সৃজনশীলতার বাগাড়ম্বর

ফারুক আহমেদ
Published : 17 Nov 2012, 04:36 PM
Updated : 17 Nov 2012, 04:36 PM

বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় বড় দায়িত্ব প্রাপ্ত এবং দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তা ব্যক্তিগণ প্রায়ই মহান সব আবিষ্কার করে বসেন ।তেমনই এক মহা আবিষ্কার হলো প্রশ্ন পত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে 'সৃজনশীল' কথাটি জুড়ে দেওয়া ।জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী মূল্যায়ণ প্রসঙ্গে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে ।স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি কি?শিক্ষানীতির মধ্যে এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই ।পরবর্তীতে জানা গেল সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা মানে এক নতুন ধরণের প্রশ্ন প্রণয়ন ব্যবস্থা ।কি সেই নতুন প্রশ্ন প্রণয়নের ব্যবস্থা তা পরিষ্কারভাবে জানা না গেলেও এ সংক্রান্ত কতকগুলো জ্ঞানগর্ভ শব্দের সাথে নতুন করে নতুনভাবে পরিচিত হওয়া গেল ।'জ্ঞানমূলক' , 'অনুধাবনমূলক' , 'প্রয়োগমূলক' ও 'উচ্চতর দক্ষতামূলক' এগুলো একটি সৃজনশীল প্রশ্নের চারটি অংশের নাম ।একেই বলে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন ।

তবে এ ক্ষেত্রে কিন্তু কানা ছেলের নাম 'পদ্মলোচন' এ অযথার্থতা কিছু নেই । কারণ , শাসক শ্রেণি এবং তার কর্তা ব্যাক্তিগণ শিক্ষাব্যবস্থার হাল এমন করতে চাচ্ছেন যেন বাইরে থেকে এ লোচনকে পদ্মের মত মনে হলেও ভিতরে আলোর ক্রিয়া বলে কিছু না থাকে ।খুব মনে পড়ে লোচন বা চোখের বিভিন্ন অংশ পড়াতে গিয়ে আমাদের প্রাণীবিজ্ঞানের শিক্ষক pupil শব্দটি নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন ।বলেছিলেন চোখে আলোর প্রবেশ পথ হলো pupil । আবার শিক্ষার্থীদের বলা হয় pupil । আমাদের কাছে এর অর্থ কি জানতে চেয়ে নিজেই বলেছিলেন সমাজের মধ্যে আলোর প্রবেশদ্বার হলো ছাত্ররা, তাই ছাত্রদেরকেও বলা হয় pupil ।

আমাদের সন্তানদের কি সমাজে আলোর প্রবেশদ্বার হিসেবে তৈরী করা হচ্ছে ?ভন্ডামি , প্রতারণা ,স্বার্থপরতা , অন্তঃসারশূন্যতা , মেধার গল্প , প্রতিযোগিতার গল্প ছাড়া তাদের সামনে আর কি উপস্থিত করা হচ্ছে?এসবের মাধ্যমে তাদের মধ্য দিয়ে সমাজে আলো প্রবেশের সবগুলো দ্বার বন্ধ করার সকল আয়োজনই এখন চলছে ।

চটকদার এবং বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথার আড়ালে বিদ্যালয়গুলোতে শেখা এবং শেখানোর সংস্কৃতির পরিবর্তে সম্পূর্ণরূপে পরীক্ষার সংষ্কৃতি চালু করা হয়েছে । সেজন্যই শিক্ষা নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীর কথা মানেই পরীক্ষাকেন্দ্রীক কথা ছাড়া আর কিছুই যেন নাই ।পরীক্ষা কোন পদ্ধতিতে হবে এ নিয়ে যত কথা যত আলোচনা চলে শিক্ষাদানের পদ্ধতি নিয়ে সে তুলনায় কোন আলোচনাই হয় নাযাই থাকুক না কেন সেগুলোর কোন কার্যকারীতা দেখা যায় না ।কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে যা' কার্যকর হতে দেখা যায় তা হলো পরীক্ষা ।অবকাঠামো, বিদ্যালয়ের পরিবেশ এসব নিয়ে কোন আলোচনা শোনা যায় না ।নতুন কোন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হলে সেখানে লিখিত প্রশ্নের ধরণ ।প্রশ্ন পত্র নিয়ে এত বেশি আয়োজনই বুঝিয়ে দেয় আমাদের দেশে শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হলো পরীক্ষাকেন্দ্রিক।

