বাবা-মেয়ের আত্মহত্যা এই সমাজ ব্যবস্থার গালে সজোরে চপেটাঘাত

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 5 May 2017, 07:40 PM
Updated : 5 May 2017, 07:40 PM

দিনমজুর হযরত আলী তার প্রথম শ্রেণিতে পড়া শিশুকন্যা আয়েশা আক্তারকে নিয়ে ট্রেনের তলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেননি, ঘূণ ধরা পচে যাওয়া এই সমাজের গালে সপাটে এক চপেটাঘাত করে গিয়েছেন। কিন্তু তাতে লাভটা কি হল? সে চড় কি আমাদের আত্মসম্মান বোধে ঘা দিতে সক্ষম হয়েছে? আমরা কি আমাদের ত্রুটিটা বুঝতে পারছি? যাদের আত্মসম্মান বোধই নেই তাদেরকে কি আর অসম্মান করা যায়?

ঠিক তাই, আজ যারা সমাজপতি হয়ে বসে আছেন তাদের সব আছে নেই শুধু ঐ আত্মসম্মান বোধটুকু, নেই সামান্যতম দায়িত্ববোধ। আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সমাজপতিরা তাদের দায়িত্ববোধ একই সাথে আত্মসম্মানবোধ বন্ধক রেখেছেন ক্ষমতার কাছে, অর্থের কাছে। শুধু তাই নয় আমরা সমাজ পতি হিসেবে বেছে নিতে শুরু করেছি সমাজবিরোধীদের। এটা যে কেবল নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলে তা কিন্তু নয়। শহর, উপশহর, গ্রাম, প্রত্যন্ত পল্লী সর্বত্রই এক চিত্র। আমরা আজ এমন একটি সমাজে বসবাস করছি যেখানে কেবলমাত্র ক্ষমতাবানদেরই জায়গা হয়। কেবলমাত্র ক্ষমতাবানরাই পান প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা। এখানে ক্ষমতাহীনদের নেই বেঁচে থাকার নূন্যতম নিরাপত্তা।

আজ আমাদের সমাজপতি হয়ে বসে আছেন জেল খাটা আসামি, কালো টাকার মালিক। হত্যা-লুণ্ঠনে চ্যাম্পিয়ন মানুষগুলো। কি রাজনীতি, কি সমাজপতি সর্বত্রই একই চিত্র দৃশ্যমান। আমি যে ভিত্তিহীন কথা বলছি না তার জলজ্যান্ত প্রমাণ, পটুয়াখালীর গলাচিপায় ধর্ষণ মামলায় জেল খাটা ব্যক্তিকে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি করা। খবরে প্রকাশ, গত ২৭ এপ্রিল ইউপি মেম্বার মোসলেম গাজীকে চর বিশ্বাস ইউনিয়নের ১৬৭ নম্বর চরআগস্তি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি করা হয়। কে তাকে সভাপতি করলেন? ঐ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোফাজ্জেল হোসেন বাবুল মুন্সী। (জনকন্ঠ ৪.৪.১৭)

জেল খাটা ধর্ষক ঐ মানুষটি কিন্তু তার এলাকার একজন জনপ্রতিনিধি। আবার তার পৃষ্ঠপোষক তার থেকেও বড় একজন জনপ্রতিনিধি। কারা তাদেরকে জন প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ করে দেন? আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। আবার কারা তাদের নির্বাচিত করেন? আমাদের মত দায়িত্ব জ্ঞানহীন সাধারণ মানুষগুলো।

এই সব জনপ্রতিনিধিদের মাসল ম্যান হিসেবে কাজ করে এলাকার বখাটে ছেলেরা। তারাই যখন এলাকায় মেয়েদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনে বিঘ্ন ঘটায় তখন সাধারণ মানুষ প্রথমেই যে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারস্থ হন তারা কি করে তাদেরই মাসল ম্যানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন? তাছাড়া যারা নিজেরাই পাপ পঙ্কিলতায় আকণ্ঠ ডুবে আছেন তাদের কাছ থেকে দায়িত্ববোধের আশা করাটাই তো বোকামি।

কাজেই বাবা-মেয়ের এই নির্মম মৃত্যুর দায় ঐ এলাকার জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালীদেরও নিতে হবে। নিতে হবে আমাদের সবার। কেননা আয়েশার পরিবারের বখাটে ফারুকের বাবার কাছে গিয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাহায্য চেয়েছে। ইউপি সদস্য আবুল হোসেনের কাছে গিয়েছে কিন্তু কোন প্রতিকার পায়নি। উপরন্তু এর ফলে অভিযুক্ত ফারুক হযরত আলীর গরু নিয়ে জবাই করে সবাই মিলে ভাগ করে খেয়ে ফেলেছে। এত বড় ঘটনাটি নিয়ে কেন এলাকার মানুষ সোচ্চার হল না?

