তাহলে ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যও কি ঢেকে রাখতে হবে?

দিব্যেন্দু দ্বীপ
Published : 18 April 2017, 08:16 AM
Updated : 18 April 2017, 08:16 AM

পত্রিকার খবর অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত ন্যায় বিচারের প্রতীক জাস্টিসিয়া মূর্তিটির ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এখন থেকে নামাজের সময় মূর্তি, প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্যটি ঢেকে রাখা হবে বলা হচ্ছে।

সিদ্ধান্তটি কতটা হাস্যকর হয়েছে তা কৌশলগত কারণে বলা মুশকিল তবে এটি ভেঙে ফেলতে হলে সেটি যে কত বড় অবিচার হত তা ভেবেও শঙ্কিত হচ্ছি। আশঙ্কাটি আসলে একই থাকছে, শুধু নতুন মাত্রা পেয়েছে নামাজের সময় ভাস্কর্যটি ঢেকে রাখার সিদ্ধান্তে।

প্রশ্ন হচ্ছে নামাজের সময় ভাস্কর্য ঢেকে রাখতে হবে কেন? ভাস্কর্যটি বেশি খোলামেলা বলে নাকি যে কোনো ভাস্কর্যই নামাজের সময় ঢেকে রাখা উচিৎ বলে? যদি প্রথমটি এক্ষেত্রে কারণ হয়, তাহলে এর চেয়ে উন্মুক্ত ভাস্কর্যও দেশে রয়েছে। সেগুলোও কি ঢেকে রাখতে হবে? আর ভাস্কর্য প্রধানত উন্মুক্তই হয়। জাস্টিসিয়া ভাস্কর্যটি সেক্ষেত্রে অনেক বেশি আব্রু পেয়েছে বলা যায়। জাস্টিসিয়া ঢাকা হলে একই কারণে অপরাজেয় বাংলা কেন ঢাকা হবে না?

আর নামাযের সময় ভাস্কর্য ঢেকে রাখাটাই যদি রীতি হতে হয় তাহলে তো কোনো ভাস্কর্য বানানোর কোনো মানে থাকে না। যা ঢেকে রাখতে হবে তা বানাতে হবে কেন? ভাস্কর্য তো আর খেয়ে পরে বাঁচার জন্য অপরিহার্য নয়। ভাস্কর্য নন্দনতাত্ত্বিক এবং ভাববাচক গুরুত্ব বহন করে শুধু, ঢেকে রাখতে হলে সে গুরুত্ব শুধু ভূলুণ্ঠিতই হয় না বরং তাতে সাধারণ জনসাধারণের মনে ভাস্কর্য সম্পর্কে এমনই নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় যে তা সাম্প্রদায়িক দিকে মোড় নেওয়ারও যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে।

দেশে এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উন্মুক্ত মন্দির রয়েছে, যিশুর ভাস্কর্য বা মূর্তি রয়েছে, বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে। নামাজের জন্য এরপর সেগুলো ঢেকে রাখার দাবি উঠলে কী বলবে সরকার?

সু্প্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে জাস্টিসিয়া মূর্তিটি।

দৃশ্যমানতাই যদি একমাত্র বিবেচনার বিষয় হয় তাহলে 'স্বাধীনতা সংগ্রাম' নামক এ ভাস্কর্যটিতে বলতে হবে নারীর ঘাড়ে পুরুষ উঠেছে। এটিকে ঢাকা লাগবে না?

পাহাড়পুরে কিছু টেরাকোটার কাজ রয়েছে সেগুলো দৃশ্যত এবং তাৎপর্যের দিক থেকে অনেক বেশি উন্মুক্ত। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে ভাস্কর্য ঢাকার বাস্তবতা তৈরি করলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এরকম দাবি উঠতে পারে।

তবে মুসলিম বিশ্বেও নারীর মূর্তি বা ভাস্কর্য আছে এবং নামাযের সময় তা ঢাকা হয় না বলেই জেনেছি।

আফ্রিকার পুনর্জাগরণের প্রতীক হিসেবে সেনেগালে রয়েছে এই ভাস্কর্যটি (রেঁনেসা মনুমেন্ট)। প্রতিমূর্তিটি সেনেগালের বিখ্যাত জমজ পাহার কলিন্স দাস ম্যামিলিসের উপর স্থাপিত। সেনেগালে শতকরা ৯৪ ভাগ মুসলমান। ধর্মীয় দিক থেকে সেনেগাল অত্যন্ত রক্ষণশীল একটি দেশ। তাই বলে কখনো এ ভাস্কর্যটি সরানোর কথা ওঠেনি, যদিও তামার এ ভাস্কর্যটিতে নারীদেহের প্রায় সবটুকুই উন্মুক্ত। এবং এটি আফ্রিকার সবচে উঁচু ভাস্কর্য।

ভাস্কর্য সরানো বা ঢেকে দেওয়ার প্রসঙ্গটির সাথে সাথে একটি বিষয় আপনা থেকেই উত্থাপিত হয়- সমস্যা কি তাহলে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে? যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দেশ ভারতে গরু জবাই করা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বলে বাংলাদেশের হিন্দুদের এটা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, আবার এটাও সত্য যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা চাইলে প্রকাশ্যে শুকর জবাই করতে পারবে না।

কিন্তু ভাস্কর্য তো কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিষয় নয়। আরবের অনেক দেশে প্রচুর ভাস্কর্য ছিল, এখনো আছে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে, সেসব দেশে অনেক খোলামেলা ভাস্কর্যও রয়েছে। সেখানে কিন্তু মুসলিমরা ভাস্কর্য সরানো বা ঢেকে দেওয়ার কথা বলছে না।

অর্থাৎ ধর্মের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ক্ষমতার দম্ভই মূল কথা কিনা সেটি এখন অনেক বড় পশ্ন হয়ে সারা পৃথিবীতে দেখা দিচ্ছে। কারণ, ভাস্কর্য যদি এতটাই ধর্ম অবমাননাকর বিষয় হবে তাহলে ধরে নিতে হবে ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাস করছেন যেসব মুসলিম তারা কেউই ধার্মিক নন।

পৃথিবীতে অনেক ভাস্কর্য  রয়েছে যেগুলো বিভিন্নভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত। জর্জিয়ার "মুভিং স্টাচু অব এ ম্যান এন্ড ওম্যান" এদিক থেকে অগ্রগণ্য, যেটি প্রতিদিন একে অপরে বিলীন হয় অবলিলায়।  মুসলিম যুবকের সাথে অন্য ধর্মের যুব রাণীর প্রেমের বিষয়টিকে মহিমান্বিত করে জর্জিয়াতে স্থাপিত হয়েছে এ ভাস্কর্যটি। ভাস্কর্যটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একটি চলমান ভাস্কর্য।

https://youtu.be/3ds9fE0tnzE