সর্বজনীন শিক্ষার কথা না বললে শাসক শ্রেণির গণতান্ত্রিক লেবাস খসে পড়ে । সে কারণে তাদেরকে সর্বজনীন শিক্ষার কথা বলতে হয় ।কিন্তু সর্বজনীন শিক্ষার কথা মুখে বললেও শ্রেণি চরিত্রের কারণেই শাসক শ্রেণিকে কৌশলে তার বিরূদ্ধে দাঁড়াতে হয়।এর মধ্যে স্থায়ী কৌশলটি হলো শিক্ষাকে নানা ধারায় বিভক্ত করা । এর মধ্যে সবচেয়ে গরীব মানুষের জন্য যে ধারাটি তা কোন শিক্ষাই নয়। মূল ধারা বলে পরিচিত যে ধারাটি সেখানেও নানা মাত্রার বৈষম্য এমনই যে ,সেখানে গরীব, নিম্ন মধ্যবিত্ত , মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের জন্য শিক্ষা কখনোই এক রকম নয় ।উচ্চবিত্ত , মধ্যবিত্ত হয়ে গরীব শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো ,বিদ্যালয়ের পরিবেশ ,শিক্ষক ,শিক্ষাদানের মান কমতে কমতে এমন অবস্থায় আসে যে, সেগুলোকে কোনভাবেই তুলনার মধ্যেও ফেলা যায় না ।এই বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে তোলে পরীক্ষা এবং পরীক্ষা নিয়ে কর্তা ব্যাক্তিদের নানা রকমের বাগাড়ম্বর ।

সকল জীবের মধ্য থেকে মানুষের 'মানুষ' হিসেবে উত্তরণ সম্ভব হয়েছে অজানাকে জানার আকাঙ্খা থেকে । তাই মানব শিশুর অজানাকে জানার আকাঙ্খা স্বতঃস্ফূর্ত এবং সাধারণ ।প্রতিটি মানব শিশুরই প্রশ্ন করার এবং শিক্ষা অর্জন করার ক্ষমতা আছে ।সেদিক দিয়ে কোন মানব শিশুকে মেধাবি এবং কোন মানব শিশুকে মেধাহীনের কাতারে ফেলা সম্ভব নয় । মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণীবিভক্ত করে শোষণ করার সবচেয়ে মজবুত ভিত্তিভূমি হলো কিছু সংখ্যক মানুষকে মেধাবি আখ্যায়িত করে অসংখ্য মানুষের ওপর মেধাহীনতার পরিচয় চাপিয়ে দেওয়া ।সেজন্যই যেখানে শ্রেণি আধিপত্য যত বেশি সেখানে মেধার গল্পও তত বেশি । মেধার গল্প বলে রাষ্ট্র সর্বজনীন শিক্ষার দায় এড়াতে পারে খুবই সহজে ।শিক্ষাদানের কোন প্রকার দায়দায়িত্বের মধ্যে না গিয়েই খুব সহজেই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর কাঁধে অকৃতকার্যের দায় চাপিয়ে দিতে পারে ।বিদ্যালয়ে শেখানোর কোন প্রকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন না করেও শুধুমাত্র পরীক্ষার আয়োজনের মধ্য দিয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীর খারাপ ফলাফল আর অকৃতকার্যতার দায় দিয়ে 'বৈধভাবে' তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করে দেওয়া সম্ভব । বাংলাদেশে এখন এ প্রক্রিয়া খুবই ব্যাপক এবং মসৃণভাবে কার্যকর হচ্ছে ।

