মুসলমান বাঙালি যেভাবে পোশাকে অবাঙালি হয়ে উঠল (দ্বিতীয় পর্ব)

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 25 March 2017, 02:30 AM
Updated : 25 March 2017, 02:30 AM


প্রাচীন ভারতে পোশাক পরিচ্ছদ বলতে যা ছিল তা মূলত এক ফালি সাদা সরল বস্ত্র। যে বস্ত্রখানি মহিলারা ব্যবহার করলে হয়ে উঠত শাড়ী আর পুরুষ ব্যবহার করলে ধুতি। এক কথায় এ অঞ্চলের মাতৃ বস্ত্র হল শাড়ী। ঐতিহাসিক নীহার রঞ্জন রায় তার 'বাংলার ইতিহাস: আদি পর্ব' গ্রন্থে লিখেছেন, প্রাচীনকালে পূর্ব-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার চল ছিল না।

ঐতিহাসিকদের মতে সংস্কৃত 'শাটী' যার অর্থ 'এক ফালি বস্ত্র' থেকে 'শাড়ি' শব্দটির উৎপত্তি। সে হিসেবে শাড়ির শুরু তিন হাজার বছরেরও আগে। আমরা যার বিবর্তিত একটি রূপ দেখতে পাচ্ছি। মহাভারতের ধ্রুপদীর যে বস্ত্র হরণের উল্লেখ ছিল তা ছিল শাড়ী। গুপ্ত যুগের বিখ্যাত কবি কালিদাসের কুমারসম্ভব-এ শাড়ির উল্লেখ ছিল। গুপ্ত আমলের অজন্তা ইল্লা গুহার প্রাচীন চিত্রাবলীতেও ঐ এক ফালি বস্ত্র বা শাড়ীর অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে পুরুষ একভাবে তার ব্যবহার করত আর নারীরা অন্যভাবে।

তখন এই এক ফালি বস্ত্রই ছিল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ অঞ্চলের নারী-পুরুষের একমাত্র বস্ত্র। সেলাইবিহীন বস্ত্র ব্যবহারের রীতিতে পরিবর্তনের মূল ঢেউটি এসে লাগে সম্রাট অশোকের সময় যখন মৌর্য সাম্রাজ্য পারস্য, আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। পারস্য-আফগান সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে এখানকার স্থানীয় অভিজাত পুরুষদের মধ্যে এক ধরনের আত্তীকরণ দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ইল্লা অঞ্চলের পুরুষদের মধ্যে তুর্কি-আফগান সংস্কৃতি বিশেষ প্রভাব ফেলতে শুরু করে। বিশেষ করে তাদের রঙিন পোশাক এবং আলখাল্লা। এর পূর্ব পর্যন্ত সাধারণ মানুষ কেবল সেলাই ছাড়া সাদা শাড়ী আর কালিদাসের বর্ণনানুযায়ী তাতে নীল পাড় এটুকুনই দেখে এসেছে। তবে গৃহ পুরবাসিনী নারী এবং নিন্মবিত্তদের মধ্যে পারস্যের খুব একটা প্রভাব লক্ষ করা যায় না। অর্থাৎ এতদঅঞ্চলে শাড়ীর আবেদনে কখনোই ভাটা পড়েনি। এমনকি সাধারণ পুরুষের ক্ষেত্রেও ধুতিই ছিল প্রধান বস্ত্র। যদিও অনেক সময় তারা দুই খণ্ড বস্ত্র ব্যবহার করতেন। একখণ্ড ধুতির মত করে নিন্মাঙ্গ আচ্ছাদনে আরেক খণ্ড রোদের থেকে বাঁচতে ঊর্ধ্বাঙ্গে পেঁচিয়ে নিতেন। সম্ভবত সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দুর্বলতাই ছিল তার প্রধান কারণ।

