কমন জেন্ডার: সমাজের বোঝা নয়, সমাজের অংশ

তাজুল ইসলাম মুন্না
Published : 28 Oct 2012, 04:37 AM
Updated : 28 Oct 2012, 04:37 AM

আজকে থেকে সকল Common Gender'দেরকে কথা দিলাম। আপনাদেরকে দেখে কখনও উল্টোদিকে হাঁটবোনা। এই সমাজ হয়তো আপনাদেরকে "মানুষ" হিসেবে যেই সম্মানটুকু প্রাপ্য তাও দেয়নি। কিন্তু আমরা বর্তমান প্রজন্ম অবশ্যই দেবো। আপনাদের অধিকার আদায়ের এই আন্দোলনে আমাদেরকে সবসময় পাশে পাবেন। কারণ আমরা জানি, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে কখনও অবহেলা করা যায় না। শুরুতেই বলে দিচ্ছি, যেই "হিজরা" শব্দটিকে আপনারা গালি হিসেবে ব্যবহার করেন সেই শব্দটিকে অন্তত আমি এখন থেকে আর গালি হিসেবে ব্যবহার করবো না!

আর সবাইকে বলছি, হিজড়া বলে তাদেরকে দূরে সরিয়ে দেবেন না প্লিজ। তারা হিজরা তো কি হয়েছে? বিয়ে করতে পারে না…. এটাই তো?? অনেক পুরুষ বা নারী আছে যারা বিয়ে না করে সারাজীবন একা একা পার করে দেয়। এইভাবে যদি হিসাব করেন তাহলে তারাও কি হিজরা?

না। তারা তা নয়। ইসলাম ধর্মের কথা বললে, আমরা "আশরাফুল মাখলুকাত"। সৃষ্টির সেরা জীব! আমাদেরই একটা অংশকে আমরা কিভাবে অস্বীকার করবো? এটা করা কি সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমাদের মানায়?

আচ্ছা! বাদই দিন নাহয় ধর্মকে, সাধারণ বিবেক-বুদ্ধি দিয়েই বিবেচনা করুন! আপনি খেটে খেতে পারেন। কারণ আপনি পুরুষ! আপনার ঘরের মেয়েটা হয়তো একসময় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে। আপনি স্বপ্ন দেখতে পারেন। মানুষ হিসেবে এটা আপনার অধিকার। তারাও তো মানুষ…. তাদের কি স্বপ্ন নেই? ভালোবাসা নেই?? মায়ের জন্যে কি তাদের মন কাঁদে না???

অবশ্যই কাঁদে। একজন মায়ের অনুভুতি আমি জানি না। তবে এইটুকু জানি যে একজন মা কখনও তার শিশু ছেলে নাকি মেয়ে, নাকি কমন জেন্ডারের তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তার কাছে "সন্তান" পরিচয়টাই সবার উপরে। এই সন্তানকে তিনি ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে ধারণ করেছেন। যেমনটা ছেলে বা মেয়ে হলে ধারণ করতে হতো। তিনি এই সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পান করিয়েছেন। বড় করেছেন। সামান্য কিছু হরমোন! সামান্য…… এই কয়টা হরমোন কি একজনের পুরো জীবনটাকে তছনছ করে দিতে পারে?? হয়তো পারে, কিন্তু আমরা এই কয়েকটা হরমোনের কারণে কাউকে ত্যাগ করবো না!

তাদেরকে বুঝুন, তাদের সেই বুক ফাটা আর্তনাদ শুনুন। তারপর নিজে থেকেই বিচার করুন। তাদেরকে কিভাবে আপনি ফেলে দেবেন এ সমাজ থেকে? সেই কথাটা মনে আছে তো?

"""সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।"""

করুণা দেখাবেন না তাদের প্রতি। তাদের করুণা দেখানোর মতো যোগ্যতা আপনার আমার নাই। এটা স্রষ্টাই কেবল করতে পারবেন। তাদেরকে করুণা না, বরং সমর্থন দিন। সাহস দিন।। যাতে করে তারা একটা সুন্দর জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারে।

আর ততোদিন? আমরা ১৫কোটি জনতা। তারা চাঁদা তুলতে আসে তো?? হাজার টাকা চায়? শত টাকা চায়?? চায় না! তারা চায় দুই, পাঁচ, দশ টাকা। লাখ টাকার গাড়ি কিনতে পারেন, পকেটের ক্রেডিট-ডেবিট কার্ডটায় সবসময় হাজার হাজার টাকা থাকে। একটা শার্ট কিনতে পারেন দুই হাজার টাকা দিয়ে। আমাদের সমাজের এই অংশটাকে মাত্র ৫টা টাকা দিতে পারবেন না? দিয়েই দিন না ভাই! তারা তো খেটে খেতে পারে না। তাদের পেটটা কি পেট না? তাদের বেঁচে থাকার জন্যে কি খাবার লাগে না? লাগে তো!