বিদ্যালয়ের অবকাঠমো,বিদ্যালয়ের পরিবেশ ,পাঠদানের পদ্ধতি, পাঠদানের লক্ষ্য ,উপযুক্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক , সঠিক পাঠ্যক্রম সহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকল উপকরণ নিশ্চিত করা হলে 'মান সম্মত' শিক্ষা বলে ফাঁকা আওয়াজ দেওয়ার কোন প্রয়োজন হয় না । আর এসব নিশ্চিত করা হলে একটি শিক্ষার্থীকেও অকৃতকার্যতার গ্লানি বহন করতে হবে না । অথচ বাংলাদেশে শিক্ষার মান নিয়ে অনেক উচ্চবাচ্য করা হয় । বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী তো শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেয়েছে শিরোনামে জনগণের টাকায় বই ছেপে জনগণকে জানান দিচ্ছেন ।যা' দেওয়াই হচ্ছে না বা দেওয়া হলেও খুবই বিশৃঙ্খল, দুর্বল এবং ভিত্তিহীন তার মান নিয়ে যেখান থেকে কথা বলতে হয় এবং যা' নিয়ে কথা বলতে হয় এখন তাই করা হচ্ছে ।শিক্ষার মান নিয়ে কথা উঠলেই পরীক্ষা এবং পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন নিয়ে কথা তোলা হয় । এই প্রশ্ন প্রণয়নের সর্বশেষ সংযোজন হলো তথাকথিত 'সৃজনশীল' প্রশ্ন ।

এ নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই এ ধরণের নাম কেন প্রশ্ন পত্র পণয়নের ক্ষেত্রে ব্যবহৃৎ হচ্ছে তার একটু ছোট্ট বিশ্লেষণ প্রয়োজন ।প্রথমেই যে কথাটি বলা যায় আমাদের দেশে এখন আর পাঠদানের কোন নীতি নেই ।এখানে পাঠদান বড়ই 'সৃজনশীল' গতিতে চলছে ।এখানকার পাঠ্যক্রমও বড়ই 'সৃজনশীল' তারও কোন নীতি নেই ।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ভিত্তি এবং পদ্ধতির ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া ।সেখানে অন্তঃসারশূন্য গাদা গাদা সিলেবাসের তলায় প্রথমেই শিক্ষার্থীদের নিমজ্জিত করা হয় ।তারও কোন নীতি নেই । প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা যায় সরকার ঘোষিত সিলেবাস যা' থাকে সরকারেরই সহযোগিতায় তার দ্বিগুন সীলেবাস শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ।এ হলো শিক্ষার বিষয় বস্তু থেকে শিক্ষার্থীদেরকে দিশেহারা করে বের করে নিয়ে যাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ ।তার পরের দিশেহারা অবস্থা হলো পরীক্ষার অত্যাধিক বাড়াবাড়ি । আগেকার দিনে দেখা যেত বছরে দুটি পরীক্ষা হতে পারত ।এখন সেখানে দেখা যায় বছরে বড় পরীক্ষা হয় তিনটি এবং কোন কোন বিদ্যালয়ে চারটি ।এর মধ্যে আবার আছে শ্রেণি পরীক্ষা , সাপ্তাহিক পরীক্ষা , মাসিক পরীক্ষা নামের নানা পরীক্ষা ।এখানে শিক্ষার্থীদের সামনে পড়া-লেখার একমাত্র নির্ধারিত লক্ষ্য হচ্ছে পরীক্ষা । এখানে শেখার বিষয় গৌণ ।বিষয়ের পদ্ধতি বা ভিত্তির ওপর দাঁড়ানোর কোন সুযোগই তাদের সামনে নেই । কি পড়ছে , কি লিখছে তা ভেবে দেখার তাদের কোন অবকাশ থাকে না । পরীক্ষার খাতায় লিখতে হবে এটাই হলো আসল এবং বড় কথা ।ঠিক এরকম যখন অবস্থা তখন শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা পাশ বা ভাল ফলাফলের জন্য কোন পদ্ধতির ওপর দাঁড়ানো বা কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ নেই ।পরীক্ষায় আসবে এমন কতকগুলো প্রশ্ন মুখস্ত করতে পারলেই পরীক্ষায় পাশ এবং ভাল ফল করা সম্ভব । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শেখানোর পদ্ধতিও তেমনই ।বিদ্যালয় থেকেই সাজেশন দেওয়া হয় । নির্দিষ্ট কতকগুলো প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করার জন্য শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দেওয়া হয় । বিদ্যালয়গুলো এমন করতে বাধ্য ।এর কারণ হলো সরকারের শেখানোর পদ্ধতি নিয়ে কোন কার্যকর ব্যবস্থা না থাকলেও বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্টের পর অন্য কোন কিছু বিবেচনায় না নিয়ে শুধুমাত্র পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে বিদ্যালয়গুলোকে শ্রেণিকরণ করা হয় ।পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিদ্যালয়গুলোর এমপিও বাতিল করা হয় বা হুমকি দেওয়া হয় , শিক্ষকদের শাস্তি দেওয়া হয় , তাঁদের বেতন বন্ধ করা হয় ।এসব থেকে দেখা যায় সরকারের শেখানোর কোন দায় না থাকলেও ভাল ফলাফলের কৃতিত্বের তাদের খুবই প্রয়োজন আছে ।এসব কারণে দেখা যায় শিক্ষার কি হলো সেটা বড় কথা নয় দেশ জুড়ে প্রাথমিক স্তর থেকেই রেজাল্টের এক বিপজ্জনক সংষ্কৃতি তৈরী হয়েছে ।এই রেজাল্টের সংষ্কৃতির অন্যতম প্রধান দিক হলো প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে গাইড এবং কোচিং নির্ভর হয়ে পড়ছে । খোদ বিদ্যালয়গুলোই তার শতভাগ আয়োজন করছে । গাইড এবং কোচিং এর যে রমরমা বাণিজ্য তা বিদ্যালয়ের বাইরের কিছু নয় । তাই এর মধ্যে সকল শিক্ষার্থীকে যেতেই হবে , তা বাধ্যতামূলক ।তাই সরকারের তরফ থেকে অন্ততঃ প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক বলা হলেও সরকার তা দিতে কোনভাবেই বাধ্য থাকছে না ।প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষা ব্যয় থাকছে ভয়ানকভাবে ।

