ফেবুতে সর্বদা আপডেট থাকুন। আমিও আছি আপনাদের সাথে লাইক-কমেন্ট নিয়ে।

সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

২৪/০৬/২০১৭