আপনাদের কথা জানিনা, নিজের কথা বলতে পারি। অফিস থেকে ফেরার পথে, আমি এখন রিক্সায়, আচমকা আমার সামনে একটি ভয়াবহ এক্সিডেন্ট সংগঠিত হল এই মাত্র। একটি সিএনজি, তীব্র বেগে পেছন থেকে মেরে দিল রিক্সাটিকে তারপর সেটি দ্রুত টলতে টলতে পালিয়ে গেল মুহূর্তের ভেতর। রিক্সা উল্টে গিয়ে সামনের বাসে আঘাত খেয়ে, সিটে বসা মধ্য বয়স্ক লোকটি ছিটকে পড়লেন রাস্তায়, মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে ছুটলো রক্ত! এই লোকটিকে ইমিডিয়েটলি এখনই যদি হাসপাতালে না নেয়া হয়, তাহলে তাঁর নির্ঘাত ঘটে যাবে মৃত্যু! রিক্সায় ছিলাম এবং আমি ছিলাম সবচেয়ে কাছাকাছি, আমি নেমে পড়লাম – বাস্তবে সবাই দেখছেন -আমি লোকটির হাত টেনে ধরে উঠাতে চাইছিলাম, কিন্তু আমার অন্তরের ভেতরে, আমি চাইছিলাম -অন্য কেউ এগিয়ে আসুক, একটু আগেই মেয়েকে বলেছি 'আমি আসছি মা ,তুমি রেডি হয়ে থাকো'। এখন এই লোকটিকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া, বুঝতে পারছি সেটি অতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যেহেতু আমার সোনার টুকরো মেয়েটিকে কথা দিয়ে ফেলেছিলাম, তাছাড়া মেডিক্যালে নিয়ে গেলে ঝামেলাও একেবারে কম নয় , তাই আমার অতি দ্রুত বাড়ি ফিরে যাওয়াটাকেই আমি বেটার মনে করলাম।
তা আমি যা ভেবেছিলাম, প্রাণহীন বন্ধুহীন এই ঢাকা শহরে, ইট কাঠ পাথরে কোথাও নেই কোন হৃদয়, আর সবাই বোধ হয় আমারই মত মানব নামীয় কীট, ঘটনা কী তাই? হা হা হা! আমি শুধু অমানুষই নই, আমি একজন বেকুবও বটে! আমি কিংবা আমার মত মহামান্য'রা যখন টিভিতে ধ্বসে যাওয়া রানা প্লাজা দেখে দেখে, ওহ্ আহা ওহ্ আহা, তখন আমার দোকানের ছেলেটি কী ছুটিতে? আমার বাড়ির চাপরাসি, দারোয়ান, সকাল বিকাল চুরি করে আমার গাড়ির সেই ড্রাইভার, সে কোথায়? আজ ক'দিন আমি তাঁরে যে দেখি না! রানা প্লাজায় মানুষকে উদ্ধার করতে যেয়ে মানুষ, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যেয়ে মানুষ, সেখানে সে নাকি দিয়াছে প্রাণ! হায়রে আমি জানি নাই, আমি জানতেও পারি নাই! সেই হিসাবে আমি শুধু অমানুষই নই,আমি একজন বেকুবই বটে!
