দেশের সব খেটে খাওয়া মানুষেরাই কি দালাল?

রাগ ইমন
Published : 29 May 2011, 02:36 PM
Updated : 29 May 2011, 02:36 PM

আজকে প্রথম আলো পত্রিকার একটা খবরে চোখ আটকে গেলো [খবর সূত্র: দালালদের নিয়ন্ত্রণে জনশক্তি রপ্তানি, শরিফুল হাসান, তারিখ: ২৯-০৫-২০১১, দৈনিক প্রথম আলো]। বাংলাদেশের শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে প্রায়ই খবর আসে।

দেশের ভিতরে যার মাধ্যমে টাকা দিয়ে ঢাকার রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে পৌঁছায়, রিক্রুটিং এজেন্সি, বাংলাদেশের দূতাবাস এবং সংশ্লিষ্ট দেশের কোম্পানিসহ প্রশাসন – কারো কাছেই এই গরীব মানুষ গুলো কোন সাহায্য পায় না। বরং পদে পদে হয়রানির শেষ নাই। বছর শেষে গাল ভরা " রেমিটেন্স" স্ট্যাটিস্টিকস ছাড়া এই রক্ত মাংসের মানুষ গুলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের "আধুনিক দাস" , শোষিত , অবহেলিত।

উল্লেখিত খবরেও এর ব্যতিক্রমী কোন নতুন তথ্য নেই। তবে তথ্য আছে কিছু "দালালের সম্পর্কে" । এরা হলো মধ্যস্বত্বভোগী । সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে -ঢাকার রিক্রুটিং এজেন্সির হয়ে এরা – বিদেশে যেতে ইচ্ছুক – শ্রমিক সংগ্রহ করে।

উল্লেখিত খবরে পাওয়া কিছু তথ্যঃ

১। ঢাকার বাইরে কারও অফিস নেই: বায়রার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন এক হাজার রিক্রুটিং এজেন্সি আছে। কিন্তু এদের সবার অফিসই ঢাকায়। সরকারিভাবে ঢাকার বাইরে তাদের অফিস নেওয়ার জন্য বলা হলেও কেউ-ই ঢাকার বাইরে অফিস নেয়নি।

এর কারণ সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা যায়নি। একজন মন্তব্যকারী আকরাম তানিম বলেছেন,

সরকারিভাবে ঢাকার বাইরে তাদের অফিস নেওয়ার জন্য বলা হলেও কেউ-ই ঢাকার বাইরে অফিস নেয়নি। " কিভাবে নেবে ? আমার জানা অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এলাকার মাস্তানরা চাঁদা চাইবে, অফিস ভাংচুর করবে, প্রশাসনও ঝামেলা করবে। কি দরকার?

তারমানে, ঢাকার বাইরে ব্যবসা করার মত যথেষ্ট নিরাপত্তা সরকার দিতে পারছে না। আবার কারণটা এইটাও হতে পারে- ঢাকায় বসেই যদি ব্যবসা করা যায়, ঢাকার বাইরে তারা যাবে কেন? অর্থাৎ এইখানেও সরকারের নিয়ন্ত্রনের অভাব। মনিটরিং এর অভাব।

২। দালালদের সহায়তায় বিদেশে যেতে পারলেও সরকার-নির্ধারিত খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়। মালয়েশিয়া যেতে সরকারি খরচ ৮৪ হাজার টাকা, অথচ দিতে হয় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা।

এইখানেও সরকারের মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রনের অভাব।

৩। অথচ গ্রামগঞ্জ ও শহরে ছড়িয়ে আছে ৫০ হাজার থেকে লাখ খানেক দালাল। —-লক্ষ্য করুণ, এই এজেন্টদের সঠিক সংখ্যা কারো জানা নেই। এইখানেও সরকারের তথ্য সংগ্রহ , সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রনের অভাব।

৪। 'বিদেশগামী এবং রিক্রুটিং এজেন্সি দুই পক্ষই এখন দালালদের ওপর নির্ভরশীল। একজন কর্মী বিদেশে যেতে চাইলে কোথায় যাবেন, কী করবেন—সে ব্যাপারে যথেষ্ট সরকারি তথ্য নেই। এই সুযোগ নেয় দালালেরা। আবার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর তৃণমূলে কোনো কার্যক্রম নেই। তাদের সবার অফিস ঢাকায়। ফলে তাদেরও বিদেশে পাঠানোর জন্য লোক আনতে এই দালালদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এভাবেই দালালপ্রথা টিকে আছে বছরের পর বছর। — এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতাই কি দুর্নীতির কারণ নাকি এই চক্র এর উপর কোন নিয়ন্ত্রন না থাকাটা আসল সমস্যা?