উচ্চবিত্তের পোশাকের যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল সেখানে ধর্ম কোন উপলক্ষ ছিল না। সেটা ছিল নিতান্তই নতুনের প্রতি আকর্ষণ মাত্র। কেননা এই পরিবর্তনটা এসেছিল জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে। আলোচ্য চিত্রটি গুপ্ত সাম্রাজ্য তথা খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর যা পরবর্তী প্রায় এক হাজার বছরেও খুব বেশি পাল্টায় নি। ইতিমধ্যে শাড়ীর বুনন উন্নত হয়েছে, মিহি সুতো এসেছে, শাড়ীতে রঙ এসেছে, পাড় এসেছে। নতুন নতুন ডিজাইনে ধুতি শাড়ী সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই কিন্তু তার আবেদন কমেনি। এ অঞ্চলে আলাদা আলাদা ধর্ম বর্ণের অস্তিত্ব ছিল ঠিকই কিন্তু পোশাকে তার তেমন কোন প্রতিফলন ছিল না।

মৌর্য, গুপ্ত, চালুক্য, চোল, পল্লব-পাণ্ড্য রাজন্যবর্গের হাত ঘুরে ৭১২ খৃষ্টাব্দে আরব সেনানায়ক মুহাম্মদ বিন কাশিম কর্তৃক প্রথম এ অঞ্চলে মুসলমানদের কর্তৃত্ব শুরু হয়। পরবর্তী ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লি সালতানাত ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত মুঘল শাসন। তৎপরবর্তী দুইশ বছর ইংরেজ শাসন।

সুদীর্ঘ এই সময়ে এ অঞ্চলের মানুষ পরিচিত হয়েছে নানান সংস্কৃতির সাথে। স্বাভাবিক ভাবেই পোশাকে, আচারে, ভাষায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। আবহমান বাংলার সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে নিত্য নতুন বিষয়। একই সাথে নিজস্ব সংস্কৃতি ক্রমশ উন্নত হয়েছে। আবহমান বাংলার সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে ভিন্ন সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গও। কিন্তু নিজস্ব ঢঙে নিজস্ব সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেই এগিয়েছে বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতি। বাঙালি ধর্মান্তরিত হয়েছে ঠিকই তবে তা মননে, পোশাকে নয়।

তারা একই পুকুরে স্নান সেরেছে, এক নদীতে মাছ ধরেছে, কৃষিকাজ করেছে, যাত্রাপালা দেখেছে তারা হাতে হাত রেখে প্রকৃতির রুঢ়তা বা মানব সৃষ্ট দুর্যোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে আবার যার যার প্রার্থনা গৃহে গিয়ে উপাসনাও সেরেছে। এ হচ্ছে একেবারেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা। তবে সে সময় তারা যে খুব সুখে ছিল তাও নয়। তবে জাতিগত বিভেদ ছিল না।

মুঘল আমলের শেষাংশে এসে এই চিত্রটা পাল্টাতে শুরু করে। তখন থেকেই মূলত হিন্দু-মুসলমানের অর্থনৈতিক পরিবর্তন সমাজ কাঠামোতে এক ধরনের ক্ষয়িষ্ণুতার জন্ম দেয়। এর সাথে ক্ষমতার পালাবদল সহ সমাজ-কাঠামোর উপকরণে ভিন্নতা সৃষ্টি ক্রমশ হিন্দু – মুসলিমের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তুলতে শুরু করে। যার প্রথম ধাক্কাটা এসে পরে ১৭১৩ মতান্তরে ১৭১৪ সালে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং সংঘর্ষ রূপ নেয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। সেটাই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম দাঙ্গা। এছাড়াও ভারতবর্ষে আর্য থেকে মুসলিম প্রবেশ পর্যন্ত জাতিতে জাতিতে, গোত্রে গোত্রে যেসব রক্তপাত হয় সে সব ঘটনা ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। যার সাথে সাধারণের সম্পর্ক ছিল না।

আহমেদাবাদের সেই দাঙ্গাই মূলত প্রতিক্রিয়াশীলদের চোখ খুলে দেয়। পরবর্তীতে ইংরেজ শাসকরা সেখান থেকেই রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে এই কূট কৌশলটা গ্রহণ করে। তারা বুঝতে পারে ভারতবর্ষে ধর্মে ধর্মে সংঘাত লাগিয়ে দেয়াটাই হবে এ অঞ্চলে টিকে থাকার কার্যকর কৌশল। ইংরেজদের কূটকৌশল এবং অর্থনীতিতে ইঙ্গ-মার্কিন পূঁজির প্রভাবে দিনে দিনে এ অঞ্চলে দাঙ্গার চরিত্রে রাজনৈতিক রঙ লাগতে শুরু করে।

