শিক্ষাই যখন অভিশপ্ত

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 26 Nov 2016, 03:27 PM
Updated : 26 Nov 2016, 03:27 PM

আপনি অভিশপ্ত নন অভিশপ্ত আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা! কি বিশ্বাস হচ্ছে না? ধরুন আপনি স্বল্প শিক্ষিত। আপনি একটি গার্মেন্টস কারখানায় সহজেই চাকুরী নিতে পারবেন। ৫০০০ টাকা থেকে শুরু করে ৮০০০ টাকা পর্যন্ত বেতন পাবেন। আপনি চাইলেই একটি কারখানার শ্রমিক হতে পারেন, হতে পারেন মটর শ্রমিক কিংবা ছোট পুঁজির ব্যবসায়ী। আপনি নিশ্চিত থাকুন আপনার মাসিক আয় ৮০০০ টাকা থেকে ১০০০০ টাকা হবে। সেই সাথে আপনি পাবেন সরকারী বেসরকারি নানা সহমর্মিতা এবং সহযোগিতা। আপনার থাকবে ইউনিয়নের অভিভাবকত্ব।

আর আপনি যদি হন শিক্ষিত বেকার। চাকুরী পাচ্ছেন না। কি করবেন? আপনার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না প্রি স্টেজের কোন কাজ করা। অথবা শ্রমিকের পেশা বেছে নেয়া। কারণ আমাদের সমাজব্যবস্থা আপনাকে অতটা উদার করে গড়ে তোলেনি। সমাজ নিজেও একেবারেই অনুদার। আপনাকে খুঁজতে হবে মানসম্পন্ন চাকুরী। আর কিছু না হোক অন্তত বিয়েটা তো করতে হবে!

এর জন্য মূলত দায়ী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। যেখানে অফিস কেরানীর যোগ্য করেই কেবল শিক্ষিত করে তোলা হয়। বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারলে যে, এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করে বেকার হয়েই থাকবে সেটা আমরা সবাই জানি। তারপরেও আমরা এই কেরানীর যোগ্যতা সম্পন্ন করেই গড়ে তুলছি প্রজন্মের পর প্রজন্ম। একই সাথে যদি অন্তত এদের উদার মানসিকতা সম্পন্ন করেও গড়ে তুলতে পারতাম তাহলেও হয়ত দেখা যেত শিক্ষিত গাড়ী চালক, শিক্ষিত চাষি, শিক্ষিত উদ্যোক্তা। যা শুধু শিক্ষিত বেকারের অপবাদই ঘোচাত না একই সাথে দেশের অর্থনীতিও নতুন গতি লাভ করত। আমরা সেটাও করছি না। তৈরি করে রেখেছি অভিশপ্ত এক শিক্ষা ব্যবস্থা।

উন্নত কাজের সুযোগ না পাওয়ায় একটি বেসরকারি কিন্ডারগার্ডেন বা বাংলা মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ হবে দেখে আবেদন করলেন। তাঁরা আপনাকে চাকুরীটা দিলেন। বেতন ধার্য করলেন ২৫০০টাকা। আপনি যখন বেতনের অংক শুনে আশ্চর্য হলেন তখন তাঁরা আবার আপনাকে আশ্বস্ত করছেন এই বলে যে, আপনার ছাত্র দেরদেরই আপনি বাসায় বা কোচিং করিয়ে ১০ থেকে ২০হাজার টাকা সহজেই আয় করতে পারবেন!

উল্লেখ্য যে এসব স্কুলের বেতন কাঠামোই ২৫০০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত। তার কারণ হচ্ছে স্কুলের জন্য নেয়া বাড়ি ভাড়া, শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করে মাস শেষে যে অংকটা দাড়ায় তা কিন্তু ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুভার। যার দায় শোধ করার পর শিক্ষকদের জন্য ভাল বেতন নির্ধারণ করা সত্যিই কঠিন। এমনকি অসম্ভবও। কেননা এদের আয়ের একমাত্র উৎস শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া বেতন। কাজেই শিক্ষার্থীর সংখ্যার উপর নির্ভর কর মোট আয়ের পরিমাণ। ফলে এরা ভাল শিক্ষকও পায় না আর শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত করেও তুলতে পারেন না। এভাবে পাড়ায় মহল্লায় অজস্র মানহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি না করে যদি মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেত তাহলে এসব বেসরকারি শিক্ষকদেরও এমন দুর্দশায় পরতে হত না। আর শিক্ষার্থীদেরও মানহীন শিক্ষায় শৈশব অতিবাহিত করতে হত না।

ঠিক একই ভাবে আপনি যদি একটি পণ্য বিপণনের পেশা বেঁছে নিতে চান আপনার বেতন ধার্য করা হচ্ছে ৫০০০ টাকা থেকে ৮০০০ টাকা। সেখানে আপনার কাজের এলাকা দেয়া হবে এমন ভাবে যাতে আপনাকে বাসা ভাড়া করে অথবা মেস ভাড়া করে থাকতে হবে, সব খরচ বাদে তাঁর হাতে কত থাকবে? এই ছেলেগুলো বাচার জন্যে কোম্পানির পণ্য ছাড়াও ভিন্ন কোম্পানির পণ্য বিক্রি করে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করে বিষয়টা যে অনৈতিক সেটা সে নিজেও জানে। কিন্তু করবে টা কি?

যারা এই স্বল্প বেতন ধার্য করছেন সব সময়ই যে তাঁরা সেটা ইচ্ছে করে করছেন তা নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত হলেও অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের চাহিদা এবং বিক্রয়ের পরিমাণের উপর কর্মচারীদের বেতন নির্ধারণ করতে হয়। সে ক্ষেত্রে ছোট ছোট এন্টারপ্রেনারদের উচিৎ প্রোডাক্ট রেঞ্জ বাড়ানো। যখন একই বিক্রয় প্রতিনিধি একই ধরনের একাধিক পণ্য নিয়ে কাজের সুযোগ পায় একদিকে যেমন তা তার মোট বিক্রির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানও বাড়তি মুনাফা লাভ করতে পারে। যেখান থেকে এন্টারপ্রেনার তাঁর কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাড়িয়ে দিতে পারেন। একজন মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে একটি উন্নত জীবন লাভের আশায়। তাঁর কর্মঘন্টার সর্বোচ্চ ব্যবহারটা যাতে সে করতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করাই একজন এন্টারপ্রেনারের দক্ষতার পরিচয়।

একজন এন্টারপ্রেনারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব কর্মচারীদের কাজের সুযোগ করে দেয়া। আর একজন কর্মচারীর প্রধান দায়িত্ব সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করা। যদি উভয় পক্ষ সঠিক পন্থা অবলম্বন করে তাহলে আর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অবকাশ থাকে না। একটু তলিয়ে দেখতে গেলে দেখব এখানেও সেই শিক্ষার গলদ। একজন মানুষ মাধ্যমিকের পরেই বিভিন্ন কারণে একজন উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারেন আবার একজন কর্মচারীও। এটা যদি আমাদের মাথায় থাকত তাহলে বিষয়গুলি স্নাতকের পরে নয় অল্প বিস্তর মাধ্যমিকেও পড়াতাম। এবং মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক সব পর্যায়েই বিষয়টিকে পাঠ্য ভুক্ত করে নিতাম। শিক্ষা ব্যবস্থাটা আর অভিশপ্ত হয়ে থাকত না।

kmgmehadi@gmail.com