মাত্র কয়েকদিন আগের একটা ঘটনা মনে পড়লো। যতদূর মনে পড়ে বৃষ্টি হচ্ছিলো। একজনকে দেখলাম বাঙালী মেয়েদের অফিস পোশাক পড়ে আসছে। তার চোখে-মুখে ভয়! আশেপাশের প্রত্যেকটা মানুষকে দেখে তার ভয়। আমার পাশ দিয়ে গেলো…..মনে হলো ওড়নার নিচে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে! কারওয়ান বাজারের আন্ডারপাসের ঘটনা সেটা। দরজা থেকে বের হয়ে ঘুরে যখন যাচ্ছিলো তখন একনজরের জন্যে তাকলো। তার সেই অসহায় দৃষ্টি দেখে আমার মনে হচ্ছিলো আমি মরে যাই। আমার দেশের একজন মানুষ এতোটা অসহায় হবে? সেতো কোনো পাপ করেনি। হিজরা হয়ে জন্মগ্রহণ করা কি পাপ?? আমার দিকে যখন তাকালো তখন আমি বুঝতেও পারলাম না যে আমার ডান হাতটা কপাল পর্যন্ত চলে এসেছে। "স্যালুটের" ভঙ্গিটা হাসিমুখে বেশ ভালো করেই দেখালাম। হঠাৎ মনে হলো তার সমস্ত ভয় কেটে গেলো। বিষাদময় চেহারা গিয়ে সেখানে হালকা একটু হাসির আভাস দেখতে পেলাম। সে সেই হাসিটুকু নিয়ে হারিয়ে গেলো জনসমুদ্রে। ।

তাদের একটা অংশ প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমাজের একটা অংশের সাথে। নিজেকে মাঝেমধ্যে খুব ভাগ্যবান বলে মনে হয়। নিজেকে অন্তত "ছেলে" বলে পরিচয় দিতে পারি। কিন্তু সাথে সাথে একটা দ্বায়িত্ববোধও এসে ভর করে। তাদের জন্যে কিছু একটা করার ইচ্ছা! এই ইচ্ছাটুকুতে বাস্তবায়িত করতে আপনার হাজার টাকা খরচ করে ক্যাম্পেইন করতে হবে না। শুধুমাত্র নিজেকে প্রস্তুত করুন। ঐ যে আগেই বললাম, তাদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলুন। তাদের খোঁজ-খবর নিন। এইটুকুই তাদের জন্যে যথেষ্ট!

আমার স্কুললাইফে এক বন্ধু ছিলো। নাম মেরাজ, আরোও ছিলো সামীর, আবির। । । সামীর আর মেরাজের কাজে আমরা অনেকসময় হাসাহাসি করতাম। কিন্তু এখন যদি ও সামনে থাকতো। তাহলে ওর সেই কাজের জন্যেই ওকে স্যালুট করতাম! যেই হিজরাদের দেখে অনেকের কলিজায় পানি থাকেনা সেই হিজরাদের সাথে সে গল্প করতো। তাদের খোঁজ-খবর নিতো। ওর মধ্যে কোনো সংকোচ ছিলো না। বন্ধু, সত্যি করে একটা কথা বলছি। তাদের সাথে এই বন্ধুত্বটাকে হয়তো তোর চাইতে ভালো করে আর কেউ অনুভব করতে পারবে না।

জানি যে এটা একটা অনেক দীর্ঘ প্রসেস। বেশিরভাগ ছেলেরা মেয়েদেরকেই "মাইয়া মানুষ" এর দৃষ্টিতে দেখে, শুধুমাত্র "মানুষ" হিসেবে দেখতে পারে না!! তাহলে কমন জেন্ডারদের সম্পর্কে তাদের কি ধারণা থাকে?

যেতে চাই না সেই প্রসঙ্গে। শুধু চাই; আমার দেশের প্রত্যেকটা মানুষ যেনো ভালোভাবে, মিলে-মিশে থাকতে পারে। মানুষের ভেতর যেনো সেরকম আন্তরিকতা থাকে। একের বিপদে যাতে দশজন এগিয়ে আসে! সে ছেলে হোক, মেয়ে হোক…কিংবা হোক, কমন জেন্ডার!

-ভালো থাকুক, নিরাপদে থাকুক আমার দেশের প্রত্যেকটা নারী, প্রত্যেকটা পুরুষ, প্রত্যেকটা "কমন জেন্ডার"

– – – – – – – – – – – – – – – – – – – – –

ফেসবুকে স্ট্যাটাস হিসেবে দেওয়া হয়েছিলো:::
facebook.com/tajulislam/posts/3886696694368