সাংবাদিকতার অন্তরালে মাল্টিলেভেল ফোকাসড সাংবাদিকতা!  

সুমিত বণিক
Published : 6 Jan 2016, 07:32 PM
Updated : 6 Jan 2016, 07:32 PM

এক.

জনৈক বেসরকারী কর্মকর্তা খুব চিন্তিত হয়ে আসলেন এক সাংবাদিকের কাছে। তিনি বললেন, ভাই আগামীকাল আমার ডিরেক্টর স্যার আসবেন। হঠাৎ করে জানালেন একটা আলোচনা সভার আয়োজন করতে হবে। এর মধ্যে আবার অনলাইন, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, আবার আঞ্চলিক পত্রিকার প্রতিনিধিসহ। তাও আবার সন্তোষজনক সংখ্যক মিডিয়া কাভারেজ থাকতে হবে। বলেন ভাই, এত অল্প সময়ে আমি মাল্টিলেভেল মিডিয়া কাভারেজ আর এই চার ক্যাটাগরির সাংবাদিক কোথায় পাই? মাঝে মাঝে না মনের দুঃখে চাকরিটাই ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে। বস'রা যে আমাদের কি ভাবে! সাংবাদিক তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ভাই আমি থাকতে আপনার এত চিন্তা কিসের? আমি চারটিরই সাংবাদিক। আমার চারটিরই কার্ড আছে। এই দেখেন। বেসরকারী কর্মকর্তা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি বললেন, ভাই আমাওে আপনি বাঁচাইলেন। সাংবাদিক বললেন, ভাই কি করবো, আপনাদের সেবার জন্যই তো আমাদের এই বিশেষ আয়োজন। আপনারা যেমন ক্যাটাগরি খুঁজেন, তাই আমাদেরকেও তো ক্যাটাগরি অনুযায়ী সার্ভিস রাখতে হয়। একের ভিতর চার সেবা। বেসরকারি কর্মকর্তা তখন বলেই ফেললেন, ভাই আপনারাও তো দেখা যায় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হয়ে গেছেন। সব সেবা এক জায়গাতেই দিচ্ছেন। সাংবাদিক বললেন, যুগের চাহিদা! না দিয়েও তো পারি না। ধরেন, আমায় আজ আপনি আপনাদের অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলেন, সবশেষে বলে দিলেন, ভাই নিউজটা যেন আপনাদের জাতীয় পত্রিকায় দেখতে পাই! কিন্তু অনেক সময় সঙ্গত কারণেই জাতীয় পত্রিকায় এসকল আঞ্চলিক খবর প্রকাশ পায় না। সে ক্ষেত্রে আমাদের কে লজ্জ্বায় পড়তে হয়। আর সেই লজ্জ্বা ঢাকতে, আমাদেরও তো একটা অস্ত্র দরকার! আর আমাদের এ কৌশলের কারণে নিউজটা একটা না একটা তে তো প্রকাশ পায়ই। তাতে আপনারাও খুশি, আমরাও খুশি।

দুই.