২০০৯ সালের আগে প্রাথমিক স্তরে কোন পাবলিক পরীক্ষা ছিল না ।একটা সময় ছিল বিশেষ করে ২০০০ সালের আগে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পাশের হার ছিল খুবই কম । অনেক সময় দেখা যেত শতকরা ৪০ জনেরও কম শিক্ষার্থী পাশ করতে পারত ।এ নিয়ে পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রচার মাধ্যমগুলোতে এবং যাঁরা শিক্ষা নিয়ে ভাবেন তাঁদের থেকে সমালোচনার ঝড় উঠত । বিষয়টি সরকারগুলোর দিক থেকে ছিল বেশ বিব্রতকর ।এই বিব্রতকর অবস্থা সরকারগুলো খুব দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে ।সব সরকারের সময়েই পাশের হার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতে পেতে বর্তমানে তা শতকরা ৮০ জনেরও ওপরে সাধারনভাবে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ৯০ জনেরও ওপরে ।আপাত দৃষ্টিতে পাশের এই হার যে কোন মানুষের মনেই স্বস্তির কারণ হওয়াই স্বাভাবিক ।কিন্তু এর মধ্যে বিরাট একটি ধোঁকাবাজি এবং ফাঁকি আছে । এই ধোঁকাবাজি এবং ফাঁকির চিত্রটি বের হয়ে পড়ে যখন পাশের এই হারে স্বস্তি নিয়েই কতকগুলো প্রশ্ন তোলা যায় ।প্রশ্নগুলো হলো:
(১)পাশের হার এত বড় আকারে এত দ্রুত বৃদ্ধির কারণ কি?
(২) মোট জাতীয় আয়ের অনুপাতে শিক্ষাক্ষেত্রে কি বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে ?
(৩)জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে,সে অনুপাতে কি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে?
(৪)ছাত্র শিক্ষক অনুপাতের কি আগের চেয়ে উন্নতি ঘটেছে ?
(৫)শ্রেণি কক্ষের পরিবেশ কি আগের তুলনায় উন্নত করা হয়েছে?
(৬) সকল বিদ্যালয়ে কি বিজ্ঞানাগার নিশ্চিত করে সেগুলোতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে ?
(৭)বিদ্যালয়গুলোতে কি পাঠাগার এবং তাতে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত বইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে?
(৮) বিদ্যালয়গুলোতে কি পড়ালেখার জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে ?

