কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘তাইচুং পাওয়ার প্লান্ট’ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ তাইওয়ান

দিব্যেন্দু দ্বীপ
Published : 13 August 2016, 05:45 AM
Updated : 13 August 2016, 05:45 AM

তাইওয়ান স্বীকৃত স্বাধীন দেশ না হলেও প্রায় স্বাধীন, শুধু তাদের প্রতিরক্ষা নিয়ন্ত্রিত হয় চীন থেকে। দ্বীপ দেশ তাইওয়ান একটি শিল্পোন্নত দেশ। এবং তাদের এই উন্নতির মূল চাবিকাঠি হচ্ছে তাপ (কয়লা) বিদ্যুৎকেন্দ্র। ৫৫৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন তাইচুং পাওয়ার প্লান্টটি তাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। তাইওয়ানে মোট পাঁচটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে সবচে' ছোটটির (বর্তমানে যেগুলো চলমান) উৎপাদন ক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট (রামপাল ১৩৫০ মেগাওয়াট)। একটির সংস্কারকাজ চলছে। বাকি দুটির উৎপাদন ক্ষমতা ৪০০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি করে। এর মধ্যে 'লিকু' বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নিউ তাইপে তে অবস্থিত, যেটির সংস্কারকাজ চলছে। নিউ তাইপে চা শিল্পের জন্য বিখ্যাত, শুধু বিখ্যাত নয় সুবিখ্যাত। অর্থাৎ মাত্র ৩৬০০০ বর্গ কিলোমিটারের এই দেশটি প্রতি বছর বিপুল পরিমান কয়লা (৭০ মিলিয়ন টন) পরিবহন করে তার দেশের উপর দিয়ে, এই কয়লার সিংহভাগ আমদানী নির্ভর। ২০১৬ তে তাইচুং বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সম্প্রসারিত হয়ে আরো ৮০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াচ্ছে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যোগ না করলেই নয়। তাইওয়ান হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে ২৬তম, যাদের মোট ভূমি অনুপাতে বেশি বনাঞ্চল রয়েছে। তাইওয়ানের মোট ভূমির প্রায় ষাট ভাগ বনভূমি।

শিল্প সমৃদ্ধ ছোট্ট দেশ তাইওয়ানের ৪০ভাগ আসে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। অবস্থান বিচারে পুরো তাইওয়ান জুড়েই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। তাইওয়ানে একজন মানুষও বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে নয় এবং তাদের মোট বিদ্যুতের অধিকাংশ ব্যয় হয় শিল্পে (৫৫%)। প্রায় আড়াই কোটি মানুষের দেশ তাইওয়ানে বর্তমান মোট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ৪১ গিগা ওয়াটের বেশি। অপরদিকে ষোলো কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ১০ হাজার মেগা ওয়াটের (১০ গিগা ওয়াট) কিছু বেশি! নাগকিরদের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া ক্ষেত্রে তাইওয়ান পৃথিবীতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

তাইওয়ানও বাংলাদেশের মত একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আয়তন এবং জনসংখ্যা তুলনা করলে তাইওয়ানের সাথে বাংলাদেশের তুলনা হতে পারে। তাইওয়ানের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি। তাইচুং বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি মোটেই জনবসতিহীন কোথাও অবস্থিত নয়। মূলত তাইওয়ানে সেরকম জায়গা নেইও। যে লংজিংতে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অবস্থিত সেখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে ২০০০ জন, যা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশেপাশের বসতির সাথে তুলনীয়, যদিও রামপাল এলাকায় বসতির ঘনত্ব এর চেয়ে অনেক কম। তাইচুং (লংজিং এ অবস্থিত) বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চারপাশে মোট ১৫টি গ্রাম রয়েছ।

গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- তাইওয়ান সাবট্রপিক্যাল ফরেস্টের জন্য পৃথিবীতে বিখ্যাত। এবং এই বনাঞ্চল ছড়িয়ে রয়েছে পুরো তাইওয়ান জুড়ে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এই লংজিংয়েই রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত বাম্বু ফরেস্ট-বাইশিয়ানশান বাম্বু ফরেস্ট। পৃথিবী বিখ্যাত অর্গানিক চা-এর চাষও এই লংজিংয়েও হয়ে থাকে। এই লংজিং এ  রয়েছে ২৪ বর্গকিলোমিটারের একটি জাতীয় উদ্যান, যেটি তাইওয়ানের প্রথম পাঁচটি বনাঞ্চলের একটি। এছাড়া তাইচুংয়েই রয়েছে তাইওয়ানের সবচে' আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় উদ্যান-দাশুয়েনসান জাতীয় উদ্যান। এই উদ্যানটিকে পাখির রাজ্য বলা হয়ে থাকে। আসলে আলাদা করে বলার কিছু নেই, গোটা তাইওয়ানই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর।