উপরোক্ত বিষয়টি আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করার কারণ হল বাংলার সংস্কৃতিতে এর প্রচ্ছন্ন প্রভাব। পূর্বেই উল্লেখ করেছি ইংরেজ শাসকগণ শুরুতেই চেয়েছিল ধর্মে ধর্মে সংঘাত লাগিয়ে দিতে কিন্তু বাঙালি হিন্দু মুসলিম যদি একই পোশাক একই সংস্কৃতিকে লালন করতে থাকে তাহলে তো তাদের মধ্যে স্থায়ী সংঘাত সৃষ্টি সম্ভব নয়। কাজেই এদেরকে পোশাকে, ভাষায়, উৎসবে আলাদা করে ফেলতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করল। তারা ধুতিকে হিন্দুয়ানী পোশাক, জলকে হিন্দুদের ভাষা, নবান্নকে হিন্দুদের উৎসব বলে চিত্রায়িত করল। আর এটা করতে তারা তৎকালীন মুসলিম নেতা এবং মৌলভীদের ব্যবহার করলেন।

তারা সূফীবাদের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত বাঙালি মুসলমানদের পোশাকি মুসলিমে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চালাতে লাগলেন। যেখানে যুক্ত হল পারস্পরিক বিদ্বেষ, হিংসা হানাহানি। মুসলমান বাঙালিদের এই পোশাকি মুসলিম হয়ে ওঠাটা ছিল নিছক এক শঠতা। তারা মহানবী (সঃ) যে হাদিস সমূহকে কে এর পেছনে যুক্তি হিসেবে দেখাল তা হচ্ছে-

মহানবী (সঃ) হযরত আলী (রা) কে দুইটি হলুদ রংয়ের কাপড় পরা অবস্থায় দেখলেন। তিনি তখন বলেন, এই রং কাফেরদের জন্য, এই রঙের কাপড় পরিধান করবেননা না। – কিতাব মুসলিম শরীফ: হাদিস শরীফ নং ২০৭৭।

অন্য এক হাদিস শরীফে এসেছে, "এক লোক দুইটা লাল পোশাক পরা ছিল; আর সে হুযুর পাক (সঃ) কে সালাম দিলো। হুযুর পাক (সঃ) তার সালামের জবাব দিলেন না। কারণ লাল রঙ্গের পোশাক কাফেরদের জন্যে আর কাফেরদের সালাম দেওয়া নিষেধ। – আবু দাউদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ।

তৃতীয় আরেকটি হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, "যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে সামঞ্জস্য রাখে সে তাদের দলভুক্ত।' – সুনানে আবু দাউদ শরীফ ২/৫৫৯।

অন্য এক হাদিস পাওয়া যায় যেখানে বলা হয়েছে, "কোন একজন সাহাবী কাফেরদের পোশাক পরলে রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন 'নিশ্চয়ই এটি কাফেরদের পোশাক। তোমরা তা পরিধান করো না।'– সহীহ মুসলিম শরীফ: ৬/১৪৪।

উপরোক্ত হাদিস সমূহের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হল কাফেরদের পোশাক মানে বিধর্মীদের অনুকরণে পোশাক পরিধান করা নাজায়েয। যেমন ইহুদী-খৃষ্টান পুরোহিতদের পোশাক। হিন্দুদের ধুতি-লেংটি, মাজার পূজারীদের লালসালু এবং শিয়াদের অনুকরণে পূর্ণ কালো পোশাক ইত্যাদি।

উপরোক্ত আলোচনায় এটা নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়ে যায় যে ধুতি বিজাতীয় পোশাক কিনা তা ছাড়া পাঠক নিজেই বিচার করতে সক্ষম হবেন যে এখানে হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করা হল কিনা।

এভাবেই বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয় বর্জনের ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত করে তোলা হল। দ্বিধান্বিত বলছি এ জন্য সবাই তাদের এই ধারণায় উদ্বুদ্ধ হলেন না। ফলে বাংলার মুসলমানগণও বিভক্ত হয়ে পড়ল। ভালো ভাবে লক্ষ আমরা আজকের বাংলাদেশে যে জঙ্গিবাদের থাবা তার পেছনেও এই সুদীর্ঘকালের ষড়যন্ত্রের যোগসূত্র খুঁজে পাবো, যা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা যাবে।

চলবে….
kmgmehadi@gmail.com