ঐতিহ্য আর কালের সাক্ষী কটিয়াদীর শ্রী শ্রী গোপীনাথ মন্দির

সুমিত বণিক
Published : 22 July 2016, 07:56 AM
Updated : 22 July 2016, 07:56 AM

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার আচমিতা্ ইউনিয়নের ভোগবেতালে অবস্থিত শ্রী শ্রী গোপীনাথ মন্দির। প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক এই মন্দির অত্র এলাকার সনাতন ধর্মালম্বীদের এক জনপ্রিয় তীর্থস্থান। সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে ১৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির নির্মাণ করেন। কিংবদন্তী আছে,ঊড়িষ্যার শ্রী শ্রী জগন্নাথ,বঙ্গের শ্রী শ্রী গোপীনাথ। মন্দিরে প্রায় ষোড়শ শতাব্দী থেকে শ্রী শ্রী গোপীনাথ, বলরাম ও শ্রী শ্রী শুভদ্রার সেবা পূজা আজও চলে আসছে।

জনশ্রুতিতে আছে, ষোড়শ শতকের বাংলার বার ভূঁইয়ার অন্যতম এবং প্রধান ভাটি রাজ্যের অধিপতি ঈশা খাঁ। তৎকালে তার এগারসিন্দুর দূর্গ হতে মন্দির সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে জঙ্গলবাড়ি যাওয়ার পথে থেকে মন্দিরের ভোগ আরতির সুঘ্রাণে মুগ্ধ হয়ে যাত্রা বিরতি করেন এবং এই মন্দিরের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে জঙ্গলবাড়ীর দেওয়ান বীর ঈশা খাঁ মন্দিরের জন্য লাখেরাজ জমি দান করেছিলেন। আর তখন থেকেই এলাকার নামকরণ করা হয় ভোগবেতাল।

১৫৯৫ সালে এগারসিন্দুর দূর্গে ঈশা খাঁ সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ কর্তৃক এগারসিন্দুর দূর্গে অবরুদ্ধ হন। বিজয়ী সৈন্যরা জয়ের বিজয় উল্লাস করেন বর্তমান রথমেলার প্রশস্থ রাস্তায়। ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে মূল মন্দিরটির তৎকালীন পঞ্চরত্নসহ বিধ্বস্ত হয়।

ষোড়শ শতকের দিকে কিশোরগঞ্জের কবি নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস গ্রন্থে পাওয়া যায়, মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য দেব পাকুন্দিয়ার এগারসিন্দুর হয়ে আচমিতার বৈষ্ণব লক্ষ্মীনাথ লাহিড়ীর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ৩/৪ দিন ভোগবেতাল মন্দিরে নাম সংকীর্তন পরিবেশন করেছিলেন। ১২১৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা 'উদ্বোধন' বিশ্বেশর দাস গুপ্তের লেখা প্রতিবেদনেও তৎকালীন গোপীনাথ বাড়ী সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য ধারণা করা যায়।

জানা যায়, ৪২০ বছর পূর্বে শ্রী শ্রী গোপীনাথ মন্দিরের কাছে বাউল সাগর নামক নদীতে বিভিন্ন জায়গা থেকে বজরা এবং নৌকার বহর আসত। এককালে মন্দিরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো এই বাউল সাগর নদী।

জনশ্রুতিতে রয়েছে,'প্রেম ধর্ম প্রচারক চৈতন্যদেবের সমসাময়িক তাঁরই ভক্ত শিষ্য পুরী নিবাসী জগন্নাথদেব এক রাতে স্বপ্ন দেখেন তার স্বগৃহে প্রতিষ্ঠিত গোপীনাথ বিগ্রহ তাকে বলছে,'জগন্নাথ আমাকে নিয়ে তুমি দক্ষিণ দেশে যাও এবং প্রেম ধর্ম প্রচার কর'।

জগন্নাথ পরদিনই কাল কাঠ খোদাই ছোট বিগ্রহটি কাপড়ে জড়িয়ে দক্ষিণ দেশে রওনা হন। প্রায় মাসাধিকাল পথ চলার পর একরাতে জগন্নাথ আবার স্বপ্ন দেখেন গোপীনাথ বলছে জগন্নাথ আর যেও না, এখানে আমাকে প্রতিষ্ঠা করে প্রেমধর্ম প্রচার কর। ঘুম থেকে জেগে জগন্নাথ চিন্তায় পড়েন। এই গভীর অরণ্যে তিনি কি করে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করবেন।

এই স্থানটি গভীর বনে আচ্ছাদিত থাকলেও অতি নিকটেই এ অঞ্চলের সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ের প্রাসাদ বাড়ি। জগন্নাথ রাজা নবরঙ্গ রায়ের প্রাসাদ বাড়িতে গমন করেন এবং বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজার সহযোগীতা চান। রাজা নবরঙ্গ রায় বিগ্রহ মন্দিরসহ বেশ কয়েকটি দালান নির্মাণ করে দেন।

গোপীনাথ বাড়ির ভূমির পরিমাণ ২৫ একর ৮ শতাংশ। ৪২০ বৎসর পূর্বে পূর্ববঙ্গে সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ রথযাত্রা শুরু হয়। ১০৫ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ৩২ চাকার রথ ১ কিঃ মিঃ দীর্ঘ নিজস্ব সড়কে গুন্ডিচাবাড়িতে (শ্বশুরবাড়ি) মন্দির থেকে গোপীনাথ মন্দির পর্যন্ত ভক্তবৃন্দ আনা-নেয়া করতো।

তিনটি রথের একটি পিতলের অন্য দুটি কাঠের তৈরি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মধ্যে এটিই একমাত্র দূরপাল্লার রথযাত্রা ।

কালক্রমে ২৪, ১৬ এবং বর্তমানে ৯ চাকার রথটি তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত হতে অসংখ্য দর্শনার্থী ও পূণ্যার্থী এই ঐতিহাসিক নিদর্শন পরিদর্শনে আসেন। এখানে বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

এখানে প্রতিবছর রথযাত্রা বার্ষিক উৎসব, দোল পূর্ণিমা, রাসযাত্রা, জন্মাষ্টমী, শিবরাত্রি, ঝুলনযাত্রা ও বাসন্তীপূজাসহ নিত্য পূজাপার্বণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

এখনো অতীত কারুকার্যের স্মৃতি আর বিভিন্ন দালান নিয়ে শ্রী শ্রী গোপীনাথ মন্দিরটি লোক ঐতিহ্য আর কালের সাক্ষী হয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে ।

যেভাবে যাবেন :
ঢাকা থেকে প্রায় ৯০ কিমিঃ উত্তর দিকে ঢাকা-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক। কটিয়াদী/আচমিতা বাসস্ট্যান্ডে নেমে ভাড়া ১৫/৩০টাকা রিক্সা অথবা সিএনজি। ঢাকা মহাখালী থেকে জলসিঁড়ি, উজান ভাটি অথবা রয়েছে বাংলার সয়েল। ভাড়া ১৫০ থেকে ২২০ টাকার মধ্যে। এছাড়া সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে যাতায়াত,অনন্যা সুপার, অনন্যা ক্লাসিক, ৩২ সার্ভিস অথবা গেটলক ৩২ সার্ভিস রয়েছে। যার ভাড়া ১৫০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে। ট্রেনেও করতে পারেন যাতায়াত। ঢাকা কমলাপুর রেল স্টেশন হতে ভৈরব হয়ে মানিকখালী রেলস্টেশন। পরে কটিয়াদী পর্যন্ত সিএনজিতে আসা যায়।

সুমিত বণিক,

উন্নয়নকর্মী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, ঢাকা।