এত সাপ মারা পড়াটা উদ্বেগজনক, কীট-ব্যাঙ-ইঁদুর বেড়ে যেতে পারে আশঙ্কাজনক হারে

দিব্যেন্দু দ্বীপ
Published : 18 July 2017, 08:49 PM
Updated : 18 July 2017, 08:49 PM

বর্তমান সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাপ মারা পড়ছে, বিশেষ করে বাসাবাড়িতে একসাথে অনেকগুলো সাপ পাওয়া যাচ্ছে এবং মেরে ফেলা ব্যতীত আর কোনো উপায় ঐ স্থানের অধিবাসীরা খুঁজে পাচ্ছে না। সাপ বিষয়ে বিশেষ কোনো জ্ঞান সাধারণ মানুষের না থাকায় তাৎক্ষণিক অন্য কোনো ব্যবস্থা তারা নিতে পারছে না।

এ ধরনের কয়েকটি খবর-

সাপ সম্পর্কে

সাপ মেরুদণ্ডী প্রাণী, এটি সরিসৃপ গোত্রীয়। বর্তমানে সাপের যত প্রজাতি সবই পা হীন। পা আছে এমন কোনো প্রাণী এখন আর সাপ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে পা হীন বেশীরভাগ সরিসৃপ সাপ হলেও কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন, গ্লাস লিজার্ড।

সাপের বিবর্তন নিয়ে মতভেদ থাকলেও এটাই স্বীকৃত যে গিরগিটি জাতীয় প্রাণী থেকে আজকের সাপ বিবর্তিত হয়েছে। সাপের যে এক সময় পা ছিল তা ফসিল বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন। সাপ কেন পা হারিয়েছে সে বিষয়ে অনেকগুলো তত্ত্ব থাকলেও এটিই প্রতিষ্ঠিত যে গর্তে বসবাসের প্রয়োজনীয়তা থেকে সাপ পা হারিয়েছে।

সাপ নানান ধরনের পোকা মাকড়, ব্যাঙ ও ইঁদুর খেয়ে বাঁচে। ছোট সাপগুলো সাধারণত পোকামাকড় খায়, বিশেষ করে মাকড়শা এবং বিটল জাতীয় পোকা এদের প্রিয় খাবার। অপেক্ষাকৃত একটু বড় সাপগুলো ব্যাঙ, পাখি, ইঁদুর এবং ইঁদুরজাতীয় প্রাণী খায়। আবার কিছু প্রাণী রয়েছে যেগুলো সাপ খায়, যেমন, শকুন, পেঁচা এবং বেজি গোত্রীয় কিছু প্রাণী।

কোনো কোনো সাপ রয়েছে যেগুলো সুযোগ পেলে এবং খাদ্যাভাবে পড়লে অন্য সাপ খায়। কিং স্নেক র‌্যাটল স্নেক খায়, কাল কেউটেরাও অন্যান্য ছোট সাপ ভক্ষণ করে। অতএব, দেখা যাচ্ছে, বাস্তুতন্ত্রে সাপের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সাপ না থাকলে পোকামাকড়, বিশেষ করে ইঁদুর ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। বিষহীন সাপও বেড়ে যাবে, কারণ, অনেক সাপের প্রধান খাদ্য সাপ।

সাপ কখনোই মানুষ শিকার করে না, এবং তারা মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে চায়। বিষহীন সাপের কামড় মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, কারণ, এমনকি তা বড় ধরনের কোনো ক্ষত তৈরি করতেও সমর্থ নয়, শুধু আকড়ে ধরতে পারে, আঁচড় কাটতে পারে।

একটি সাপ এবং কোনো সাপের কামড় বিষাক্ত কিনা সেটি বোঝা খুব জরুরী। কীভাবে বুঝবেন সাপটি বিষাক্ত কিনা? আসলে অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকা হলে কাজটি অনেক কঠিন হত, কারণ, সেখানে অনেক প্রজাতির বিষাক্ত সাপ রয়েছে। আমাদের দেশে যেহেতু বিষাক্ত প্রজাতির সাপের সংখ্যা খুব বেশি নয়, তাই এগুলো চেনাও সহজ। আমাদের দেশে সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে সাত প্রজাতির বিষাক্ত সাপ পাওয়া যায়।

বিষাক্ত সাপ চেনার উপায়

গ্রামে একটি ভুল তথ্য অনেক সময় প্রচারিত হয় যে সাপের মাথা তিনকোণা হলে সেটি বিষাক্ত, কিন্তু অধিকাংশ সাপের মাথাই তিনকোণা, তাই এটি বিষাক্ত সাপ চেনার কোনো উপায় নয়। তবে বিষাক্ত সাপের মাথা একটু বিশেষভাবে তিনকোণা।

প্রথমেই মোটা দাগে বুঝতে হবে- বিষধর সাপগুলো অপেক্ষাকৃত বড় এবং মোটা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ধোড়া সাপও (বোয়া কনস্ট্রিকটর) অনেক মোটা এবং বড়, সেটি বিষাক্ত নয়। তাই এটি বিষাক্ত সাপ চেনার খুবই স্থুল একটি প্রাথমিক উপায়।

