আহমাদ জহির: সঙ্গীতের রাজপুত্র

সৈয়দ আশরাফ মহি-উদ্-দ্বীন
Published : 1 April 2017, 06:59 PM
Updated : 1 April 2017, 06:59 PM

সেই আদিম যুগ থেকেই সঙ্গীত মানুষের বিনোদনের একটি প্রধান উপকরণ। যুগে যুগে সঙ্গীত তার ধরণ পরিবর্তন করেছে, হয়েছে আধুনিক। প্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি কত সহস্র সঙ্গীত শিল্পী তাঁদের কণ্ঠ আর সুরের মাধুর্যে জয় করেছেন শ্রোতাদের মন। তাঁদের কেউ কেউ  ছিলেন একটি ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে জনপ্রিয়, কেউ নিজ দেশ কিংবা জাতির মধ্যে আবার কেউ কেউ দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন। কারো স্থায়িত্ব সাময়িক, নতুন শিল্পীর ভিড়ে হারিয়ে গেছেন চুপিসারে আবার কেউ কেউ মৃত্যুর পরেও মানুষের হৃদয়ে রয়ে গেছেন যুগের পর যুগ।  তেমনই একজন সঙ্গীত শিল্পী `আহমাদ  জহির' যিনি ছিলেন আফগানিস্তানের সঙ্গীত ভুবনের মুকুটহীন রাজা, অথচ তাঁর সঙ্গীত জীবনের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র দশ বছর।

আহমাদ জহির

আহমাদ  জহিরের সাথে আমার পরিচয় ২০১১ সালের দিকে।  তখন আমি আফগানিস্তানের একটি মোবাইল কোম্পানীতে কাজ করি। সার্ভিস সমূহের মাসিক রিপোর্ট পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম মাসের পর মাস একজন শিল্পীর গানের ডাউনলোড সবার উপরে।  দ্বিতীয় যিনি আছেন তাঁর সাথে আহমাদ জহিরের গানের ডাউনলোডে আকাশ পাতাল তফাৎ। পুরো এক বছরের রিপোর্ট দেখে খেয়াল করলাম এই ধারা একেবারে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একই ভাবে চলছে। স্থানীয় সহকর্মীর কাছ থেকে জানতে পারলাম আহমাদ জহির মারা গেছেন বত্ৰিশ বছর আগে কিন্তু আফগানিস্তানের মানুষের কাছে তিনি অমর হয়ে আছেন।  মৃত্যুর বত্রিশ বছর পরেও তাঁর অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয় নাই। এরপরেই আবিষ্কার করলাম শহরের সব জায়গায় বিশেষত দোকানপাটে, সেলুনে, রেস্তোঁরাতে, রাস্তার ধারে সিডি বিক্রেতার কাছে, বাজারে সবখানে শুধুই আহমাদ জহিরের গান বাজছে যা আমি এতদিন খেয়ালই করিনি।

পৃথিবীতে অনেক শিল্পীই আছেন যাঁরা মৃত্যুর পরেও যুগ যুগ ধরে সম্মানের আসনে বিরাজ করছেন কিন্তু তাঁর পরে অনেক নতুন নতুন শিল্পীর গানও জনপ্রিয় হয়েছে, নতুন প্রজন্ম নতুন শিল্পীর গানে আসক্ত হয়েছে। কিন্তু আহমাদ জহিরের বিষয়টা তা নয়। তিনি শুধু শ্রদ্ধার আসনেই নেই, নতুন কোনো শিল্পীই এখন পর্যন্ত আহমাদ জহিরের গানকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি আফগানিস্তানে। সেই থেকে আগ্রহ জন্মালো এই শিল্পীর অদ্যোপান্ত আমার জানতে হবে।  কি করে একজন মৃত শিল্পী যুগ যুগ ধরে শাসন করে চলেছেন একটি পুরো দেশের সঙ্গীত ভুবনকে? কেন বত্রিশ বছর পরেও নতুন কোনো শিল্পী জনপ্রিয়তায় তাঁর ধারে কাছে পৌঁছুতে পারেনি?

