একজন শিক্ষকের মহাপ্রয়াণ

সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন
Published : 9 June 2016, 06:00 PM
Updated : 9 June 2016, 06:00 PM

আমার ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে সাতটা। ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে দেখি, দেশ থেকে তানিয়া কল দিয়েছে। তানিয়ার কল দেখেই বুঝতে বাকি থাকে না এত সকালে ওর ফোন দেবার কারণ। তবুও ফোনটা ধরি। `আশরাফ ভাইয়া, পনের মিনিট আগে আব্বু মারা গেছে'। তানিয়া আমার শিক্ষকের একমাত্র মেয়ে। বুঝতে পারি না কী বলব ওকে। কী সান্তনা দিব। আদৌ কি কোনো সান্তনা দেওয়া যায়।

চলে গেলেন আমার মহান শিক্ষক জনাব আবু তাহের ভুঁইয়া। প্রায় দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত এই পিতৃতুল্য শিক্ষকের হাত ধরে দেশে এবং দেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক ছাত্র।  তাহের স্যার ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। তাঁর শিক্ষকতায় ছিলনা ব্যবসায়িক প্রবণতা যদিও তিনি ছিলেন হিসাব বিজ্ঞান এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক।  নিস্বার্থ ভাবে দান করেছেন শিক্ষার আলো ছাত্রদের মাঝে। আর তাইতো অর্থ বিমুখ এই শিক্ষক ঢাকা শহরের প্রথম শ্রেণীর একটি স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক হওয়া স্বত্তেও সারা জীবন কাটিয়ে দিলেন ভাড়া বাড়িতে।  সাভারে একটি প্লট কিনেছিলেন কিন্তু দীর্ঘদিন অসুস্থতার কারণে সেই প্লটটিও একসময় বিক্রি করে দিতে হয়।

মনে পড়ে, আমার বাবার যখন মৃত্যু হয় তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর এবং আমার ভাই ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। পিতৃহীন এই দুই বালকের পড়াশোনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তাহের স্যার। আমাদের এস. এস. সি. পর্যন্ত্য পড়িয়েছেন এবং স্কুলের আরেকজন ইংরেজী শিক্ষককে বিনে পয়সায় ইংরেজিটাও পড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাহের স্যার শুধু আমার শিক্ষকই নন আমার পিতা সমতুল্য। আমাদের মত অনেকেই তাঁর কাছ থেকে নানা সুবিধা পেয়েছে সময়ে অসময়ে। হয়েছে প্রতিষ্ঠিত।  দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, তাঁর এই  অসুস্থতাকালীন সময়ে শত শত ছাত্রের কেউ কোনদিন একটিবারের জন্য প্রিয় শিক্ষকের খোঁজ খবর রাখেনি। অর্থ সাহায্য তাঁর কখনো প্রয়োজন ছিল না কারণ তাঁর চিকিত্সার যাবতীয় খরচ তাঁর পুত্রারাই বহন করতে পেরেছে। তাহের স্যারদের মত মানুষরা সাহায্য নিতে নয় বরং সাহায্য দিতেই পৃথিবীতে আসেন।

আমি দেশের বাইরে থাকি। বছরে দুইবার দেশে আসি, কোনোবারই স্যারকে না দেখে ফেরত আসতে পারিনি। স্যার ঠিক মনে রাখতেন আমি আবার কবে দেশে আসবো। সময় হলেই বাড়ির লোকদের জিজ্ঞেস করতেন আমার দেশে যাবার তারিখ ঠিক হয়েছে কিনা। এ যেন এক বৃদ্ধ পিতার প্রবাসী সন্তানের জন্য আকুল অপেক্ষা। আমার ছেলে মেয়েকে স্যার নিজের নাতির মতই দেখে এসেছেন। স্যারকে যতবারই দেখতে গেছি, উনার চোখে দেখেছি অফুরান ভালবাসা, স্নেহ, মমতা। শেষদিকে মনে রাখতে পারতেন না, কথা জড়িয়ে যেত কিন্তু কখনো আমাকে চিনতে ভুল করতেন না।  মাঝে মধ্যে দু'একজন প্রিয় ছাত্রের কথা মনে হলে তাদের সাথে আমার যোগাযোগ আছে নাকি জানতে চাইতেন।  ছাত্ররা ভুলে গেলেও তিনি সবার কথা মনে রাখতেন।

আজ ৯ জুন ২০১৬ সকাল দশটায় এই মহান মানুষ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। দেশ হারালো একজন নিস্বার্থ মানুষ গড়ার কারিগরকে আর আমি দ্বিতীয়বার হারালাম আমার পিতাকে। আল্লাহ যেন এই মহান শিক্ষককে পরকালের প্রতিটি মুহুর্তে শান্তিতে রাখেন। আল্লাহ যেন তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ বেহেশতের বাসিন্দা হিসাবে নির্ধারিত করে নেন। আমিন।

উল্লেখ্য তাহের স্যার ছিলেন দেশের প্রথম শ্রেণীর মাধ্যমিক স্কুল `মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের' একদম প্রথম সময়ের বানিজ্য বিভাগের শিক্ষক।