তার একটিই মাত্র কারণ, আর তা হল হযরত আলী এ দেশের একেবারেই প্রান্তিক পর্যায়ের একজন মানুষ। যার অর্থ নেই, যার কোন রাজনৈতিক যোগাযোগ নেই। স্বভাবতই সে ছিল একজন ক্ষমতাহীন মানুষ।

হযরত আলি ও তার মেয়েকে খুন করেছে এ দেশের কুলষিত রাজনীতি, আমাদের পচে গলে যাওয়া দুর্গন্ধময় এই সমাজ ব্যবস্থা সর্বোপরি আমাদের দুর্নিতিগ্রস্থ প্রশাসন। কারণ শেষ পর্যন্ত গত ৪ এপ্রিল হযরত আলি শ্রীপুর থানায় অভিযোগ পর্যন্ত করেছিল কিন্তু তাতেও কোনও কাজ হয়নি। তার মানে হল হযরত আত্মহত্যা করতে চায়নি চায়নি প্রানপ্রিয় শিশুটিকে হত্যা করতে। তাকে সবাই মিলে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে আর সে তার প্রানপ্রিয় মেয়েটিকে চিল শকুনের আহার হতে দিতে চায়নি বলেই তাকেও মেরে ফেলেছে। এ সমাজ একজন হযরত আলি একটি সাত আট বছরের শিশু কন্যার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ লজ্জা এই সমাজের এ দেশের প্রশাসনের। সর্বপরি রাষ্ট্রযন্ত্রের।

একজন প্রান্তিক মানুষ যখন ন্যায়বিচার চেয়ে সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে বিমুখ হয়ে ফিরে আসে তখন তার আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া ছাড়া আর কীইবা করার থাকে? আজ হযরত আলি ও তার মেয়ে এমন নির্মম হত্যার স্বীকার হল বলে আমরা কথা বলছি। লেখা লেখি হচ্ছে হয়ত অভিযুক্ত ফারুক ধরা পরবে এমন কি তার বিচারও হবে। তার মানে কি এই যে, প্রতিটি বখাটেকে বিচারের আওতায় আনতে এবং সমাজকে উচ্চকিত হতে বাধ্য করতে সকল ভিক টিমকে আত্মহত্যা করতে হবে?

খোদ রাজধানী ঢাকার হাজারীবাগে আজ মৌসুমি আক্তার নামে আরেকজন গার্মেন্টস কর্মী এই বখাটেদের উৎপাতে নিজ ঘরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এভাবে একের পর এক ভুক্তভোগীরা আত্মহত্যা করবে। প্রশাসন গা ঝারা দিয়ে উঠবে। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। আর আমরাও থেমে যাব। কিন্তু রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে এই বিষবৃক্ষ গজিয়ে উঠছে তা নির্মূলে আমরা কোন ব্যবস্থাই নিচ্ছি না। সামাজিক প্রতিরক্ষা বুহ্য গড়ে তুলছি না। সবাই দায় এড়িয়ে চলছি। এভাবে চলতে থাকলে এ দেশ আর সাধারণ মানুষের বসবাস উপযোগী থাকবে না।

এর অবসান চাইলে এগিয়ে আসতে হবে সাধারণ মানুষকেই। প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। সমাজ যদি শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয় তাহলে প্রশাসন আপনা থেকেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে। আমরা সমাজের প্রতিটি সন্তানকে নিজের সন্তান বলে মনে করলেই কেবল সকল শিশু, কন্যা, নারী নিরাপত্তা লাভ করবে। আমরা এটা কেন ভেবে দেখছি না এমন দ্বায়িত্বহীনতা পশুর মাঝেও দেখা যায় না। অথচ নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে দাবী করে আচরণটা করছি পশুর থেকেও অধম।

পশুদের সমাজে কেবল ক্ষমতাবানদেরই জায়গা হয় অক্ষমদের নয় আমরা যেন সেই সমাজের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব প্রান্তিক পর্যায়ে নেতৃত্ব সুজনদের হাতে তুলে দেয়া; দুর্জনদের হাতে নয়। যাতে সাধারণ মানুষ তাদের কাছ থেকে ন্যায় বিচার পেতে পারে। আর প্রান্তিক পর্যায়ে যদি ভাল মানুষদের নেতৃত্ব নিশ্চিত করা যায় তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিটি স্তরে ভাল মানুষদের নেতৃত্ব নিশ্চিত হবে। যা একটি উন্নত সমাজ বিনির্মাণে অত্যন্ত জরুরি।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, আইনের হাত যত বরই হোক তা প্রত্যন্ত এলাকা এবং তৃণমূল অবধি পৌঁছায় না অথবা বলা যায় অর্থ আর ক্ষমতার প্রতিবন্ধকতা পেড়িয়ে আইনের হাত শেকড় অব্দি পৌঁছুতে পারছে না। অর্থের নামে এই অনর্থ, ক্ষমতার নামে এই ক্ষমতার অপব্যবহারের এই সংস্কৃতি ভেঙ্গে ফেলা জরুরি। তবেই এ সমাজে হযরত আলী, মৌসুমি আক্তারদের মত প্রান্তিক মানুষগুলো সম্মানের সাথে বাচতে পারবে। এ সমাজকেই পুনর্বাসিত করতে হবে সব হারানো হালিমাদের। নয়ত আমরা নিশ্চিত ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে যাব।

kmgmehadi@gmail.com