আমি কি একটা মামলা করতে পারব?

দিব্যেন্দু দ্বীপ
Published : 30 March 2016, 07:59 PM
Updated : 30 March 2016, 07:59 PM

২০১১ সালের ডিসেম্বর বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে আমি সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদান করেছিলাম। মোল্লাহাট, বাগেরহাট শাখায় পোস্টিং হয়েছিল। যেহেতু ৫ ডিসেম্বর শাখায় যোগদান কেরছিলাম, কিছুদিন পরেই ছিল ব্যাংক ক্লোজিং। ক্লোজিং-এর কাজ করতে গিয়ে ব্যাংকিং না বুঝলেও কমন সেন্স থেকে অনেক কিছু সমস্যা মনে হয়েছিল। বিশেষ করে পুরনো অনেক লেজার। বিশেষ করে একটা ঘটনা অকাট্যভাবে আমার নজরে এসেছিল। সেটি ছিল- পুরনো একটি লোনের টাকা আদায় হলেও তা লেজারে জমা না করা।

এখানে বিষয়টি একটু পরিষ্কার করা দরকার। ব্যাংকে কিছু লোনকে বলা হয় বিএল (ব্যাড লোন বা কু ঋণ), অর্থাৎ যে লোনগুলো আর আদায় হওয়ার সম্ভবনা নেই। ঐ শাখায় বিএল-এর ক্ষেত্রে মূলত ঐ ধরনের ঘটনা ঘটত। কু-ঋণ এর আরেকটি বৈশিষ্ট আছে- কুঋণের সুদ বাড়ে না। যখন কোন ঋণের টাকায় সুদ যোগ হতে হতে তা সুদাসলে আসলের দিগুণ হয়ে যায় বর্তমানে নিয়মানুযায়ী তাতে আর সুদ বাড়ে না। সেক্ষেত্রেও ব্রাঞ্চটি জালিয়াতি করছিল, অর্থাৎ খসড়া কাগজে সুদ বৃদ্ধি দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে পকেটে পুরছিল। যেহেতু কৃষি ব্যাংকের বেশিরভাগ গ্রাহক ছা-পোষা টাইপের তাই তাদের পক্ষে খোঁজখবর নিয়ে বা আন্দাজ করে কিছু বোঝা সম্ভব ছিল না। আর তারা এসব করত লোক বুঝে। পাশাপাশি লোন প্রদানে প্রচলিত সব দুর্নীতি তো ছিলই। এমনকি একাউন্ট খুলতেও তারা টাকা নিত।

তবে আমার কাছে একেবারে হতদরিদ্র মানুষের কাছ থেকে টাকা এনে তা ব্যাংকের ফান্ডে জমা না করার ব্যাপারটা ছিল একেবারেই অমানবিক। তাও আবার কুঋণের ক্ষেত্রে যা আদায় হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে ব্যাংক। একদিন ফিল্ডে গিয়ে সেসব মানুষের অবস্থা যা দেখেছিলাম, তা ছিল এককথায় করুন।