একজন খুব সাধারণ মানুষ, রাস্তার বিপরীত দিক থেকে দৌড়ে এগিয়ে এসে দ্রুত একটি রানিং সিএনজি থামিয়ে -আহত লোকটিকে তুলে নিলেন, যেমন করে ঈগল ছোঁ মেরে তুলে নেয় শিকার। চল্ চল্ চল্ বেটা ভাড়া নিয়া দামাদামি পরে কর, ঢাকা মেডিক্যাল কুইক কুইক! রাজপথে রক্ত আর মানুষের জটলা আটকে থাকলো, আচমকা আহত মানুষটিকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে, হাওয়া গেলেন সেই লোকটি! তিনি কোথা থেকে নেমে এলেন হে! তবে কী তিনিই ঈশ্বর! আমি হেরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, যদিও ভূপেন হাজারিকার 'মানুষ মানুষের জন্য' আমার ছিল খুব প্রিয় গান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলটির অবস্থান ঢাকা মেডিক্যালের খুব কাছাকাছি, তাই সংগত কারণেই রোগীর জীবন বাঁচাতে যখন জরুরী রক্তের প্রয়োজন পড়ত, তখন অসহায় মানুষ দৌড়ে চলে আসতেন শহীদুল্লাহ হলে। রোগীর আত্মীয় স্বজন, হলের সামনে ঘোরাঘুরি করে জানাতেন তাদের আকুল মিনতি। হল গেটে, প্রায় রোজ রোজ চলতে থাকা এই জাতীয় ঘ্যানর ঘ্যানর অধিকাংশ ছাত্ররাই তেমন শুনতেন না। তবে কিছু ছাত্র শুনতেন, কিন্তু তারা আবার রাজনীতি পড়াশুনা প্রেম কিংবা আড্ডাবাজি বাদ দিয়ে, এসবে সময় নষ্ট করতে চাইতেন না। কিন্তু দুই একজন ঠিক ঠিক পরম মমতায় আগ বাড়িয়ে এসে জানতে চাইতেন, রোগীর কন্ডিশন, রক্তের গ্রুপ রোগীর যাবতীয় ইতিবৃত্তান্ত। যদি রক্তের গ্রুপ মিলে যেত, তাহলে হলের ভেতরে যেয়ে, রুম থেকে ধরে নিয়ে টেনে বের করতেন – ভাই , আমার ভাই পরীক্ষা আছে কালকে, ভাই আমি গত মাসে একবার দিয়েছি, ভাই আমার পেট খারাপ, ভাই আমার দাওয়াত আছে। কিন্তু সেসব অজুহাতে কোন কাজ হত না, ইমার্জেন্সী বুঝে একটাকে কট করে নিয়ে, চলে আসতেন মেডিক্যাল। আর যদি নিতান্তই রক্তের গ্রুপ জানা না থাকতো, তাহলে সেই দুই একজনের ভেতর থেকে কোন একজন এসে নোটিশ সেঁটে দিতেন দেয়ালে "একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজন, রক্তের গ্রুপ B- , যোগাযোগঃ শাহিদুল ইসলাম রিপন, রুম নম্বর ৩০৭"। সেই সব অসহায় সাধারণ মানুষ! কেউ কেউ এমনও আছেন, জীবনে প্রথম এসেছেন রাজধানী ঢাকা। কিন্তু তারা খবর জানতেন, জরুরী প্রয়োজনে মেডিক্যাল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো'তে গেলে রক্ত পাওয়া যেতে পারে, যা না থাকলে বাঁচে না জীবন।
ভারতে টাটা গ্রুপের প্রায় প্রতিটি ফ্যাক্টরি'তে রক্তদান'কে উৎসাহিত করার জন্য, একটি নিয়ম প্রচলিত ছিল এবং এখনও আছে। যদি তুমি রক্তদান করো তাহলে সেদিনের মতো তোমার অফিস ছুটি এবং সেই সপ্তাহে তুমি রেগুলার ছুটি ছাড়াও আরও একদিন অতিরিক্ত ছুটি ভোগ করতে পারবে। কারখানায় এই সুবিধাটির জন্য প্রায়শই দেখা যেত শ্রমিকরা কাজ কাম বাদ দিয়ে ব্যাপক আগ্রহ উদ্দীপনা নিয়ে রক্তদানে মনোনিবেশ করেছেন। তাতে টাটা কোম্পানির বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে , মনে করতেন টাটা কোম্পানির একজন সিনিয়র কর্মকর্তা। সেই সিনিয়র কর্মকর্তা রতন টাটা'র কাছে জানতে চাইলেন –
– স্যার আমরা হিসাব কষে দেখেছি, যেহেতু রক্ত দেয়ার পর একজন মানূষ সম্পূর্ণ সুস্থই থাকেন এবং যেহেতু রক্ত দেবার কারণে শ্রমিকের তেমন কোন শারীরিক ক্ষতিও সাধিত হয় না, তাই একদিন কাজে ফাঁকি এবং সপ্তাহে অতিরিক্ত একদিন ছুটি উপভোগ করবার উদ্দেশ্য, শ্রমিকদের এহেন কাজে ঘন ঘন লিপ্ত হবার কারণে কোম্পানির কোটি কোটি টাকা লস হয়ে যাচ্ছে, তাহলে কেনই বা বেহুদা এই মহামূল্যবান শ্রমের বাজারে হাজার হাজার শ্রমঘন্টা নষ্ট করছি আমরা?
