ইনকিউবিটর নয়, মায়ের কাছে রেখেই সম্ভব অপরিণত নবজাতকের চিকিৎসা

সুমিত বণিক
Published : 15 Nov 2016, 01:19 AM
Updated : 15 Nov 2016, 01:19 AM

কোনো শিশু ৩৭ সপ্তাহ গর্ভে থাকার আগে জন্ম নিলে তাকে সময়ের আগে জন্মানো শিশু বা প্রিটার্ম বেবি বলা হয়। জরায়ুর ভেতর এসব শিশুর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত এবং জন্ম-ওজন কম হয়। সরকার পরিচালিত শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অব চাইল্ডহুড ইলনেস (আইএমসিআই)এর জরিপ অনুযায়ী, যত নবজাতক মারা যায় তাদের ১১ শতাংশই সময়ের আগে অল্প ওজন নিয়ে জন্ম নেয়া শিশু।

বছরে ৪ লাখ ৩৯ হাজার শিশু নির্ধারিত সময়ের আগে (অপরিণত) জন্মায় এবং নানা ধরণের জটিলতায় মারা যায় ২৬ হাজার। এ সংখ্যাটি ভূমিষ্ঠ মোট শিশুর ১৪ শতাংশ। বৈশ্বিক গড় জন্মের চেয়ে এটা বেশি। নবজাতক বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিণত অবস্থায় জন্মালেও খুব সহজ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। গর্ভকালীন উন্নত পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে অপরিণত শিশুর জন্ম রোধ করা যায়। চিকিৎসা সংক্রান্ত বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ল্যানসেটের তথ্য অনুযায়ী, অপরিণত জন্ম হওয়ার ফলে নানা জটিল রোগে ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই সবচেয়ে বেশি যে ১০টি দেশে এসব শিশু মারা যাচ্ছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। চিকিৎসকদের মতে, যেসব কারণে নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে তার প্রধান কারণ অপরিণত জন্মানো। বর্তমানে অপরিণত শিশুদের ৪৫ শতাংশ মারা যাচ্ছে। কিন্তু ২০০০ সালে এ মৃত্যুর হার ছিল ৩৬ শতাংশ।

অপরিণত শিশু জন্মানো বিশ্বে এখন অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো অপরিণত শিশু জন্ম রোধ ও এর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। অনেকেই মনে করেন অপরিণত শিশুকে বাঁচানোর জন্য ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের প্রয়োজন (আইসিইউ) কিন্তু তা এখন আর সত্য নয়। খুবই সহজ-সরল একটি পদ্ধতিতে সেবা এবং চিকিৎসা করালে এসব শিশু বেঁচে যায়। এই পদ্ধতিটি ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) নামে পরিচিত। আশার কথা হলো, বাংলাদেশে এ পদ্ধতি শুরু করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিউনেটালজি বিভাগ ও ঢাকা শিশু হাসপাতাল। ইনকিউবিটর নয়, মায়ের কাছে রেখেই অপরিণত শিশুকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে নবজাতককে মায়ের বুকের সাথে লাগিয়ে উত্তাপ দেয়া হয় এবং শিশুর প্রয়োজনে মা সময় মতো খেতে দেন। শিশুকে কখন খাওয়াতে হবে এটা মা সবার চেয়ে বেশি অবগত থাকেন। এভাবে মায়ের বুকের উত্তাপ ও প্রয়োজন মতো শিশুকে খাওয়ানোর কারণে শিশু দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃত একটি পদ্ধতি।

আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস-এর এক গবেষণা প্রবন্ধ সূত্র অনুযায়ী, অপরিণত শিশুদের অনেকেরই স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা হয়। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ বছরের নিচে ও ৪০ বছরের ওপরে যেসব নারী গর্ভধারণ করেন, তাঁরা অপরিণত শিশুর জন্ম দেন বেশি। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের এক গবেষণায় (প্রিভেনটিং প্রিটার্ম বার্থ অ্যান্ড নিওনেটাল মর্টালিটি: এক্সপ্লোরিং দ্য এপিডেমিওলোজি, কজেস অ্যান্ড ইন্টারভেনশনস) অপরিণত শিশুর জন্মের প্রধান কারণ মায়ের সংক্রমণ। এতে বলা হয়েছে, ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে সংক্রমণের কারণে মাতৃগর্ভে ২৮ সপ্তাহ থাকার আগে শিশুর জন্ম হতে পারে। গবেষণায় ম্যালেরিয়া ও ম্যালেরিয়ার কারণে রক্তস্বল্পতা ও গর্ভফুলে সংক্রমণ, সিফিলিস, অ্যাক্লামশিয়া, মায়ের অতিরিক্ত পরিশ্রম ও বায়ু দূষণের কারণে অপরিণত শিশু জন্মায় বলে উল্লেখ আছে।

সর্বোপরি, অপরিণত জন্মরোধে আমাদের সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আর এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে শুধু সরকার এর স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা চিকিৎসকগণই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন যারা তৃণমূল পর্যায়েও সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করছেন,সকলের মিলিত ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই পারে অপরিণত জন্ম রোধ করতে পাশাপাশি অপ্রত্যাশিতভাবে অপরিণতভাবে জন্ম নেয়া নবজাতকদের মায়ের কাছে রেখেই মায়ের বুকের সংস্পর্শে রাখার মাধ্যমে যে জটিল এ সমস্যার সমাধান সম্ভব, সেই মূল্যবান ক্ষুদ্র বারতাটুকু পৌঁছে দিতে হবে সকল সমাজের স্তরে। তাহলেই হয়তো অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেয়া নবজাতকটি তাঁর মায়ের বুকের কোমল অকৃত্রিম উষ্ণতায় ফিরে পাবে একটি স্বাভাবিক জীবনের পথ।

সুমিত বণিক, জনস্বাস্থ্যকর্মী
ঢাকা।
sumitbanikktd.guc@gmail.com