আহমাদ জহিরের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৪ই জুন আফগানিস্তানের লাগমান প্রদেশে। তিনি একাধারে একজন গায়ক, গীতিকার এবং সুরকার। ভক্তরা তাঁকে আফগানিস্তানের সংগীতের আইকন, আফগান সঙ্গীতের রাজা আবার কেউ কেউ আফগানিস্তানের এলভিস বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন। আহমাদ জহিরের গান মূলত ফার্সি কবিতার উপর ভিত্তি করে, এছাড়াও অল্প কিছু গান আছে পশতু ভাষায়। তিনি মূলত রক এবং পপ ধারার সঙ্গীত শিল্পী আর তাঁর গানে এলভিস প্রিসলির স্টাইলের ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয়।  আজ তাঁকে আফগান সংস্কৃতি ও ইতিহাসের এক শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসাবে গণ্য করা হয়।

আফগানিস্তানের সরকারি এবং উপর মহলে আহমাদ জহিরের যথেষ্ট প্রভাব ছিল কারণ তাঁর বাবা সত্তরের দশকে আফগানিস্তানের স্বাস্থমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এর আগে তাঁর বাবা জহির শাহের সময়ে আফগান পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন এবং আফগান সংবিধান রচয়িতাদের মধ্যে একজন।

আহমাদ জহিরের সঙ্গীত জীবন শুরু হয় যখন তিনি স্কুলে পড়েন। সেখানে তিনি মূলত স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে গান গাইতেন এবং অ্যাকর্ডিয়ন বাজাতেন। স্কুলের মধ্যে যখন তাঁর কণ্ঠ এবং সুর জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে তখন কয়েক বন্ধু মিলে তৈরী করলেন একটি ব্যান্ড বা সঙ্গীত দল। মূলত পশ্চিমা যন্ত্র এবং স্টাইল নির্ভর এই ব্যান্ড জনপ্রিয়ও হলো অতিদ্রুত। স্কুলের অনুষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান, ঈদ কিংবা নওরোজের অনুষ্ঠানে ডাক পড়তে থাকে আহমাদ জহির ও তাঁর ব্যান্ডের।

নিজের প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ডের সদস্যদের সাথে আহমাদ জহির (মাঝখানে দাঁড়ানো)

এরপর আহমাদ জহির তাঁর গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন কাবুল থেকে এবং উচ্চ শিক্ষা নেয়ার জন্য আরও দুই বছর কাটান ইন্ডিয়াতে। ইন্ডিয়া থেকে ফিরে কাবুল টাইমস পত্রিকা এবং একই সাথে আফগান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি নেন। সেটা ১৯৬৯ সালের কথা।  এই বছরেই তিনি বিয়েও করেন। আশ্চর্যের বিষয় এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি হঠাৎ অনুধাবন করেন তাঁর আসল গন্তব্য হচ্ছে সঙ্গীত। মাত্র তেইশ বছর বয়সে তিনি নিজেকে একজন পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তৈরী করেন। এরপর জহির ফার্সি কবিতাকে ভিত্তি করে কম্পোজ করেন তাঁর প্রথম একক গান। তাঁর নিজের সুর করা এবং গাওয়া প্রথম রেকর্ডকৃত গান ছিল `গর্ কুনি ইয়াক নিযারা'।  থেমে না থেকে একে একে তৈরী করেন `আজিজাম বা ইয়াদাত', `আহিস্তা আহিস্তা', `আখির অ্যায় দারিয়া' শিরোনামের জনপ্রিয় গান।  আহমাদ জহিরের পরিচিতি কাবুল ছাড়িয়ে আফগানিস্তানের অন্যান্য শহর গুলোতেও ছড়িয়ে পড়লো।