রতন টাটা স্মিত হেসে জবাব দিয়েছিলেন-
কাউকে কাজে উৎসাহিত করা একদম অন্যরকম একটি ব্যাপার, এই বিষয়ে আপাতত তোমার কাছে নতুন করে কিছু শিখতে চাইছি না আমি। যারা রক্ত দান করেন, তাদের ছুটির প্রয়োজন আছে বলেই তারা সেটি করেন, আর ব্যাপারটি আইন বহির্ভূত কোন ঘটনা নয় । কিন্তু কথা হচ্ছে, শুধু মাত্র কয়েকটি মানুষের শ্রমঘন্টা যোগ দিলেই একটি মানুষের জীবন বাঁচানো যায়, অতি প্রয়োজনের সময় শুধুমাত্র শ্রমঘন্টার বিনিময়ে অর্জিত রক্তে সেই মানুষটি মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে উঠতে পারেন, এমনটিও সম্ভব, আমরা কী কখনও তা ভাবতে পেরেছিলাম?
প্রাণরসায়ন বিভাগের ছাত্র শাহিদুল ইসলাম রিপন তখন থার্ড ইয়ার ফাইনাল শেষে মাস্টার্সের ছাত্র, শহীদুল্লাহ হলে কারো রক্ত লাগলেই, প্রয়োজন পড়ে যার, মোটামুটি সবাই নাম জানে তার। তখনও বাংলাদেশে মোবাইল টাওয়ারগুলো একে একে জেগে উঠতে শুরু করেনি, শহরে দেখা গেছে কিছু বিত্তবান লোকেরা একটি যন্ত্র হাতে নিয়ে ঘুরছেন, চাইলেই যখন মন চায় সুইচ টিপে দিলেই, যেখানে সেখানে বলে দেয়া যায় হ্যালো। কদিন পরে নিশ্চয় একজন ছাত্রও কিনে ফেলতে পারবেন, দাম চলে আসবে হাতের নাগালে, কোম্পানির নাম গ্রামীণফোন, হল মাঠে, রুম, বারান্দায় এইসব কানাঘুষো বেশ চলছে। আর রিপন ভাবছিলেন, ডোনারদের একটি ডাটাবেজ থাকলে কাজটি খুব সহজ হয়, এভাবে খুঁজে খুঁজে ব্লাড ম্যানেজ করা বড্ডো হ্যাপা ! তাছাড়া হলে বসবাসরত ছাত্রদের খুব অল্প সংখ্যক, নিজেদের রক্তের গ্রুপ ঠিক ঠাক জানতেন। তাই একদিন রিপন ও তার বন্ধুরা ভাবলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পড়াশুনো করেও উদ্যোগ অভাবে নিজেদের রক্তের গ্রুপ না জানার ব্যাপারটি ঠিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যায় না। কী বলিস তোরা, তাই না?