এসব মৌলিক প্রশ্নসহ পাশের হার বৃধির সাথে সম্পর্কিত আরো অনেক প্রশ্ন তোলা যেতে পারে ।এসব প্রশ্নের যে জবাব মেলে তাতে পাশের হার বৃদ্ধির স্বস্তি আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না ।প্রশ্ন ধরে আরো দুই এক কদম এগুলে পাশের হার এত দ্রুত এত বিরাট আকারে বৃদ্ধির রহস্য উন্মোচিত হয় এবং এ বিষয়ে সরকারগুলোর প্রতারণা স্পষ্ট হয় ।পাশের নিম্ন হার নিয়ে সমালোচনায় বিব্রত হয়ে সরকারগুলো শিক্ষার মান এবং গুণগত কোন উন্নতি না করে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের এক প্রতারণামূলক কৌশলের আশ্রয় নেয় ।শিক্ষাদানের অবকাঠামোগত এবং পদ্ধতিগত কোন উন্নতি না ঘটালেও পরীক্ষা পদ্ধতি ,প্রশ্নপত্র প্রণয়ন পদ্ধতি ,নম্বর বন্টন পদ্ধতি এবং নম্বর প্রদানের নীতির ব্যাপক প্রতারণামূলক পরিবর্তনের মাধ্যমে পাশের হার দ্রুত এবং বিরাট আকারে বৃদ্ধি করা হয় ।শিক্ষার মানের কোন উন্নতি না ঘটিয়েও এভাবে পাশের হার বাড়িয়ে দেওয়াকে অপারগতায় সরকারের উদার মনোভাব বলে কিছুটা অস্বস্তি কমানো যেতে পারত ।কিন্তু পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরের ঘটনাবলী লক্ষ্য করলে আর তেমনটি সম্ভব হবে না ।

এভাবে পাশের হার এবং সংখ্যায় সর্বোচ্চ ফল জিপিএ ৫ প্রাপ্তর সংখ্যা বৃদ্ধি করার মধ্য দিয়ে সরকার পড়ালেখার সংষ্কৃতির পরিবর্তে রেজাল্টের সংষ্কৃতি তৈরী করেছে ।বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার গুণগত কোন উন্নতি না ঘটলেও প্রতিটি বিদ্যালয়ে রেজাল্টের এক সংষ্কৃতি তৈরী হয়েছে । যা'র সাথে শিক্ষার সম্পর্কটা প্রায় বিপরীত । শুধু বিদ্যালয়গুলোতেই নয় সমাজের মধ্যেও এই রেজাল্টের সংষ্কৃতি বিস্তার লাভ করেছে ।শতকরা হিসেবে অনেক কম হলেও সংখ্যাগতভাবে বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ ফল জিপিএ ৫ পাচ্ছে ।এ ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে শ্রেণীকরণ করা হচ্ছে রীতিমত সরকারীভাবে ।বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়ে উল্লসিত হয়ে এবং নানা ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের সম্বর্ধনায় সিক্ত হয়ে পরিবারে এবং চারপাশে বেশ আমুদে পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে ।কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এসব আমোদ-উল্লাস অর্ধেকে নেমে নিঃশেষিত হচ্ছে ।এর কারণ, জিপিএ ৫ হলো সর্বোচ্চ ফল ।এই ফলের পর শিক্ষার্থীর এবং তার পরিবারের সবচেয়ে ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আকাঙ্খা এবং অধিকার থাকারই কথা । কিন্তু জিপিএ ৫ প্রাপ্তির এ সংখ্যার তুলনায় তারা যেখানে ভর্তি হতে চায় সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোট আসন সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় বিপুল সংখ্যক জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী সেখানে ভর্তি হতে পারছে না ।ফলে সমাজের মধ্যে এখন এক সংষ্কৃতি তৈরী হয়েছে যা' হলো জিপিএ ৫ এর নিচে রেজাল্ট এখন সমাজের চোখে ফেলের সমতুল্য ।এই হলো রেজাল্টের সংষ্কৃতি । এই রেজাল্টের সংষ্কৃতিতে সরকারের কি কি প্রতারণামূলক সুবিধা হচ্ছে এবং জনগণের শিক্ষার ক্ষেত্রে কি কি অসুবিধা হচ্ছে তা বলা যেতে পারত । কিন্তু এখানে সে সুযোগ নেই । অন্যখানে বলা যাবে ।

