পুত্রের কয়েকটি পত্র ও পরিবারে পিতার প্রত্যাবর্তন

উৎপল চক্রবর্তী
Published : 17 March 2017, 08:05 PM
Updated : 17 March 2017, 08:05 PM

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ০২ এপ্রিল তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ১১ আগস্ট মিয়াওয়ালি জেলে সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হয়।

এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪ জন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে মুজিবকে বাঁচান' জরুরি বার্তা পাঠান। ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার বাহাত্তরের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু বিমানযোগে পাকিস্তান থেকে লন্ডনে এসে ক্ল্যারিজেস হোটেলে ওঠেন।

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

গতকাল বিকালে রমনার রেসকোর্স ময়দানেই নাকে খত দিয়েছেন নিয়াজি । পাকিস্তানীদের সেই ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান কভার করতে কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন সাংবাদিক চঞ্চল সরকার সহ আরও অনেকে। ১৭ ডিসেম্বর সকাল তখন দশটা ,তারা তখন শীতের সোনা রোদে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন ঢাকার রাস্তায় । ধানমণ্ডি ১৮ নম্বর বাড়িতে যাওয়ার  সিদ্ধান্ত হল, কিন্তু লোকেরা সেখানে যেতে বারণ করলেন তাদের। কালকেও নাকি সেখানে গুলি করে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের মেরেছে পাক সেনারা। চঞ্চল বেশ অবাক হলেন, ওরা কী সারেন্ডারের খবর রাখে নাই? নিয়াজির 'ফাইট টু দ্য লাস্ট' এখনও আঁকড়ে ধরে বসে আছে পাকসেনারা , বেকুব আর কাহারে কয় ! পাশেই ছিলেন গোর্খা রেজিম্যান্ট মেজর তারা। কজন জওয়ান আর মেজর তারা'কে সংগে করে সাংবাদিক দল রওনা হলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। সবাই বলছে , পাক সেনারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ছাদে বাঙ্কার বানিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। মেজর তারা পাকসেনাদের বোঝাতে গেলেন, পাক সেনারা তা বুঝতে নারাজ। অনেকক্ষণ বোঝানোর পর, অবশেষে তাদের নিরস্ত্র করা সম্ভব হল।

সোভিয়েত পি এম এলেক্সি কিসিগিন ০৯ মার্চ ১৯৭২।

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে

পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ফেলে তোলা হল বাংলাদেশের পতাকা। ফজিলেতুন্নেসা বেগম ঘর থেকে এসে বেরিয়ে এসে বাতিল চাঁদ মার্কা পতাকা আচ্ছা করে পায়ে মাড়ালেন। তাদের মায়ের পেছনে হাসিনা, রেহানা, রাসেল। ছোট মামা রাসেলের কোলে ভাগ্নে জয়। ওদের সঙ্গে ঘরে ঢুকলেন চঞ্চল , সঙ্গে ফটোগ্রাফার তারাপদ ব্যানার্জি। সারা বাড়িতে একখান চৌকি পর্যন্ত নেই, মেঝেতে বিছানা। ঝোলানো দড়িতে শাড়ি কাপড়, বসার কোন চেয়ারও নেই। চঞ্চল তারাপদ প্রণাম করলেন বেগম মুজিবকে, চোখে জল এসে গেল ।

বেগম মুজিব আস্তে আস্তে বললেন –

কোন খবর জানেন ওর? ন'মাস কিচ্ছু জানিনা। পাহারাদার সোলজারদের কাছে অপমান লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে কত! হাসিনার বাচ্চা হল, চিঠি লিখেছিল ওর বাবাকে। ওরা চিঠিটা পাঠায়নি । তবে একজন ভাল ব্যবহার করেছে, পাক আর্মির মেজর হোসেন । কথা বলতে বলতে তিনি 'মেজর তারা'কে একটি হাতঘড়ি উপহার দিলেন। চোখের জল মুছে বেগম মুজিব বললেন, হাসিনা হাসপাতালে, বাচ্চা হয়েছে, মাত্র চল্লিশ মিনিটের জন্য দেখতে যেতে দিয়েছিল, কোন খাবার পাঠাতেও দেয়নি । কোন রকম কিছুই দেয়নি, সংসার চালাবার কোন ব্যবস্থাই ছিল না । গত রাতে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আসতে চেষ্টা করেছিল । ছাদ থেকে গুলি করে ৬ জন কে শেষ করে দিল ওরা।