সবাই একমত দিলেন – হ্যাঁ , যায় না! প্রতিটি ছাত্রের নিজের রক্তের গ্রুপ জানাটা অতি আবশ্যক এবং জানা থাকলে সে কাউকে রক্ত দেবে কী দেবে না -সে আলাপ পরে হোক! আর এরকম ভাবনা থেকেই, তখন বন্ধুরা মিলে সাংগঠনিক ভাবে একটা কিছু করবার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন । সেটি ছিল ১৯৯৭ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর, ঘটনাস্থল শহীদুল্লাহ হলের ৩০৭ নম্বর রুম, মিলিত হলেন তারা প্রায় ২৬জন, গঠন করা হল একটি আহ্বায়ক কমিটি টাইপ একটি কমিটি, উপস্থিত ছিলেন শাহিদুল ইসলাম রিপন , রকিব আহমেদ প্রমুখ।
তিনি ছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়ান, তাঁর বুকে অস্ত্রোপচার করা হলে তখন তাঁর জন্য রক্তের প্রয়োজন পড়ে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে দীর্ঘ চিকিৎসায়, তাঁর শরীর গ্রহণ করে ১৩ লিটার পরিমাণ রক্ত, তিন মাস পর সুস্থ হয়ে উঠেন জেমস খ্রিস্টোফার হেরিসন। তাঁর বয়েস তখন চৌদ্দ, এবং সুস্থ হয়েই তিনি এই রক্তের ঋণ পরিশোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। তাঁর বয়স আঠারো বছর হওয়ার পর পরই নিয়মিত ব্লাড ডোনার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। প্রথম কয়েকবার রক্ত দেয়ার পরেই আবিষ্কৃত হয় এক অদ্ভূত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ! জেমস তাঁর শরীরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন এমন এক রক্ত যা, সদ্যজাত শিশুর এক জটিল রোগ, চিকিৎসাবিজ্ঞানে যার নাম 'হিমোলাইটিক ডিজিজ অব নিউবর্ন' বা এইচডিএন-এর বিরুদ্ধে এন্টিবডি প্রস্তুত করতে সক্ষম। এবং জানা যায় , মা যখন সন্তান-সম্ভবা তখনই মায়ের রক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভবিষ্যতের শিশুটিকে এইচডিএন আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে জেমস খ্রিস্টোফার হেরিসনের রক্ত।
এক সময় প্রতি দুই সপ্তাহে একবার করে রক্ত দিয়ে গেছেন তিনি, এখন তার বয়েস ৮০ বছর । ২০১১ সালের মে মাসে তিনি সম্পন্ন করেন ১০০০ তম রক্তদান, গড়ে গত ৫৭ বছরে প্রতি তিন সপ্তাহে অন্তত একবার রক্ত দিয়েছেন তিনি। বলা হয়ে থাকে রক্ত দিয়ে তিনি বাঁচিয়েছেন প্রায় ২৫ লক্ষ শিশুর জীবন, তম্মধ্যে তাঁর নিজের কন্যা ট্রেসিও আছেন। তাঁকে ডাকা হয় 'ম্যান ওইথ দ্য গোল্ডেন ব্লাড'।
প্রতিবছর ৮ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান করা হয়, অথচ এর মাত্র ৩৮ শতাংশ সংগ্রহ হয় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে, যেখানে বাস করে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া এখনো বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের রক্তের চাহিদা হলে নির্ভর করতে হয় নিজের পরিবারের সদস্য বা নিজের বন্ধুদের রক্তদানের ওপর, আর অনেক দেশে পেশাদারি রক্তদাতা অর্থের বিনিময়ে রক্ত দান করে আসছে রোগীদের। অথচ বিশ্বের নানা দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জানা যায়, 'নিরাপদ রক্ত সরবরাহের' মূল ভিত্তি হলো স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে দান করা রক্ত। কারণ তাদের রক্ত তুলনামূলক-ভাবে নিরাপদ এবং এসব রক্তের মধ্য দিয়ে গ্রহীতার মধ্যে জীবন-সংশয়ী সংক্রমণ, যেমন এইচআইভি ও হেপাটাইটিস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে খুবই কম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে স্বেচ্ছা-রক্তদানের হার বিবেচনা করলে, বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে, এমনকি ভুটানের চেয়েও! আমাদের ১৮-৬০ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩% যদি শুধু তাদের জন্মদিনে রক্ত দেন, তাহলেই আমরা আমাদের প্রয়োজনের পুরোটাই মেটাতে পারি স্বেচ্ছা রক্ত দিয়ে।
