‘করিয়ে পাগল পারা তারাই নিল সব লুটে’: ভর্তি ক্ষেত্রে কোটা প্রসঙ্গে

ফারুক আহমেদ
Published : 14 Nov 2012, 06:53 PM
Updated : 14 Nov 2012, 06:53 PM

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সাংসদদের সন্তানের জন্য কোটা রাখার সুপারিশ করেছিলেন।এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে আলোচনাও হয়েছিল ।গণমাধ্যম এবং বিদ্যালয়ের প্রধানদের পক্ষ থেকে সমালোচনার মুখে আপাততঃ সে সুপারিশকে বাতিল করা হয়েছে ।বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সরকারি কর্তৃপক্ষের অনেক প্রয়োজনীয় বিষয়ে উল্লেখ করার মত তেমন কোন কৃতিত্ব না থাকলেও নানা রকমের উদ্ভট প্রস্তাব তুলিয়ে তা বাতিল করে কৃতিত্ব নেওয়া এক ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ।এ ক্ষেত্রেও শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থাপনে তাঁর মন্ত্রনালয়ের এবং সর্বপরি বরাবরের মতই প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্ব নেওয়ার বিষয়ই দেখা গেল ।সাধারণভাবে দেখলে এ সুপারিশ বাতিল করা কৃতিত্ব পাওয়ার দাবি রাখে বটে ।কিন্তু নিজেদের জন্য এই ধরনের একটি কমিটি এমন এক নির্লজ্জ প্রস্তাব কিভাবে উত্থাপন করতে পারে ? আর এ রকম এক প্রস্তাব নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আলোচনাই বা হয় কিভাবে ?সাংসদদের জন্য শুল্ক মুক্ত গাড়ী ,বেতন বৃদ্ধি থেকে নিয়ে তাঁদের বিভিন্ন সুযোগসুবিধার জন্য তাঁরা নিজেরা যেসব প্রস্তাব উত্থাপন করেন তাতে এমনিতেই জাতি লজ্জা পায় ।তারপর আবার ভর্তির ক্ষেত্রে এমন প্রস্তাব উত্থাপন রীতিমত লজ্জাস্কর হলেও সে লজ্জায় আমাদের পায় না । কারণ আমাদের প্রতিনিয়ত শাসক শ্রেণির তৈরী করা এক নির্লজ্জ সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে ।

এক সময় আমরা মিছিলে আওয়াজ তুলতাম –'শিক্ষা সুযোগ নয় , শিক্ষা আমার অধিকার'।শিক্ষামন্ত্রী মহাশয় একসময় যে রাজনীতি করতেন তাতে তাঁর মুখেও এ আওয়াজ অসংখ্যবার উচ্চারিত হওয়ার কথা ।শিক্ষা যদি প্রতিটি নাগরিকের অধিকার হতো তবে ভর্তি নিয়ে এতসব নীতিমালার প্রয়োজন ছিল না ।কারণ অধিকার শুধুইতো কথা দিয়ে হয় না তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয় ।শিক্ষানীতি ২০১০ নিয়ে সরকারের লোকজনের বড় বড় কথা বলতে শোনা যায় । বাস্তবে এ নীতির কার্যকর পদক্ষেপগুলো কি ?আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নতুন করে তৈরীতো দুরে থাক পুরাতন যে সকল প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল সেগুলোর ভগ্ন দশা হতে হতে নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হচ্ছে ।এর পরিবর্তে ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানগুলো দিনে দিনে শাখা প্রশাখায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।এগুলো সংখ্যায় যত বৃদ্ধি পাচ্ছে এদের ব্যবসায়ীক দৌরাত্ন্যও তেমনই বৃদ্ধি পাচ্ছে । নতুন সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরী না করা এবং পুরাতনগুলোকে ধারাবাহিকভাবে ভগ্ন দশার মধ্যে নিয়ে যাওয়া জনগণের সাথে সরকারগুলোর ধারাবাহিক প্রতারণা ।এ সরকারগুলো আদমজির মত বড় বড় সরকারি তথা জনগণের শিল্প ধ্বংস করতে যেমন ঐক্যমতে জনগণের সাথে প্রতারণা করেছে তেমনই সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধারাবাহিকভাবে ধ্বংসের পরিকল্পনা গ্রহন করেছে ।দেশব্যাপী যে সকল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো আছে সেগুলোর অবকাঠামো , শিক্ষকসহ সবকিছুতেই বেসরকারি ব্যবসায়ীক মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো থেকে ভাল হওয়া সত্বেও দিন দিন সেগুলোর বেহাল অবস্থা হচ্ছে কেন ?সরকারই কেন ব্যবসায়ীক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রেষ্ঠত্বের বিজ্ঞাপণের কাজ করে থাকে ?শুধুমাত্র পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে অত্যন্ত অসমভাবে এসব ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শ্রেষ্ঠত্বের ক্রমে বিন্যস্ত করে যখন সরকারের তরফ থেকে ঘোষনা করা হয় তখন আসলে এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সরকারই বিজ্ঞাপনের মডেলে পরিণত হন ।এভাবে সরকার নিজেই জনগণের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে ধ্বংস করছে অপরদিকে চরম ব্যবসায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরিয়ে বেপরোয়া করে তুলছে ।