এরপরে যখন জুন ক্লোজিং আসল তখন বিষয়টি আমার কাছে মোটামুটি পরিস্কার হয়ে গেছিল। যাই হোক, কিছুই করার ছিল না। আবার ভালও লাগছিল না। জানতাম ব্যাংকের নির্বাহী বিভাগকে জানিয়ে খুব একটা লাভ হবে না, কারণ, তাদের তো বিষয়টি অজানা থাকার কথা নয়। তখন কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। প্রমাণ সাপেক্ষ বিষয়গুলি জানিয়ে ওনাকে একটি মেইল করেছিলাম। উনি মেইলের প্রেক্ষিতে তদন্তে খুলনা অঞ্চলের দুইজন ডিজিএম পাঠান। কিন্তু দুঃজনকভাবে তদন্ত বিষয়ের উপর না হয়ে তদন্ত হয় আমার উপর। এবং পরবর্তীতে আমি নানানভাবে হেনস্থার শিকার হতে থাকি। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে ওখানে বসে চাকরি করাটাই একরকম অসম্ভব হয়ে পড়ে । ফলে আমি খুলনায় গিয়ে বাসা নিই। তাতেও নিস্তার নেই। ব্যাংকে আমাকে ইনএকটিভ রাখা হয়। এবং সকল দিক থেকে অসহযোগিতা করা হতে থাকে। এভাবে যাওয়ার পর যখন বর্তমান চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হয়, তখনই তারা চূড়ান্তভাবে আমাকে নির্যাতন করা শুরু করে। ট্রান্সফার করে পাঠিয়ে দেয় বিভাগ পরিবর্তন করে বরিশাল জিএম অফিশে। ওখান থেকে দিনের দিনে ট্রান্সফার দিয়ে পাঠিয়ে দেয় ভোলার চরফ্যাশন। সেখানে সাধারণত চুরি করে কেউ ধরা পড়লে তাকে ট্রান্সফার দেওয়া হয়। তো আমার সাথেও স্থানীয়দের আচরণ সেরকম হচ্ছিল।

এভাবে কয়েক মাস চাকরি করার পর অসুস্থ হয়ে বাড়ি চলে আসি। একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে অসুস্থতার কথা জানাই। পরে এক ধরনের মানুসিক ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে যাই। মাঝখানে একটি বিসিএস পরীক্ষা দিই। রিটেন পরীক্ষা দিয়ে ভাইভা পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। যদিও আমি কৃষি ব্যাংকে বাই চয়েজ গিয়েছিলাম এবং আমি ছিলাম রিক্রুটমেন্ট রেজাল্টে ফোর্থ পজিশনে, কিন্তু সামগ্রীক বাস্তবতায় বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

বিসিএস ভাইভা পরীক্ষায় যেহেতু সার্টিফকেটের মেইন কপি প্রয়োজন হয়, তাই ওগুলো নিতে আমি কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আসি, কারণ, সার্টিফিকেটগুলো চাকরিতে যোগদান করার সময় ছয় মাসের জন্য জমা রাখা হয়েছিল যাচাই-বাছাইয়ের জন্য। সাটিফিকেট নিতে এসে দেখি আমার সার্টিফিকেট প্রধান কার্যালয়ে নেই, বরিশালের জিএম সার্টিফিকেট তার কার্যালয়ে নিয়ে রেখেছেন। হাতে সময় ছিল না। তড়িঘড়ি করে বরিশাল যাই। ওখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শাখায়। শাখা থেকে পাঠানো হয় ভোলা অফিসে। ভোলা থেকে বলা হয় সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে না। রিজাইন দিলে সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে, অন্যথায় দেওয়া যাবে না। উপায়ান্তর না দেখে আমি রিজাইন দিয়ে সার্টিফিকেট নিই। আমার কাছ থেকে অবৈধভাবে তিন মাসের টাকা কেটে নেওয়া হয়। যেহেতু আমি চাকরি করেছিলাম এগারো মাস এবং চাকরি স্থায়ীকরণ হয়েছিল না, তাই তিন মাসের টাকা কেটে নেওয়ার কোন সুযোগ ছিল না।

বিসিএস ভাইভা দিয়েছিলাম বটে কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম- হবে না, কারণ, সম্ভবত ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের কোন কর্মকর্তা আমার নামে ফরোয়ার্ডিং পাঠিয়েছিল। ভাইভায় সে ধরনের প্রশ্ন ছিল।

এরপর বিষন্নতায় পেয়ে বসে। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকি। টানা দুই বছর বিষন্নতার ওষুধ খেয়েছি। তবে বিষয়টি কোনভাবেই কখনো মেনে নিতে পারছি না। চাকরি করার দরকার নেই, কিন্তু এই অবিচারের বিরুদ্ধে কিছুই কি করার নেই? একটা মামলা অন্তত করতে চাই। ডিসেম্বর ২০১২ থেকে ২০১৬, তিন বছরের বেশি সময় চলে গিয়েছে অবশ্য।