শহীদুল্লাহ হলের গঠিত হওয়া সেই আহবায়ক কমিটি, হলের বিভিন্ন রুমে রুমে গিয়ে জানান দিলেন তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য । চলতে থাকলো ছাত্রদের রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণ এবং সচেতনতা সৃষ্টি । প্রাণরসায়নের ছাত্র হওয়ার কারণে ব্লাডগ্রুপিং করবার জন্য তাদের অন্য কারো উপর নির্ভরশীল হতে হল না। তারা হিসাব করে দেখলেন, আপাত দৃষ্টিতে ব্যাপক আকারে ব্লাডগ্রুপিং করবার কাজটি কষ্টসাধ্য হলেও তেমন ব্যয়বহুল নয়। বন্ধুরা মিলে শুরু করলেন চাঁদাবাজি , দুই টাকা থেকে শুরু করে বিশ পঞ্চাশ যার যেমন সামর্থ্যে কুলায় ! মাত্র এক মাসের মাথায় তার শহীদুল্লাহ হলে আয়োজন করলেন বিনামূল্যে ছাত্রদের রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের প্রোগ্রাম। এবং সেদিন প্রায় ১২০০ ছাত্রের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে ফেলতে সক্ষম হলেন তারা । আর এই ঘটনাটি তাদের কর্মস্পৃহা কে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল 'একের রক্ত অন্যের জীবন , রক্তই হোক আত্মার বাঁধন' এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে অফিসিয়ালি যাত্রা শুরু হল 'বাঁধন'-এর। দিনটি ছিল ১৯৯৭ সালের ২৪শে অক্টোবর । ''রকিব আহমেদ' ছিলেন ফজলুল হক হলের ছাত্র, তাই শহীদুল্লাহ হলের পরেই ফজলুল হক হলেও একই কর্মসূচী গ্রহণ করা হল। তারপর একে একে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলে কাজ শুরু করে দিল 'বাঁধন'। আর এভাবে ডানা মেলে উড়তে উড়তে , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে 'বাঁধন' চলে এলো বুয়েট-এর বিভিন্ন হলে।
শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি যখন পচে গলে ধ্বংস আর মানবের মানবিক মূল্যবোধ যখন ক্ষত বিক্ষত -তখন ভস্মীভূত ছাই আর ধ্বংসাবশেষ থেকে এক ফিনিক্স পাখির পুনরুত্থানের গল্পের নাম , 'বাঁধন'। আজ ২০১৭ সালে এসে , বাংলাদেশের তেত্রিশটি জেলার আটচল্লিশ'টি স্নাতকোত্তর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে 'বাঁধন' এখন এক গর্বের নাম।
ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে 'বাঁধন ফাউন্ডেশন' যা 'বাঁধন' এর ছাত্রত্ব শেষ করা কর্মীদের একটি প্ল্যাটফর্ম। শিক্ষাজীবন শেষ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এমনকি দেশের পরিমণ্ডল পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছেন, সেই সকল বাঁধনকর্মীদের একসূতোয় গেঁথে রাখবার প্রয়াস। আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের মাত্র দেড় বছরের মাথায় নিজস্ব একটি বিশ্বমানের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল 'বাঁধন'। সেটি বাস্তবায়নের প্রাথমিক ধাপে ২০০৬ সাল হতে পরীক্ষামূলকভাবে একটি সেন্টার চালু করা হয়। বাঁধনের অব্যাহত তৎপরতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় , বাঁধন ও বাঁধন ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে একটি বিশ্বমানের