আসলেই সাপটি বিষাক্ত কিনা এটা বুঝতে হলে একটু কাছ থেকে দেখতে হবে। যেমন, অবিষাক্ত সাপের নাসারন্ধ্রের দিকটা ভোতা থাকে। বিষাক্ত সাপের ক্ষেত্রে এটি অপেক্ষাকৃত সুচালো থাকে। বিষহীন সাপের চোখের তারা গোলাকার, বিষাক্ত সাপের ক্ষেত্রে এটি হয় উপবৃত্তাকার।

লেজ দেখেও চেনা যায়। লেজের অাইশের (স্কেল) সজ্জায় বিশেষ তফাৎ রয়েছে। বিষহীন সাপের লেজের নকশা খোপ খোপ হয়। বিষাক্ত সাপের লেজ আড়াআড়ি দাগবিশিষ্ট হয়।

দাঁত দেখে বিষাক্ত সাপ চেনা যায় স্পষ্টভাবে। বিষাক্ত সাপের দুটি লম্বা দাঁত থাকে। বিষহীন সাপের এরকম আলাদা পয়েন্টেড দুটি দাঁত থাকে না।

কামড় দেখে বুঝতে হবে যে এটি বিষাক্ত সাপে কামড়েছে নাকি বিষহীন সাপে কামড়েছে। তারপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। কামড় দেখে সণাক্ত করতে ক্ষতস্থান রক্তাক্ত হলে আগে পরিষ্কার করে নিতে হবে।

বিষাক্ত সাপের কামড়ে দুটি দাঁত বসে গিয়ে ক্ষত তৈরি হয়। বিষহীন সাপের কামড়ে অনেকগুলো দাঁতের আচড় পড়তে পারে। বিষাক্ত সাপের কামড়ে ক্ষতস্থান জ্বালাপোড়া করে।

আমাদের দেশে যে সকল বিষাক্ত সাপ দেখা যায়

পৃথিবীর সবচে বড় বিষাক্ত সাপ হচ্ছে কিং কোবরা। এটি সুন্দবনের গভীর জঙ্গলে পাওয়া যায়। বাংলায় এটি শঙচূড় নামে পরিচিত। নাম 'রাজ গোখরা' হলেও এটি আসলে গোখরা সাপ নয়। এটি আলাদা গোত্রের একটি সাপ। গোখরা সাপগুলো নাজা (naja) গণের অন্তর্ভুক্ত হলেও রাজ গোখরা অফিওফেগাস গণের। গোখরা সাপ থেকে এটি সহজেই আলাদা করা যায় ফণার পিছন দেখে, কারণ, গোখরা সাপের ফণার পিছনে চশমার মত বা গোরুর খুর আকৃতির নকশা থাকে। রাজ গোখরার প্রধান খাদ্য অন্যান্য সাপ।

গোখরা বা কোবরা কিং কোবরার চেয়ে ছোট, এটি ফণার ‍ওপর একটি গোলাকার নকশা থাকে। গোখরার ইংরেজি নাম 'ইন্ডিয়ান কোবরা' এবং 'স্পেক্টাকল্ড কোবরা'। বাংলায় এটিকে খড়মপায়া গোখরা সাপও বলা হয়। গোখরা (Naja) গণে অনেকগুলো প্রজাতি রয়েছে।

ভাইপারিডি পরিবারের সাপের মধ্যে আমাদের দেশে সবচে বেশি দেখা যায় রাসেল ভাইপার বা বাংলায় চন্দ্রবোড়া সাপ, এটি উলু বোড়া নামেও পরিচিত। বেশ মোটা হয় এ সাপটি। চন্দ্রবোড়া নিচু ঘাসযুক্ত স্থানে বসবাস করে। আমাদের দেশে রাজশাহী অঞ্চলে এ সাপ বেশি দেখা যায়। এছাড়াও কয়েক ধরনের ভাইপার স্নেক আমাদের দেশে রয়েছে, যেগুলো বিষাক্ত। যেমন, সেক্লড ভাইপার বা দাড়াশ সাপ এবং পিট ভাইপার। পিট ভাইপারের আবার অনেকগুলো প্রজাতি রয়েছে। পিট ভাইপারের চোখ এবং নাকের মাঝখানে পিট থাকে যেটি মূলত এক ধরনের হিট সেন্সর, এটির সাহায্যে তারা অন্ধকারেও শিকার ধরতে পারে।

কাল কেউটে সাপ শঙ্কিনী (কমন ক্রেট) নামে পরিচিত। সার দেশেই এই সাপটি কমবেশি দেখা যায়। বাংলাদেশে কেউটে সাপের একাধিক প্রজাতি রয়েছে। এরা সাধারণত জলাধারের অাশেপাশে বাস করে।

ঐতিহ্যগতভাবেই গ্রামের অনেক মানুষ এ সাপগুলোকে বিষাক্ত সাপ হিসেবে চেনে। তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে সাপটি দেখতে পেলে তারা সণাক্ত করতে পারে এটি বিষাক্ত সাপ কিনা।

