‘বঙ্গবন্ধু’ একটি ইমেজের নাম

মোঃ গালিব মেহেদী খান
Published : 6 August 2017, 08:02 AM
Updated : 6 August 2017, 08:02 AM

পঁচাত্তর পরবর্তী প্রায় পঁচিশটি বছর এ দেশে বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়াও অলিখিত ভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এমন কি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নতুন নতুন গপ্প ফাঁদা হয়েছিল। জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর স্থানে বসানোর কত চেষ্টাই না করা হয়েছে। তাতে কি আসল সত্য ইতিহাস থেকে মুছে গিয়েছিল? মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি মুছে দিয়ে গণ্ডগোল শেখানো হয়েছে। অর্বাচীনের মত মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। ভুঁইফোঁড় নেতা হিসেবে জিয়াকে নিয়ে আসা হয়েছে। একটি ঘোষণাপত্র পাঠকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছে। তাতে কি লাভ হয়েছে? ষড়যন্ত্রের মেঘ ফুড়ে সত্যের আলোটাই শেষ পর্যন্ত উদ্ভাসিত হয়েছে।

দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রের পরেও কি বঙ্গবন্ধু ইতিহাস থেকে মুছে গিয়েছিলেন, না তাঁর ভাবমূর্তির সামান্য তম ক্ষতি সাধন করা গেছে? বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য এ দেশের মানুষের মণিকোঠায় যে স্থানটি তাঁরা নিজেরাই স্থাপন করে গেছেন তাদের কর্মের মাধ্যমে তাঁরা তিলমাত্র স্থানচ্যুত করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে প্রকাশ্য স্থান থেকে লুপ্ত করে ফেলা হয়েছিল আর তাতে এ দেশ বাসির হৃদয়ের মণিকোঠায় তাঁর আশ্রয় আরও বেশী মজবুত হয়েছে।
অথচ কি আশ্চর্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেই বঙ্গবন্ধুর সম্মানহানি নিয়ে বেশী চিন্তিত! আজ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এমন আরম্ভর শুরু করা হয়েছে যে তাকে এখন আবার হৃদয়ের মণিকোঠা থেকে বেড়িয়ে সারম্ভর সভায় যোগ দিতে হচ্ছে। এটা আওয়ামীলীগের জন্য কতটা কল্যাণ বয়ে আনছে তা তারাই ভালো জানেন। তবে এটুকু বুঝতে পারি ভালোবাসার মানুষকে যদি কেউ ভালোবাসার জন্য পিড়াপিড়ি করে তাতে বিড়ম্বনাই বাড়ে।

দুই যুগ ধরে বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষরা হেয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। তাঁরা ভেবেছিল তাঁরা তাদের অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছে গেছে। আর দুই যুগ পরে যখন সেই বঙ্গবন্ধুর নামেই আওয়ামীলীগ নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হল। তখন তাঁরা প্রমাদ গুনতে শুরু করল। এতদিন পরে এসে তাঁরা বুঝতে পারল ঐতিহাসিক সত্য পরিবর্তন করা যায় না। চাইলেই জাতির জনককে জাতির মন থেকে মুছে ফেলা যায় না।

আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের এতদিন পরে মনে হল, বঙ্গবন্ধুর ইমেজ রক্ষার জন্য আইন করতে হবে। অবশ্যই তাদের কাছে এর পক্ষে যুক্তি আছে। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ মানুষ। যারা সামান্য বুদ্ধি নিয়েই জীবন পার করে দেই তাদের প্রশ্ন হল-

যারা কোন লাভের আশায় নয় কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসেই তাকে নিয়ে গবেষণা করেন, তাকে চর্চা করেন, তার ছবি আঁকেন। তাঁরা কি মুক্তভাবে আর কাজটি করতে পারবেন? 'বঙ্গবন্ধু' একটি ইমেজের নাম। যা নষ্ট করার আসলে কোন সুযোগই নেই।

গবেষনাধর্মী এসব কাজ প্রত্যেকে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গিতেই করে থাকেন। সেটা সকলের কাছে তো ভাল নাও লাগতে পারে। এই ভাল না লাগা থেকে অথবা নিছকই রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের কারণে যদি কেউ সেই গবেষকের বিরুদ্ধে কোটি টাকার মানহানি মামলা করে দেয়। তাহলে কী হবে?
একটি শিশু বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকলে সে ছবি শিল্প বোদ্ধাদের বিচারে অসংখ্য ত্রুটিযুক্ত হতেই পারে, শিশুটি কিন্তু ছবিটা এঁকেছে তাঁর হৃদয় নিঃসৃত ভালবাসার তুলিতে, বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে, শ্রদ্ধার জায়গা থেকে। সেটা কি রাজনৈতিক ফটকাবাজরা বুঝতে পারবে বা বুঝতে চাইবে?

কোন শিশু একটি অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণ আবৃত্তি করতে গিয়ে যদি অনিচ্ছাকৃত ভুল করে বসে আপনি কি সেই শিশু অথবা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করবেন? যদি তাই হয়, তাহলে আমি আমার সন্তানকে এই ভাষণটি মুখস্থ করতেই নিষেধ করব। নিষেধ করব কোন প্রতিযোগিতা বা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকতে। আমি কি তবে আমার সন্তানকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখতেও নিষেধ করব! প্রশ্ন হল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা বঙ্গবন্ধুর পরিবার কি তাই চান?

বঙ্গবন্ধুকে যে কেবল আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী এক কথায় সুবিধা ভোগীরাই ভালবাসেন তা তো নয়। বরং তাদের থেকে সংখ্যায় অনেক বেশী মানুষ জাতির জনক হিসেবে তাকে ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন নিঃস্বার্থভাবে। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণের চেষ্টা করেন। এদের এই চর্চার ক্ষেত্রে কোন অনিচ্ছা কৃত ত্রুটিকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা উঠাতে যদি যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়ার সুযোগ পেয়ে যায় তাহলে তো এরপরে আর কেউ ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করবেন না। বঙ্গবন্ধুর চর্চা করবে না তার ছবি আঁকবে না। তাতে কি বঙ্গবন্ধুকে যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হবে? বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হবে?

এটা তো বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসা নয়, এটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহারের আরেকটি তরিকা অথবা আগামী প্রজন্মের মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার আরেকটি চক্রান্ত!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিষয়টি কি একটু ভেবে দেখবেন?