ট্রাফালগার স্কয়ার,  লন্ডন ০১ আগস্ট ১৯৭১।

জানুয়ারি ০৮ , ১৯৭২

রেডিও পাকিস্তানের খবর তিনিও শুনেছেন, রাত তিন'টায় তাঁর বিমান ছেড়েছে । ডেসটিনেশন আননোন , মুখ খোলেন নি বেগম ফজিলেতুন্নেসা । তবুও মুখে বারবার নানা বিষাদের ছায়া পড়েছে ।

অবশেষে জানা গেল মানুষটি জীবিত এবং লন্ডনে । লং ডিস্টেন্স কল বুক করা হল । শনিবার শীতের সন্ধ্যা ৫ টা বেজে ৫১ । লন্ডন ক্ল্যারিজেস হোটেল থেকে সারা লাইন ভর্তি হয়ে সেই গলা ভেসে এল

-তোমরা কেমন আছ?
কয়েক লহমা কিছুই বলতে পারলেন না ফজিলেতুন্নেসা ।
তারপর বেগম মুজিব বললেন – বেঁচে আছি , তুমি কেমন আছ? তাড়াতাড়ি চলে এস, দেরি করো না । সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে ।

বেগম মুজিব কেঁদে ফেললেন। বাড়ির সামনে হাজার হাজার মানুষ প্রবল উচ্ছ্বাসে কোলাকুলি করছেন।
তিনি বললেন – আমি ওর গলা শুনেছি।
হাসিনাকে তাঁর বাবা ফোনে বললেন
-তোমার ছেলের নাম কি রেখেছ?
-জয় 
প্রথম কথা হয় বড় ছেলে কামালের সঙ্গে
-তোরা বেঁচে আছিস তো?
-আমরা সবাই ভালো, তাড়াতাড়ি আসবেন।

বেগম মুজিব , শ্বশুর লুৎফর রহমান সাহেবকে খবর দিলেন। বৃদ্ধ মা বাবার চোখ দিয়ে তখন জল পড়ছে। লুৎফর রহমানের মাথায় টুপি, গায়ে ছাই রঙের পশমি শাল , হাতে তছবি । মা বয়সের ভারে অবনত চোখে চশমা , পরনে জরিপাড় শাদা রঙের শাড়ি । পত্রিকার সাংবাদিক চঞ্চল, লুৎফর রহমান সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, তিনি বললেন – আগে খোকাকে দেখি , এখন কিছু বলব না ওর সব কাজই আমার পছন্দ।

ত্রিপুরা'র  সাংবাদিক রবীন সেনগুপ্ত সেদিন বেগম মুজিবের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন , পড়ুন

জানুয়ারি ১০, ১৯৭২ , রেসকোর্স ময়দানে মুজিব বলছেন-

ত্রিশ লক্ষ লোককে মেরে ফেলা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এত লোক এত নাগরিক মৃত্যু বরন করেন নাই , শহীদ হন নাই। আজ থেকে আমার হুকুম –প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নয় , তোমরা আমার ভাই। আমাদের এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায় , মা বোন কাপড় না পায় –যুবক রা কাজ না পায় (উল্লাসে ফেটে পড়ল জনতা) । আপনারা আমাকে চেয়েছেন আমি এসেছি । আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল , কবর খোঁড়া হয়েছিল । জীবন দেবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আসার আগে ভুট্টো সাহেব আমাকে বলেছিলেন , দেখুন দুই অংশে কোন বাঁধন রাখা যদি সম্ভব হয়। আমি বললাম ভুট্টো সাহেব তোমরা সুখে থাকো বাঁধন টুটে গেছে।

পরিবারে পিতার প্রত্যাবর্তন

রেসকোর্স থেকে গাড়ি ধানমন্ডি ঢুকলো। গাড়ি ঢোকা মাত্র কামাল গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল । দুজনের চোখেই জল, হাঁটতে হাঁটতে শোবার ঘরের দিকে এগোলেন , প্রথমে বাবাকে পরে মা'কে জড়িয়ে ধরলেন মুজিব, সবার চোখে জল । এরপর তিনি বেগম ফজিলেতুন্নেসার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বেগম সঙ্গে সঙ্গে গভীর পরিতৃপ্তিতে স্বামীর বুকে মাথা রাখলেন, কেঁদে উঠলেন চিৎকার করে। কিছু যেন বলতে শুরু করে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। তারপর আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরে এল। তখন সারাদিন ক্লান্তির পর মুজিব কিছু খেতে চাইছেন।

সূত্রঃ
১। ১৯৭২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'বাংলা নামে দেশ'
২। 'বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র' , ডঃ সুনীল কান্তি দে ।
৩। 'বঙ্গবন্ধু'  চারুকলা প্রদর্শনী জানুয়ারি ২২ , ২০১৬  থেকে তোলা ।