সাপে কামড়ালে করণীয়

বিষধর সাপে কামড়ালেই মানুষ নিশ্চিত মারা যাবে, এমনটি নয়। বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আক্রান্ত ব্যক্তি বেঁচে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। বিষাক্ত সাপে কামড়ালো, কিন্তু যথেষ্ট বিষ প্রয়োগ করল না, তাহলে মারা যাবে না। সাপে কামড়ালে দেরি না করে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের দেশের বাস্তবতায় মোবাইলে খোঁজ নিতে হবে কোথায় এন্টিভেনম আছে।

হাসপাতালে নেয়ার আগে প্রাথমিক চিকিৎসা করতে হবে। ক্ষতস্থানের উপরিভাগ বেঁধে দিতে হবে, যাতে বিষযুক্ত রক্ত খুব ছড়িয়ে পড়তে না পারে। কাপড় দিয়ে বাঁধতে হবে। খুব টাইট করে বাধা যাবে না। রোগীকে সাহস দিতে হবে, ভয় পেলে অস্থিরতা বাড়ে, ফলে দেহে রক্ত চলাচল বেড়ে যায় বলে বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। বরফ দেয়া যাবে না। পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গান্টে বা স্যালাইন ওয়াটার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে, অথবা কিছু না থাকলে সাবান পানি দিয়ে ধুতে হবে। রোগীকে এমনভাবে শোয়াতে হবে যাতে আক্রান্ত স্থান যথাসম্ভব হৃদপিণ্ডের নিচে থাকে।

সাপ ধরে এনে রোগীর বিষ শুষে নেওয়ানোর কোনো সুযোগ নেই, এই রূপকথা বিশ্বাস না করে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। বিষাক্ত সাপে কামড়ালে ওঝারও কিছু করার নেই। তাই ওঝা ডেকে লাভ নেই, শিক্ষিত-সচেতন ব্যক্তিই বরং এক্ষেত্রে বেশি কাজে আসবে। তবে মোবাইলে কোনো ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া ভালো।

সাপের উপদ্রব থেকে বাঁচার উপায়

বর্ষাকালে বাড়িতে সাপের উপদ্রব বাড়ে, কারণ, সাপের গর্তে পানি ঢুকলে সেগুলো বেরিয়ে এসে বৃষ্টির পানি জমে না এমন জায়গায় বাসা করতে বাধ্য হয়। সাপ ধাওয়া করে কামড়ায় না, পাশ থেকে হেঁটে গেলেও কামড়ায় না, ওরা মানুষকে কামড়ায় নিজে আক্রান্ত হচ্ছে ভেবে। সাপের গায়ে পাড়া লাগলে এ সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই অন্ধকারে চলাচল না করে আলো নিয়ে চলাচল করতে হবে। বাড়ির একটু দূরে কিছু ঝোপজঙ্গল থাকা ভালো, সেখানে সাপ বাসা করে থাকতে পারে। বাড়ির জ্বালানী কাঠের ঘরে সাপ থাকার সম্ভবনা বেশি, এজন্য কাঠ রাখা এবং বের করার সময় সতর্ক হতে হবে।

এছাড়া সাপের উপদ্রব থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য কার্বোলিক এসিড ব্যবহার করা যায়। কার্বোলিক এসিডের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ সাপ সহ্য করতে পারে না, ফলে ওরা পালিয়ে যায়। যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হবে সাপ যাতে না মেরে পারা যায়, কারণ, সাপ একটি উপকারী প্রাণী।

সাপ সম্পর্কে সামাজিক জ্ঞান বাড়ানো

যদ্দুর মনে পড়ে ২০১৩ অথবা ২০১৪ সালে শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাপের ওপর একটি আলোকচিত্র প্রদর্শণী অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এরকম কর্মসূচী স্কুল কলেজে বেশি বেশি হওয়া দরকার।

প্রকৃতপক্ষে সাপের ওপর তেমন কোনো সামাজিক প্রচার আমাদের চারপাশে নেই, ফলে সাপ বিষয়ে বিভিন্ন মিথ রয়েছে মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে সাপ সম্পর্কে জ্ঞান বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেরকম কোনো প্রচারণা নেই। সাপে কামড়ালে কী করতে হবে–সেটি মানুষে জানে না। বিষাক্ত সাপ এবং অবিষাক্ত সাপের সহজ পার্থক্য না জানাতে অনেক সময় সামান্য ক্ষতস্থান ওঝা ডেকে বা নিজেরা ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপজেলা হাতপাতালগুলোতে এন্টিভেনম নেই।

সাপ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগে প্রচারণা বাড়াতে হবে, পাশাপাশি গণমাধ্যম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। এন্টিভেনম থাকা দরকার গ্রামের হাসপাতালগুলোতে, কারণ, সাপের ‍উপদ্রব প্রধানত গ্রামে দেখা যায়।

https://youtu.be/KVeApcI9THc

# ব্যবহৃত ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে নেয়া। site to know more

লেখক: ব্লগার। প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।