আহমাদ জহিরের অ্যালবামের কভার ফটো

আহমাদ জহিরের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি শ্রোতাদের শ্রেণীভেদ করতে পারতেন। নানা রকম শ্রোতার চাহিদা মতো তিনি গান তৈরী করতেন। সেই গানের কথা আর সুরে থাকতো ভিন্নতা।  আর তাইতো তাঁর ভক্তদের তালিকায় তরুণ তরুণী থেকে শুরু করে বুড়ো বুড়ি যেমন ছিল তেমনি ছিল শহরের কিংবা গ্রামের সঙ্গীত পিপাসু। আহমাদ জহিরের গানে ছিল আনন্দ, ভালোবাসা, একাকিত্ব, উচ্ছলতা আর দুঃখবোধের ছোয়াঁ। কেউ কেউ বলেন আহমদ জহিরের গান তাঁদেরকে সুস্থ রাখে বিশেষত মানসিক কষ্টের সময়, নিঃসঙ্গতার সময়, বিষন্নতার সময়। সেই কারণেই একজন মানুষের যে কোনো সময়ে নির্ভরতার জায়গা হয়ে দাঁড়ায় আহমদ জহিরের গান, তা সে বত্রিশ বছর আগেই হোক কিংবা একশো বছর পরে।

আহমাদ জহিরের বিখ্যাত গান `জিন্দেগী আখির সারায়াদ' মূলত এমন এক কবিতা যা কিনা মানুষ আর ঈশ্বরের সম্পর্ককে ফুটিয়ে তুলেছে। ১৯৭৩ সালে আফগানিস্তান যখন প্রথম প্রজাতন্ত্রের স্বাদ পেলো, সেই নতুন সরকার তাঁকে অভিনন্দন জানালো দেশের প্রতি তাঁর অবদানের জন্য কিন্তু পরবর্তীতে আহমাদ জহির যখন দেখলেন এই সরকারও একটি অন্তস্বারশূন্য সরকার এবং তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেনা, তিনি সরকারের সমালোচনা করে আবার গেয়ে উঠলেন `ইলাহী মান নামেদনাম' এর মতো প্রতিবাদী গান।

রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও, যে কোনো রাজনৈতিক অপরাধের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠকে তিনি ধারণ করেছেন গানের মাধ্যমে। ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে যখন একনায়ক রাষ্ট্রপতি তারাকি এবং পরবর্তীতে হাফিজুল্লাহ আমিনের শাসন চলছে, যখন প্রত্যেকটি মানুষ প্রতি মুহূর্তে ভয়ের মধ্যে থাকতো, কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করতো না, তখন আহমাদ জহির নিজ উদ্যোগে একের পর এক গেয়ে চলেছেন `সফর বি রোশনাহী', চি মূলক রা বাদ', `ফিকরি খুদ ও রাহী খুদ' এর মতো প্রতিবাদী গান।

আহমাদ জহিরের আরেকটি বড়ো গুন্ ছিল, সম্ভ্রান্ত এবং ক্ষমতাধর পরিবারের সন্তান আর নিজের বিখ্যাত অবস্থান সত্বেও তিনি বড়দের অনেক সম্মান করতেন। সকলের সাথে মধুর ব্যবহার তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলো সম্মানের অন্য আসনে।  মায়ের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভক্তি, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।  মায়ের মৃত্যু তাঁর জীবনের সবচেয়ে কষ্টের সময় ছিল। এই সময় তিনি তৈরী করেন তাঁর সবচেয়ে দুঃখবোধের গান `বিনাজাম কালবী পাক আজ মাদার-এ-মান সিয়া  শুদ'।