লক্ষ্য করবার মত বিষয় হলো এই যে ,ভর্তি বিষয়ক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যে আলোচনা তা কিন্তু বেসরকারি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে এবং শিক্ষামন্ত্রণালয় বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সুপারিশও ছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি ক্ষেত্রে । এসব থেকে বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না যে ,সরকারি বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এখন বড়ই বেহাল এবং সরকারি লোকজনই আর সেখানে তাদের সন্তানদের পড়ালেখার জন্য পাঠাতে চাচ্ছেন না ।শুধুমাত্র পরীক্ষা , রেজাল্ট ইত্যাদির মাধ্যমে শাসক শ্রেণির সরকারগুলো শিক্ষা ক্ষেত্রে এক ব্যবসায়ীক সংষ্কৃতি শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলোতে এবং সমাজের মধ্যে সৃষ্টি করেছে । এই সংষ্কৃতির ছদ্মাবরণে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষা ক্ষেত্রে নিতান্তই প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলতে ঠেলতে এখন শিক্ষার মূল ধারা থেকে ছিটকে ফেলেছে।এমনভাবে ছিটকে ফেলেছে যে,দেখলে দম বন্ধ হয়ে আসে এমন ব্যবসায়ীক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানুষ তার সন্তানকে দেওয়ার ক্ষেত্রে পাশে দাঁড়ানো অপেক্ষাকৃত ভাল অবকাঠামোর এবং সেখানে ভাল শিক্ষক থাকা সত্বেও সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন ।

যা হোক এখন মূল ধারার শিক্ষা মানেই বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা । শুধু অর্থিকভাবে বাণিজ্যিক তাই নয় এসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার পদ্ধতি ,সীলেবাস,বিদ্যালয়ে পরীক্ষানীতি ,পরীক্ষার সংখ্যা ,প্রশ্ননীতি সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ।এসব ক্ষেত্রে সরকারের কোন ভুমিকাই নেই ।সরকার শুধুই তাদের শিক্ষানীতি নিয়ে বাগাড়ম্বর করে । সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা এবং যা আছে তারও ভগ্ন দশা এবং এ ভগ্ন দশা আবার সরকারের লোকজনের নিকট থেকেই স্বীকৃত হওয়ার ফলে মানুকে একরকম অসহায় হয়েই এসব ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের সামনে তাঁদের সন্তানকে নিয়ে হাজির হতে হয় ।সেখানেও আবার ভর্তি ক্ষেত্রে বৈষম্যের শেষ নাই ।

অন্য অনেক বৈষম্য তো আছেই এর সাথে যুক্ত হয়েছে কোটা প্রবর্তনের বৈষম্য ।অতি নির্লজ্জতা চোখে পড়ে বলে সাংসদদের জন্য কোটা রাখার সুপারিশ সরকার বাতিল করলেও অন্য যেসব ক্ষেত্রে কোটা রেখেছে সেগুলো রাখারও কোন যৌক্তিক এবং নৈতিক কারণ থাকতে পারে না । যেখানে প্রতিযোগিতা আছে সেখানে কোটা রাখার একমাত্র যৌক্তিক এবং নৈতিক কারণ হতে পারে প্রতিযোগিতাকে সুষম করা ।শিক্ষা ক্ষেত্রে ভর্তি কোটা বৈধ , যৌক্তিক এবং নৈতিক হতে পারে তাদেরই ক্ষেত্রে যারা অর্থনৈতিকভাবে , জাতিগতভাবে পিছনে পড়ে আছে, প্রতিবন্ধী এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে, কারণ মেয়েরা বহুবিধ বৈষম্যের শিকার ।এ ছাড়া কোটা রাখার কোন কারণ থাকতে পারে না ।তথাপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের ভর্তির জন্য ঢাকা মহানগর এলাকার বেসরকারি বিদ্যালয়ে দুই শতাংশ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে-মেয়ে এবং নাতি-নাতনিদের ভর্তির জন্য পাঁচ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয় রাখা হয় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা এর সাথে একমত হবেন না । কারণ মুক্তযোদ্ধা অনেক বড় ব্যাপার ।আর কোন অসুস্থ, পঙ্গু ,অসহায় মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে শুধু এ ধরনের কোটা নয় এসব পরিবারের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের দায়ীত্বও সরকারের নেওয়া উচিৎ ।কিন্তু ঢালাওভাবে সবার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোটা প্রযোজ্য হতে পারে না ।