ব্লাড ট্রান্সফিউশন সেন্টার তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারের একতলা বিল্ডিং এর ছাদে জায়গা বরাদ্দের জন্য অনুমোদন পাওয়া যায়। স্পন্দন বি (নর্থ আমেরিকাতে অবস্থানরত বাংলাদেশী পেশাজীবীদের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন) এ সেন্টারের সকল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে সম্মত হয়। এই কাজে প্রয়োজন ছিল প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা, এবং এই অর্থের একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে সংগ্রহীত হয়েছে এবং খুশীর খবর – বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারের ছাদে শুরু হয়ে গেছে এর নির্মাণ কাজ।
সংগঠনের নাম : বাঁধন (স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন)।
প্রতিষ্ঠাকাল : ২৪ অক্টোবর, ১৯৯৭
রেজি নং : ঢ-০৬১৫২
মূলমন্ত্র : একের রক্ত অন্যের জীবন রক্তই হোক আত্মার বাঁধন।
বৈশিষ্ট্য : ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা পরিচালিত সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
ক্ষেত্র : বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ সমূহ
আর্থিক যোগান : বাঁধন কর্মীদের চাঁদা ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তা।
আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ১০/১২ লক্ষ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। আর এই প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহ হয় খুবই সামান্য। আর যতটুকু সরবরাহের ব্যবস্থা হয় তার ৬০ ভাগই পূরণ হয় পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে, পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে রক্ত গ্রহণ একদিকে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ অন্যদিকে তেমনি অস্বাস্থ্যকর। কারণ পেশাদার রক্তদাতারা গ্রহণ করে বিভিন্ন ড্রাগ এবং শরীরে বহন করে হেপাটাইটিস এ, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, এইডস, সিফিলিস এর মত জীবন ধ্বংসকারী বিভিন্ন রোগের জীবাণু।
১. বয়স ১৮ থেকে ৫৭ বছরের মধ্যে হতে হবে (নারী ও পুরুষ)।
২. ওজন ৪৮ কেজি (পুরুষ) ৪৫ কেজি (নারী)।
৩. সময় ১২০ দিন পর পর অর্থাৎ ৪ মাস পর পর।
৪. শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে।
রক্তদান করলে শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়া, শরীর মুটিয়ে যাওয়া, শরীর শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের ভুল ধারণা মানুষের মধ্যে কাজ করে, যার পুরোটাই আমাদের রক্তদান সম্পর্কে অসচেতনতা ও ভয় থেকে সৃষ্টি। রক্তদান করলে শারীরিকভাবে কোন সমস্যার সৃষ্টি বা অসুস্থ হওয়া এর কোনটাই হয় না। বরং রক্তদান করলে শারীরিকভাবে বিভিন্ন উপকার পাওয়া যায়, মানসিক তৃপ্তি পাওয়া যায় যা অন্য কোন ভাবে মানুষের উপকারের মাধ্যমে অর্জন সম্ভব নয়।