১৯৭৩ সাল নাগাদ আহমাদ জহিরের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।  পুরো আফগানিস্তান মশগুল আহমাদ জহিরে। সারা দেশ ব্যাপী একের পর এক কনসার্ট করে চলেছেন, মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছেন। পরিচিতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে গেছে ইরানে গাওয়া তাঁর বিখ্যাত গান `বানু বানু' এর মধ্য দিয়ে।  পেলেন জাতীয় পুরস্কার `সিঙ্গার অব দ্য ইয়ার'। এ বছরই তাঁর জীবনে ঘটে একটি দুঃখজনক ঘটনা আর সেটি হলো বিবাহ বিচ্ছেদ।

আহমাদ জহির কখনো কারো নকল করতেন না। তাঁর সব গানই ছিল মৌলিক। তিনি হয়তো স্টাইল ধারণ করেছেন পশ্চিম কিংবা পুবের কিন্তু তাঁর গানের কথা, সুর সবটাতেই ছিল তাঁর নিজস্বতা।  তাঁর মুখেই তিনি বলেছিলেন `কপি খানি হুনার নিস্ত' মানে নকল করা কোনো প্রতিভা নয়। আর তাইতো আহমদ জহির আজ নিজেই এক সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান।

উনিশ বছরের সঙ্গীত জীবনে মূলত শেষ দশ বছর আহমাদ জহির দৃশ্যপটে ছিলেন। এই দশ বছরে ত্রিশটি অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে তাঁর, গেয়েছেন অসংখ্য গান আফগান রেডিও আর টেলিভিশনে।  সমগ্র বিশ্বে এটি একটি অনন্য ঘটনা যে সেই সময়ে এখনকার মতো টেকনোলজি এতো উন্নত ছিলোনা, সকল গান লাইভ রেকর্ড হতো তবুও আহমদ জাহির এতো কম সময়ে এতগুলো অ্যালবাম বের করেছেন আর সবগুলো অ্যালবামই সফল হয়েছে ব্যবসায়িক এবং জনপ্রিয়তার নিরিখে। এমনও হয়েছে আহমদ জহির বারোটি গানের একটি অ্যালবাম একদিনে রেকর্ড করিয়েছেন।

আহমদ জহির সেই সময়ে আফগান সঙ্গীতকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়, তৈরী করেছেন নিজস্ব ধারা এবং আফগানিস্তানের মাটিতে গানকে দিয়েছেন সম্মানজনক পেশার স্বীকৃতি। তাঁরই কল্যানে আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আফগান স্কুল অফ মিউজিকের মতো প্রতিষ্ঠান।

১৯৭৯ সালের ১৪ই জুন আফগানিস্তানের সঙ্গীত পিপাসুদের জন্য একটি কালো দিন।  সঙ্গীতের বরপুত্র এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে নিজের জন্মদিনের দিন ছেড়ে গেলেন পৃথিবীর মায়া। তাঁর ভক্তরা কোনোভাবেই বিশ্বাস করেন না যে এটি একটি দুর্ঘটনা ছিল।  কেউ কেউ মনে করেন এটা তারাকি-আমিন একনায়কদের দ্বারা সংঘটিত একটি হত্যাকান্ড। আবার লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, তৎকালীন আফগানিস্তানে রাশিয়ান গভর্নরের স্ত্রী নাকি আহমদ জহিরের বড় ভক্ত ছিলেন এবং তাঁর সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক থাকার সন্দেহে সেই গভর্নর এই হত্যাকান্ড ঘটান।  শোনা যায় আহমাদ জহিরের জানাজায় যত লোকের সমাগম হয়েছিল তা নাকি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির ক্ষেত্রেও হয়নি। পুরো কাবুল শহর নাকি সেইদিন এক হয়েছিলো তাদের নায়ককে বিদায় জানাতে।

আহমাদ জহিরের সমাধি

১৪ই জুন আফগানিস্তানে অলিখিত ভাবে একটি জাতীয় দিন হয়ে আছে।  প্রতিবছর এইদিনে লাখো মানুষ জড়ো হন তাঁদের প্রিয় শিল্পীর কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে।

শ্রদ্ধা জানাই এই মহান শিল্পীকে।