’অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’

সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন
Published : 23 Oct 2016, 12:45 PM
Updated : 23 Oct 2016, 12:45 PM

অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে 'অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল' সিনেমাটি। করণ জোহরের মতো নির্মাতাকেও মাথা নত করতে হয়েছে উগ্রবাদী ধর্মীয় সংগঠনের কাছে। ভবিষ্যতে কোনো পাকিস্তানি অভিনেতাকে তাঁর সিনেমায় না নেওয়া এবং আয়ের একটি অংশ সেনাবাহিনীকে দান করার শর্তে এই ছবি মুক্তি পাচ্ছে। রাজ ঠাকরে বলেছেন এই শর্তগুলো মেনে চললে তাঁরা কোনো সিনেমা হলে হামলা করবেন না। তার মানে রাষ্ট্র বা সরকারও এই সংগঠনকে ভয় করে।  তাদের দেয়া শর্ত মেনে নিতে উদ্বুদ্ধ করে। রাষ্ট্র পারে না এই সব সন্ত্রাস দমন করতে।  মানবাধিকার সংস্থা কিংবা তথাকথিত উদার জনগোষ্ঠী এখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। কারণ যারা এই সন্ত্রাস করছে তারা মুসলমান নয়। তাই সবাই চুপ এবং ভয়ে আছেন যদি এদের বিরুদ্ধে কিছু বলেন তাহলে না আবার ইসলামিক মৌলবাদী নামে আখ্যায়িত হয়ে যান।

পাকিস্তান ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে এখন মোটামুটি স্বীকৃত। সেনানিয়ন্ত্রিত একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে গণতন্ত্র নিছক ছেলেখেলা মাত্র। পাকিস্তানের বর্তমান রাজনীতি অনেকেরই পছন্দ না।  তারা সন্ত্রাসবাদের মদদ দাতা, ইসলামের নাম ব্যবহার করে ইসলামকে কলুষিত করা, বেলুচদের অধিকার হরণ (যেমন করেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে) এইসব দুর্নাম পাকিস্তানের নামের সাথে জড়িয়ে আছে। পাকিস্তান তার নিজের দেশে মসজিদকে পর্যন্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। এসবই তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা অথবা চতুরতা।  আর শিল্প এবং শিল্পী তো কোনো সীমানার গন্ডির মধ্যে বাস করে না। শিল্প সাহিত্য সমগ্র মানব সমাজের। সেখানে নেই কোনো রাষ্ট্রের সীমানা, জাতিগত বিভেদ। যেহেতু ভারত এবং পাকিস্তান এখনো তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি, দুই দেশের মানুষের মধ্যে এখনো যাতায়াত আছে তাহলে একটি উগ্রবাদী সংগঠনের কাছে কেন এই মাথানত করা?

ভারতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রগতিবাদীদের কথা ছেড়েই দিলাম আমার দেশের যেসব প্রগতিবাদী মহারথীরা বিরাজ করেন এঁদের অনেককেই (সবাই নন) দেখি ভারতের দেওবন্দ, জাকির নায়েক কিংবা আমাদের দেশের কোনো ধর্মীয় সংগঠন যখন কোনো ফতোয়া জারী করেন তখন এঁদের মুখে খৈ ফুটতে থাকে। আমারও ফুটে যখন দেখি ধর্মের অপব্যাখ্যা করে মানুষের স্বাধীনতা হরণ করা হয়, নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়।  আমিও অন্য ধর্মের নানা উৎসবে শুভেচ্ছা জানাই। অথচ আজ দেখি কোনো প্রগতিবাদী এই উগ্রবাদীদের কর্মকান্ডে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান না। আমাদের প্রগতিবাদীরা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রত্যেকটি উৎসবে শুভেচ্ছা জানান এমনকি কেউ কেউ সে সব উৎসবে উপস্থিতও থাকেন। খ্রিষ্ট ধর্মের, বৌদ্ধ ধর্মের উৎসবে শুভেচ্ছা জানান। এটাই মানুষের লক্ষণ, মানবতার পরিচয়।  কিন্তু পরিতাপের বিষয় এঁদের কে দেখি না মুসলমানের উৎসবগুলোতে সেভাবে সক্রিয় হতে।  এটা কি অসাম্প্রদায়িকতার লক্ষণ নাকি অসাম্প্রদায়িকতার মুখোশে একধরণের ভন্ডামী। ইসলামিক আচার আচরণ, উৎসবের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করলেই যেন মৌলবাদী বা জঙ্গীবাদী হয়ে যাবেন।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এঁরা সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গীবাদকে ইসলামীকরণ করতে পারলেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন।  অথচ এইসব মহাজ্ঞানীরা একবারও দেখেন না ইসলামে জঙ্গীবাদের কোনো স্থান নেই। এঁদের চোখে পড়ে না অন্য ধর্মের মানুষগুলো কিভাবে অতীতে এবং বর্তমানে সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করেছে এবং করছে। বার্মাতে যখন বৌদ্ধ ভিক্ষু রোহিঙ্গাদের কচু কাটা করে তখন এঁরা চুপ থাকেন কিন্তু কোরবানির ঈদে গরু ছাগল জবাই হলে এঁদের চোখের পানি আটকানো যায় না। এঁরা একবারও বলেন না যে, গৌতম বুদ্ধের বাণী ছিল অহিংস অথচ সেই মহাপুরুষের ধজ্বাধারীরা কিভাবে মানুষ হত্যা করে। এঁরা কিন্তু ভালো করেই জানেন কোনো সাধারণ ধর্মাবলম্বী এর সাথে জড়িত হতে চায় না, সবই রাজনীতির খেলা।   এঁরা জেনেও না জানার ভাণ করেন যে, সন্ত্রাসবাদীদের কোনো ধর্ম নেই।  এই সন্ত্রাসবাদীরা না হিন্দু, না খ্রিষ্টান, না বৌদ্ধ না মুসলমান। অথচ এঁরা সমস্ত সন্ত্রাসবাদীদের ইসলামিক করে ফেলতে দিন রাত পরিশ্রম করে যান।

আরেক দল আছেন গর্বিত নাস্তিক। এঁরা শুধু ইসলাম ধর্মের দোষত্রুটি খুঁজে খুঁজে বের করে আমেরিকা বা ইউরোপে পাড়ি দেবার ধান্দা করেন।  যতটুকু জানি নাস্তিক মানে `যে কোনো ধর্মেই এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না'। অথচ আজ পর্যন্ত এঁদের মুখে খ্রিষ্ট ধর্ম বা ইহুদী ধর্মের কোনো দোষ ত্রুটির কথা শোনা যায় না।  তাহলে তো আবার সে দেশ থেকেও বিতাড়িত হবার ভয় আছে।

পরিশেষে অনুরোধ দয়া করে প্রগতিবাদী হবার আগে সত্যবাদী হোন । ন্যায় কে ন্যায় আর অন্যায় কে অন্যায় বলুন।    দয়া করে বলুন – ইসলামিক স্টেট্ যা করছে তা অন্যায়, বার্মার মুসলমানকে হত্যা করা অন্যায়, গো রক্ষার নামে মানুষকে পিটিয়ে মারা অন্যায়, তালেবানরা আফগানিস্তানে যা করছে তা অন্যায়, ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনে যা করছে তা অন্যায়, হিটলারের ইহুদী নিধন অন্যায়, বসনিয়ায় সার্ব মুসলমান হত্যা অন্যায়, বেলুচিদের হত্যা অন্যায়, কাশ্মীরিদের হত্যা অন্যায়। মন্দির এবং মসজিদ ভাঙা অন্যায়। তবেই না আপনি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিবাদী আধুনিক মানুষ।