বাঙালির পৌষ পার্বণ ও সংক্রান্তি

সুমন দে
Published : 13 Jan 2017, 09:42 PM
Updated : 13 Jan 2017, 09:42 PM

প্রবাদ রয়েছে বাঙালির ১২মাসে ১৩ পার্বণ। পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ উৎসবের দিন। বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। এই দিন বাঙালিরা বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। তার মধ্যে পিঠা খাওয়া, ঘুড়ি উড়ানো অন্যতম। সারাদিন ঘুড়ি উড়ানোব পরে সন্ধ্যায় পটকা ফুটিয়ে ফানুস উড়িয়ে উৎসবের সমাপ্তি করে।  বাউল গান এই পার্বণের অন্যতম আকর্ষণ।

গ্রীষ্মকাল অতিবাহিত হলেই বর্ষা, বর্ষার পর শরৎ এভাবে হেমন্ত, শীত ও বসন্ত কাল আসতে থাকে। সেরকম বাংলা বারোটি মাসও আবর্তিত হতে থাকে। এই আবর্তনে প্রতিমাসের শেষ দিন অর্থাৎ যে দিন মাস পূর্ণ হবে সে দিনকে সংক্রান্তি বলা হয়। এভাবে বারোটি মাসে বারোটি সংক্রান্তির মধ্যে বিশেষ ভাবে পৌষমাসের সংক্রান্তি উল্লেখ্যযোগ্য এবং তাৎপর্যপূর্ণ। সংক্রান্তি অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সূর্যাদির এক রাশি হতে অন্য রাশিতে সঞ্চার বা গমন করাকেও সংক্রান্তি বলা যায়। সংক্রান্তি শব্দটি বিশ্লেষণ করলেও একই অর্থ পাওয়া যায়; সং+ক্রান্তি, সং অর্থ সঙ সাজা এবং ক্রান্তি অর্থ সংক্রমণ। অর্থাৎ ভিন্ন রূপে সেজে অন্যত্র সংক্রমিত হওয়া বা নুতন সাজে, নুতন রূপে অন্যত্র সঞ্চার হওয়া বা গমন করাকে বুঝায়। বাস্তবেও তা-ই দেখা যায়। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ এবং মীন এই বারটি একটির পর আরেকটি চক্রাকারে অবর্তিত হতে থাকে। রাশিচক্রস্থ দৃশ্যমান গমন পথ যাকে ইংরেজীতে ঊপষরঢ়ঃরপ বা ক্লান্তিবৃত্ত বলে; সেপথে সূর্য গমনের ফলে (জ্যোতিষতত্ত্বমতে) পৃথিবীর পরিমণ্ডলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। এভাবে পৃথিবী নানারূপে সঞ্চারের কারণে প্রাকৃতিক দৃশ্যপট প্রতিমাসে পরিবর্তিত হতে থাকে। পৃথিবীর পরিমণ্ডলে এধরনের পরিবর্তনের মধ্যে সনাতন ধর্মের অনুসারীগণের মধ্যে চারটি দিন উল্লেখযোগ্য। তন্মমধ্যে দুই অয়ন এবং দুই বিষুব দিন। দুই অয়ন হল উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন এবং বিষুব হল মহাবিষুব ও জলবিষুব। চৈত্র সংক্রান্তিতে মহাবিষুব ও আশ্বিন সংক্রান্তিতে জলবিষুব আরম্ভ হয়। উল্লেখ্য বছরে যে দুইদিন দিবা ও রাত্রি সমান হয় তাকে বিষুব দিন বলা হয়। বসন্তকালে যে বিষুব হয়, তাকে মহাবিষুব আর শরৎকালে যে বিষুব হয় তাকে জলবিষুব বলা হয়। মৎস্যপুরাণেও তাই বলা হয়েছে-

"মৃগকর্কটসংক্রান্তিঃ দ্বে তূদগ্দক্ষিণায়নে।
বিষুবতী তুলামেষে গোলমধ্যে তথাপরাঃ ॥"

অর্থাৎ সুর্য ধনুরাশি ত্যাগ করে মকর রাশিতে সঞ্চার হওয়াকে উত্তরায়ণসংক্রান্তি, মিথুনরাশি হতে কর্কটরাশিতে সঞ্চার হওয়াকে দক্ষিণায়ন সংক্রান্তি, কন্যারাশি হতে তুলারাশিতে সঞ্চার হওয়াকে জলবিষুবসংক্রান্তি আর মীনরাশি হতে মেষরাশিতে সঞ্চার হওয়াকে মহাবিষুব সংক্রান্তি বলা হয়ে থাকে।

নতুন বছরের কুয়াশা জড়ানো নতুন সকালে যখন সূর্য তার মৃদু আলোর রশ্মিগুলোকে ছড়িয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে—পাখপাখালিরা পালক ফুলিয়ে শরীরে টেনে নিচ্ছে উষ্ণতার হোমগাছেদের পাতায় পাতায় কেমন এক শিরশিরানি—ইউক্যালিপটাসের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশের গায়ে ঘুমন্ত পাহাড়পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এক আড়ম্বরহীন ন্সিগ্ধ আলো—সব মিলিয়ে এই শীত সকাল যেন এক হাতে আঁকা ছবি। কে এই শিল্পী? তিনি সকলের অগোচরেই থেকে যান। ধরা দেন না কিছুতেই। যখন খেয়াল হয় ছবি আঁকেন আবার বেখেয়ালে সে ছবি মুছেও দেন। 

পৌষ মাস বলে কথা। নতুন চালের গন্ধ, খেজুড় গুড় পাটালি—এ সব না হলে কি বাঙালির পালা-পার্বণ জমে? তবে এখন হল গিয়ে টাইম (ম্যানেজমেন্ট) মেশিনের যুগ। এখন কি আর শিলনোড়ায় চাল বেটে, ধৈর্য ধরে চাটুতে সরুচাকলি বা পাটিসাপটা তোলার সময় আছে—যার ভেতরে আবার প্রথম দু'দিনটে ভাল উঠবে না? এখন মিক্সিতে ফটাফট চাল গুঁড়িয়ে, নন-স্টিকিং তাওয়ায় চটজলদি পাটিসাপটা। অবিশ্য নারকেলটা সেই কুরুনিতেই কুড়িয়ে নিতে হবে। নারকেল কুড়োনোর মেশিন বাজারে এসেছে কি না জানা নেই। তা সে যাই হোক, সময় যতই এগিয়ে যাক, যতই পিত্‌জা-বার্গার

বাজার দখল করুক, পিঠে-পুলি আছে সেই পিঠে-পুলিতেই—আদি ও অকৃত্রিম বাঙালি।

মনে মনে ভাবি, স্বর্গত দিদিমাকে প্ল্যানচেট করে নিয়ে আসি এ সময়টায়—দিদিমার হাতের বড় চাটুর মাপের সেদ্ধ পুলি আর ঝোলা গুড় কিংবা দুধ পুলি। সে অনন্য স্বাদ ভুলতে পারি কই? আর মায়ের হাতের পাটিসাপটা নারকেলের পুর দিয়ে—অসাধারণ। সেই যে ছোটবেলায় সবাই মিলে গোল হয়ে বসে পিঠের স্বাদ নেওয়া। মা বলতেন, 'ওরে আর দুটো দেব রে?' পিঠে-পুলি মানেই আদরের, স্নেহের আর ভালবাসার স্পর্শ। খাওয়ার সঙ্গে এই মধুর পরশটুকু জুড়ে থাকত বলেই যেন তা হয়ে উঠত তুলনাহীন। বাঙালির পৌষ পার্বণের মিলন বন্ধন।