এখন আসা যাক শিরোনাম প্রসঙ্গে ।সরকারগুলো ধারাবাহিকভাবে রেজাল্টের যে সংষ্কৃতি তৈরী করেছে ,তা' করতে গিয়ে পরীক্ষার পদ্ধতি এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরীর যে নীতি গ্রহন করেছে সেদিকে তাকালে তাদের নিজেদের কাছেও সে রূপকে কদাকার বলে মনে হয় ।বিশেষ করে শিক্ষিত জনদের কাছে ।যেহেতু এই অবস্থা এমনিতেই হয়নি , হয়েছে শাসক শ্রেণির সরকারগুলোর সক্রিয়তাতেই তাই প্রকৃতপক্ষে এই অবস্থার পরিবর্তন তাদের কাম্য হতে পারে না ।আবার কদাকার রূপটিও দেখতে ভাল লাগে না ।তাই অগত্যা তার ওপর মোড়ক লাগানোর প্রয়োজন পড়ে ।তাদের মধ্যে মোড়ক নির্মানের গবেষকের অভাব নেই । শুধুই শিক্ষা বিষয়ে নয় সকল ক্ষেত্রেই তাদের যে গবেষণা , তার অধিকাংশই মোড়ক তৈরীর গবেষণা ।এ ক্ষেত্রেও যুৎসই একটি মোড়ক তৈরীর গবেষণা সম্পন্ন করা হলো ।

মোড়কের নাম 'সৃজনশীল পদ্ধতি' ।অন্য সকল কিছু অপরিবর্তিত রেখে প্রশ্ন পত্র প্রণয়ন করা হচ্ছে 'সৃজনশীল' পদ্ধতির !এই মহা আবিষ্কারের পর একদিন এক টেলিভিশন আলোচনায় একজন শিক্ষাবিদ(?)এই পদ্ধতি নিয়ে এমনভাবে বক্তৃতা করলেন শুনে মনে হলো যেখানে এই পদ্ধতি নেই সেখানে আসলে শিক্ষা বলেই কিছু যেন নেই । তাঁর মত শিক্ষাবিদ বা পন্ডিত না হয়েও এ প্রশ্ন তোলা যায়-যে শিক্ষা পরীক্ষার প্রশ্নের ধরণের সাথে আমুল বদলে গিয়ে বিরাট এক গুণগত মানে উন্নীত হয় তাকে কি আসলেই শিক্ষা বলে?এই 'সৃজনশীল' পদ্ধতিটা যে কি তার পরিচয় পাওয়া গেল যখন সবার আগে ধর্মের প্রশ্ন সৃজনশীল পদ্ধতিতে(!) করতে দেখা গেল ।ধর্মের সীলেবাসই যেমন তা-ই শিক্ষার্থীকে বলে দেয় নির্বোধ মুখস্ত করা ছাড়া কোন উপায় নেই ।পরবর্তীতে অন্যান্য বিষয়ে 'সৃজনশীলতার' যে চেহারা দেখা গেল তার বদ্ধ অবস্থা থেকে বলা যায় শিক্ষার্থীদের কাছে কতকগুলো শব্দের যেমন 'জ্ঞান', 'অনুধাবন', 'প্রয়োগ', 'উচ্চতর দক্ষতা' অপমৃত্যু ঘটে এগুলোর কোন বোধের অনুভূতি তাদের মনে আর জাগবে না ।'সৃজনশীল' কথাটিও তাদের কাছে অন্তঃসারশূন্য ,নির্বোধ, মৃত এক শব্দ ছাড়া কোন বোধের অনুভুতি সৃষ্টি করবে না ।

অন্য দিক থেকে প্রশ্ন তোলা যায় –প্রশ্নপত্রতো দুরে থাকুক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথেই কি 'সৃজনশীলতা'র কোন সম্পর্ক আছে ?প্রশ্নটা খোলাসা হয় আরো কতকগুলো প্রশ্ন থেকে ।কারো ভবিষ্যৎ সৃজনশীলতা নিয়ে বর্তমানে অন্য কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে কি?তাই সৃজনশীল প্রশ্ন বলে কিছু সম্ভব কি ?সৃজনশীলতা নিয়ে প্রতিযোগিতা হতে পারে কি?সৃজনশীলতাকে পুরষ্কৃত করা গেলেও নম্বর দেওয়া যায় কি?সৃজনশীলতা গবেষণা করে পাওয়া যায় কি ?সে অর্থে একজন বিজ্ঞানিকে সৃজনশীল বলা যায় কি? একজন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, একজন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ,একজন বেটোফেন,একজন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে,একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,একজন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁদের সৃজনশীল কাজের জন্য কোথায় গবেষণা করেছিলেন ? এসব প্রশ্নের জবাবের মধ্য দিয়ে সৃজনশীলতার বিষয়টি খানিকটা বোঝা যেতে পারে । আর এর মধ্য দিয়েই প্রশ্ন পত্রের নাম 'সৃজনশীল' রাখার অন্তঃসারশূন্যতা স্পষ্ট হতে পারে ।