বাঁধন, মুমূর্ষু রোগীর জন্য সরবরাহ করছে বছরের প্রয়োজনীয় রক্তের চাহিদার সিংহভাগ । বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছে সকল ধরণের মানুষকে -তার নিজ রক্তের গ্রুপ। দীর্ঘ ১৯ বছরের এই স্বপ্নযাত্রায়, বাঁধন প্রায় দশ লক্ষের কাছাকাছি মানুষকে বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ জানিয়ে , তাদের রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং বিনামূল্যে সরবরাহ করেছে প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষ ব্যাগ রক্ত । কেন্দ্রীয় পরিষদের পরিকল্পনা রয়েছে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলায় বাঁধনের কার্যক্রম ছড়িয়ে দেয়ার ।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি কাজের পাশাপাশি বাঁধন একটি অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের মাধ্যমে Online এ রক্তের চাহিদা পূরণের প্রয়াস চালাচ্ছে। আপনার প্রয়োজনে , এখানে জানাতে পারেন আপনার প্রয়োজনীয় রক্তের গ্রুপ অথবা এগিয়ে আসতে পরেন একজন মুমূর্ষুর প্রয়োজনে একব্যাগ রক্তদানের মাধ্যমে।
আজকাল হাসপাতালে যখন কারো রক্তের প্রয়োজন হয় , তখন ডাক্তাররাই রোগীকে 'বাঁধন'-এর সাথে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন। ধরা যাক রোগী'র অবস্থান মহাখালীর আশপাশে , তখন তিতুমীর কলেজ শাখার বাঁধন-এর সাথে যোগাযোগ করলেই, তারা ডাটাবেস ঘেঁটে আপনাকে জানিয়ে দেবে, আপনার পরবর্তী করণীয়, হতে পারে রক্তদাতা নিজেই আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দেবেন, কখন কোথায় তিনি আসছেন।
'বাঁধন'-এর সাথে দেশের অন্য প্রতিষ্ঠান সমূহ যেমন সন্ধানী, রেডক্রিসেন্ট , কোয়ান্টাম-এর সাথে মূল পার্থক্য, 'বাঁধন' ব্লাড ব্যাংকে রক্ত সংরক্ষণের বিরুদ্ধে। 'বাঁধন' রোগীকে অনস্পট ফ্রেশ ব্লাড দেয়ায় বিশ্বাসী এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানও সেটি সমর্থন করে। প্রচলিত অভিজ্ঞতা বলছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঢাক ঢোল পিটিয়ে নানা আয়োজনে উপস্থিত দর্শনার্থী বা আমজনতার কাছ থেকে যে রক্ত সংগ্রহ করা হয়ে থাকে, সঠিক সংরক্ষণ অভাবে এর একটি বড় অংশ একসময় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে , তখন সেই রক্ত ড্রেনে ফেলে দেয়া ছাড়া কিছুই করার থাকেনা। তাছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দিবস বা গুরুত্বপূর্ণ কোন অনুষ্ঠান বা উদযাপনে ব্যানার টাঙ্গিয়ে হই হই রই রই উৎসব, এসব লোক দেখানো ইভেন্ট-এ বাঁধন' এর অংশগ্রহনে আছে তীব্র আপত্তি । স্বেচ্ছা রক্তদান কর্মসূচী আওয়াজ দিয়ে পালন করবার কোন উৎসব নয়। কোন রথী মহারথী, বিশেষায়িত কোন ডাক্তার, মহামান্য সেলিব্রেটি কিংবা মহান কোন নেতা, সুবিশাল শিক্ষানুরাগী, টিভি সংবাদপত্রের মালিক, ঋণ খেলাপি মহাজন কিংবা ভুয়া মানব দরদী কেউ, আজ পর্যন্ত এমন কারো কাছেই ধর্ণা দেয়নি বাঁধন।
একদিন যেসব হাত ধরে শুরু হয়েছিল যাত্রা, অর্থের অভাব আর উপচে পড়া ভালোবাসায় আজ থেকে উনিশ-বছর আগে, অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সেই সংগঠন'টি এখন অবধি সেই সব হাত ধরেই চলছে , কিন্তু আগের চাইতে এখন 'বাঁধন' অনেক বেশী শক্তিশালী এবং অনেক বেশী সংঘবদ্ধ।
বাঁধন-এর প্রধান উদ্যোক্তাদের কয়েকজনকে খুব কাছ থেকে আমি জানি, তারা হাইব্রীড নেতাদের মত চকচকে স্যু আর সফেদ পাঞ্জাবীতে গাড়ি থেকে নামেন, আর সাথে সাথে মূহূর্মুহ শ্লোগান আর হাততালিতে অন্ধকারে জ্বলে উঠে সবুজ বাতি, না ব্যাপার সেরকম কিছু নয় ! তারা চলেন নীরবে, যেভাবে বাঁধন এক নীরব বিপ্লবের নাম, সময় সময় অফিস কিংবা কাজ সেরে সন্ধ্যায় কিংবা বন্ধের দিনগুলোয় টিএসসি বাঁধনের অফিসের আশপাশে তারা ঘুরে বেড়ান, আমি তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভেবেছিলাম ভুল করে ।
সূত্রঃ উইকিপিডিয়া