মফস্বল এলাকার একজন ব্যবসায়ী। শুধু তাই নয়, একাধিক পেশার সাথেও তিনি সম্পৃক্ত। সাথে সাথে সেই পেশার পেশাজীবি সংগঠনের দায়িত্বশীল পদেও আসীন। পাশাপাশি, স্থানীয় সাংবাদিক সংগঠনেরও তিনি দায়িত্বশীল পদে আসীন। যেই পত্রিকায় তিনি প্রতিনিধি হিসেবে আছেন, সেই পত্রিকার প্রকাশিত সংখ্যা এলাকার কেউ গত বিশ বছরে দেখেছে কিনা, তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ! তবু তিনি সাংবাদিক ! কিন্তু তিনি তার অন্যান্য পরিচয়ের চেয়ে সাংবাদিক পরিচয়ে পরিচিত হতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য প্রকাশ করেন। কিন্তু শিক্ষিত ও ভদ্র সমাজে তার উপস্থিতি নিয়ে একটু বিতর্ক আছে বৈকি! সর্বোপরি, তিনি আদৌ 'সাংবাদিক' কিনা, সে বিষয়েও রয়েছে নানা জনের নানা সংশয়। তবে সর্বজন স্বীকৃত সেই সার্টিফিকেটটি পাওয়া এবং জনসম্মুখে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এখন আর কষ্টসাধ্য বিষয় নয়। আর এই ডিজিটাল যুগেতো আরো না। সম্প্রতি একটি কালচার বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সেটি হলো যেকোন ডকুমেন্ট ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে নিজের অর্জন সম্পর্কে জানান দেয়া। আর সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এ সুযোগটির অনুঘটক হলো, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। প্রথা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে গণমাধ্যমের অংশগ্রহণও জোড়ালোভাবে সমর্থন করে। এক্ষেত্রে কমিশন নিরাপত্তার স্বার্থে সাংবাদিকদের পরিচয় পত্রসহ 'সাংবাদিক' লেখা কার্ড ইস্যু করে। এখন অনেকেই জানেন না যে ইনি সাংবাদিক কি না! কিন্তু নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল প্রতিনিধি প্রদত্ত কার্ডের পরিচিতি তো আর মিথ্যা হতে পারে না! আর এটি নিয়ে প্রশ্ন তোলারও অবকাশ থাকে না! অবশেষে উনি সকলের কাছে আত্মপ্রচারের জন্য প্রাপ্ত 'সাংবাদিক' পেশার পরিচয় পত্রটি ফেসবুকে আপলোড করলেন, নির্বাচনের দিন ভাব দেখানো শো-ডাওন করে প্রমাণ করলেন উনি একজন 'সাংবাদিক'।

উপরোক্ত ঘটনাগুলো কোন রংয়ের সাংবাদিকতা, সে বিষয়ে আমি নিজেও কিছুুটা সন্দিহান। তাই নতুন নামকরণে ব্যাখা করার অপপ্রয়াস মনে হতে পারে। বিষয়গুলোর অবতারণা মহান সাংবাদিকতা পেশাকে ভ্রুক্ষেপ করে নয়। বরং সাংবাদিকতা পেশা সম্পর্কে আমাদের বর্তমান অভিব্যক্তি পাশাপাশি এই সাংবাদিকতা পেশার সুবর্ণময় সোনালী ঐতিহ্যের সাথে আমাদের সাংঘর্ষিক অবস্থান কে বুঝাতেই, এই বাস্তব ঘটনার বর্ণনায়ন। আমি সাংবাদিকতার গৌরবময় ইতিহাসকে স্মরণ করাতে চাই। সাংবাদিকতার গুণগত উৎকর্ষতা চাই। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এ ব্যাপারটাতে আমরা অনেকেই উদাসীন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সাংবাদিকতার বিভিন্ন পেশাগত দিক উন্নয়নে বেসরকারী সংস্থাগুলো বিষয়ভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। যা অনেক ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেও পাওয়া যায় না। সাংবাদিকতা পেশাকে আজীবন সম্মানের পেশা হিসেবে জেনে এসেছি, সেই জানাটাকে ধারণ করেই বাঁচতে চাই। বিশ্বাস করি, মাল্টিলেভেল ফোকাসড সাংবাদিকতায় আত্মপ্রচার সম্ভব, কিন্তু প্রকৃত সাফল্য বা সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব নয়। মানুষ তাদেরকেই আজীবন শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে, যারা আত্মপ্রচারের যুগেও সত্যিকার অর্থে কল্যাণমুখী ও দায়িত্বশীল এবং সৎ সাংবাদিকতার জন্য নিজের কলম ও মেধাকে উৎস্বর্গ করেছে।

সুমিত বণিক, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

মহাখালী, ঢাকা।

sumitbanikktd.guc@gmail.com