[দাশুয়েনসান উদ্যানের এনডেমিক 'মিকাডো পিজান্ট'। এটি বিরল প্রজাতির বলে IUCN এর রেড লিস্টের অন্তর্ভুক্ত। তাইওয়ান ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না।]

তাইচুং সিটিকে আমরা বাগেরহাটের সাথে তুলনা করতে পারি। উল্লেখ্য, তাউচুংএর আয়তন ২২১৫ বর্গকিলোমিটার। বাগেরহাটের আয়তন ৩৯৫৯ বর্গকিলোমিটার। তবে এই তাইচুং-এর সাথে বাগেরহাটের মূল্য পার্থক্য হচ্ছে- তাইচুং পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম একটি শিল্পসমৃদ্ধ শহর, অন্যদিকে বাগেরহাটে কোনো শিল্প নেই। রামপালের তুলনা চলে লংজিং-এর সাথে। তবে আয়তনে লংজিং রামপালের চেয়ে অনেক ছোট। রামপালের আয়তন ৩৩৬ বর্গকিলোমিটার, লংজিংএর আয়তন মাত্র ৩৫ বর্গ কিলোমিটার।

[এটি নিউ তাইপের একটি চায়ের বাগান। পুরো তাইওয়ানজুড়ে এরকম অসংখ্য সুশোভন চায়ের বাগান রয়েছে। বিদুৎ কেন্দ্রের অদূরের গ্রামগুলোতেও এরকম চায়ের বাগান রয়েছে।]

নানান ধরনের অর্গানিক চা উৎপাদনে পৃথিবীতে তাইওয়ান অন্যতম। তাইজুংয় এবং মিলাউওয়াতে রয়েছে অনেক চা বাগান। সবচে' বেশি রয়েছে নিউ তাইপেতে। এবং এসব জায়গায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে।

বিগত কয়েক দশক ধরে তাইওয়ানের সমৃদ্ধিতে সর্বোচ্চ অবদান রেখেছে তাদের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। সমস্যা যা হচ্ছে তাও নিশ্চয়ই তাদের পরীক্ষিত, কারণ তাইওয়ানে প্রথম তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় ১৯৪৮ সালে। হিসিনতা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় ১৯৭৮ সালে, যেটি এখন প্রায় ৪৫০০০ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। লক্ষ্যণীয়, কয়লা আমদানী করতে হয়, তাই প্রত্যেকটি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সমুদ্র ঘেষে অবস্থিত।

তাইচুং পাওয়ার প্লান্ট

মালিয়াও পাওয়ার প্লান্ট

হিসিনতা পাওয়া প্লান্ট

লিকু পাওয়ার প্লান্ট

হোপ পাওয়ার প্লান্ট

যেহেতু ২০১৬ তে এসে তাদের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে, তাই বলা যায় দূষণের বিষয়টি মাথায় রাখলেও তাইওয়ান জানে বিদ্যুৎ-ই আধুনিক সভ্যতা এবং উন্নতির মূল চাবিকাঠি।

লংজিং-এর একিটি স্টেশন। অদূরেই তাইচুং পাওয়ার প্লান্ট।

লিকু তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অদূরে অবস্থিত নিউ তাইপের বিখ্যাত কিচেন পার্ক

নিউ তাইপের বিখ্যাত রিভার সাইড পার্ক

এরকম অসংখ্য পার্ক, উদ্যান, জাতীয় উদ্যান ছড়িয়ে রয়েছে তাইওয়ানজুড়ে। তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তাইওয়ানে লোকালয় বিচ্ছিন্ন নয়, বনভূমি এবং জাতীয় উদ্যান থেকে দূরে নয়, সেই সুযোগও তাদের নেই। শহুরে দেশ তাইওয়ানে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে আছে এবং তারা তা আরো সম্প্রতারিত করছে ।

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।