মানুষের জীবনে শিক্ষা নিরন্তর চলে ।প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহন করা হোক বা না হোক মানুষের জীবনে শিক্ষা চলতেই থাকে ।তবে মানুষের জীবনের এই নিরন্তর শিক্ষার ওপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভূমিকা এবং প্রভাব আছে ।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভুমিকা এবং প্রভাব কেমন হবে এবং মানুষের জীবনকে,সমাজকে কোন্ দিকে নিয়ে যাবে তা' নির্ভর করে প্রতিষ্ঠান কাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে তার এবং তাদের লক্ষ্য কি তার ওপর । প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হয় এ পর্যন্ত মানব সমাজের অর্জিত জ্ঞানের সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে এমন এক পদ্ধতির ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া যাতে করে তারা তার ওপর দাঁড়িয়ে প্রকৃতি সম্পর্কে , সমাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করে সামনে এগিয়ে যেতে পারে ।একজন শিক্ষার্থীর কোন বিষয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কতখানি সম্পন্ন হয়েছে তার মাপকাঠি হতে পারে ঐ বিষয়ে মানব সমাজ যে জ্ঞান অর্জন করেছে তার সাথে কতখানি পরিচিত হতে পারল এবং বিষয়টির পদ্ধতির ওপর কতখানি দাঁড়াতে পারল তার ওপর ।পদ্ধতির ওপর দাঁড় করানোর জন্য একটি গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শিক্ষানীতি শিক্ষার্থীর বয়স , স্থান-কাল, পরিবেশ, সমাজ-সংস্কৃতি অনুযায়ী মানব সমাজের অর্জিত জ্ঞানকে বিভিন্ন স্তরের জন্য ভাগ করে সমন্বিত করে ।যাকে বলা হয়ে থাকে পাঠ্যক্রম ।পাঠ্যক্রম প্রণয়নে সমন্বিত লক্ষ্য থাকতে হবে এই যে , যাতে শিক্ষার্থীরা বিষয়ের পদ্ধতির ওপর দাঁড়াতে পারে।এই পদ্ধতি নিয়ে বিশদ আলোচনা হতে পারে ।এখানে শুধু উল্লেখ করা হলো ।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার লক্ষ্য যদি হয় শিক্ষার্থীদের বিষয়ের পদ্ধতির ওপর দাঁড় করানো তা' হলে তার জন্য পরীক্ষাও হবে তাদেরকে সেই পদ্ধতির ওপর কতটা দাঁড় করানো গেল তা জানার নিমিত্তে ।তাই প্রশ্নের কোন নাম নির্দিষ্ট করে দেওয়া এবং সেই নাম হেতুক শিক্ষার গুণগত মানের আমুল পরিবর্তনের বক্তৃতা দেওয়া, জনগণের শিক্ষার দায় এড়িয়ে এ নিয়ে শাসক শ্রেণির লোকদের বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছু নয়।আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করে আলোচনাটা এখানে শেষ করতে চাই ।কেউ স্বর্ণের গহনা গড়ে তার ওপর লেখার প্রয়োজন বোধ করে না 'গহনাটি স্বর্ণের তৈরী'।কেউ যদি নিশ্চিৎ জানে গহনা স্বর্ণের নয় অথচ সে সেটিকে স্বর্ণের নামে পরিচয় দিতে চায়,অথবা কারো যদি সন্দেহ থাকে তবে সে-ই গহনার ওপর লিখে রাখতে পারে-'গহনাটি স্বর্ণের তৈরী'।প্রশ্ন প্রণয়নের পদ্ধতির নাম 'সৃজনশীল' কোন হাস্যকর বিষয়ও নয় এবং তাদের কোন সন্দেহও নাই । তারা জেনে বুঝেই ভেজালকে সোনা বলে চালাতে চাচ্ছে ।