৫। প্রমাণ ছাড়াই অর্থ লেনদেনের ফলে প্রতারণা, নিঃস্ব হয়ে যাওয়া, বিদেশ যাওয়ার খরচ বেড়েই চলেছে।

৬। বিদেশে আদম রপ্তানির সাথে জড়িতরা সকলেই রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রীর আত্মীয়। অনেক নেতা নিজেরাই ব্যবসার সাথে জড়িত। ফলে শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা হয় – এমন কোন আইন হয় না। হলেও তার প্রয়োগ হয় না।

গরীব মানুষগুলোই কি সমস্যা?

কথায় কথায় আমরা দালাল আখ্যা দিয়ে যে কোন প্রক্রিয়াকে দালালমুক্ত করার কথা হুট করে বলে ফেলি। অথচ সারা খবরে এমন কোন তথ্য নেই যে এই দালালেরা কোটিপতি। বরং আদম ব্যবসায়ী , লাইসেন্সপ্রাপ্ত, নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অনেক মালিকই বরং চরম ধনী।

একবারও কি ভেবে দেখছি যে এই লোক গুলোর অন্য কর্ম সংস্থান নেই? এই দালালির ইনকাম বন্ধ করে দেওয়ার পরে এরা কি করবে? চুরি? ডাকাতি? হত্যা? আমাদেরকে আরেকটু গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা করে তারপর পরামর্শ দেওয়া উচিত। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, প্রতারণা যেমন বন্ধ করতে হবে, সেই রকম ভাবে – শ্রমিকের স্বার্থ, রিক্রুটিং এজেন্সির স্বার্থ, এই এক লাখ মানুষের উপার্জনের স্বার্থও দেখতে হবে। দেশে কোন কর্ম সংস্থান নেই। হুট করে দালাল বলে গালি দিচ্ছি, আমরা এই মানুষ গুলা বা তাদের পরিবারকে খাওয়ানো পরানোর দায় দায়িত্ব নেব? কিন্তু সরকারের তো এই দায়িত্ব ভুলে গেলে চলে না, তাই না?

কারো উপার্জনের পথ বন্ধ করে না দিয়ে বরং প্রতারণা আর নিয়ন্ত্রণহীনতাকে বরং দূর করা উচিত। সরকারের কাজ মানুষের রোজগারের পথ বন্ধ করে দেওয়া নয়, রোজগারের পথ নিয়ন্ত্রন করা – যাতে একজনের রোজগার অন্য কারো ক্ষতি না করে।

কারো রুটি রুজির পথ বন্ধ না করে বরং নিম্ন লিখিত ব্যবস্থা গুলো নিন। সরকার বা রিক্রুটিং এজেন্সি – কেউই যখন গ্রামে গঞ্জে এমপ্লয়মেন্ট অফিস খুলছেন না (আপাতত) পুরো প্রক্রিয়াটাকে নিয়ন্ত্রন করুন। যারা অলরেডি এই ফিল্ডে কাজ করছে, তাদেরকে সঠিক ভাবে আইন ও লাইসেন্সের আওতায় আনুন।

১। যারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে লোক সংগ্রহ করে, তাদেরকে লাইসেন্স দিন, তাদের নাম-ধাম-ঠিকানা- সম্পূর্ণ পরিচয় লিপিবদ্ধ করে কাগজে , পেপারে, অনলাইন ওয়েব সাইটে ( সরকারী ওয়েবসাইট ও অনলাইন পত্রিকা) পাবলিশ করে দিন।

ক) কারা এই ধরনের কাজ করতে পারবেন তার একটা বর্ণনা ও লাইসেন্স পাওয়া পদ্ধতি ঠিক করে দিন।
খ) শ্রমিকদের সন্তুষ্টির উপরে নম্বর/রেটিং দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। যার ইউজার রেটিং যত ভালো হবে, তার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করুন। এই রেটিং নির্ভর করবে, ঐ জবে যাওয়ার পরে শ্রমিক ভাই বোনেরা কতটা ভালো আছেন তার উপরে ( কাজ, বেতন, সুবিধা শর্ত মত পেয়েছে কিনা)

পুরস্কার দেওয়া উচিত কারণ এই মানুষ গুলো কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করছে। সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারলে এতে দেশের আয় হয়।

২। দালাল ও শ্রমিক, উভয় পক্ষের জন্য ব্যাংক একাউন্ট খুলে দিন । সমস্ত টাকা পয়সার লেন দেন ব্যাংকের মাধ্যমে করার ব্যবস্থা করুন। ব্যাংক ব্যবহারের জন্য ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করুন। বিদেশ থেকে কি ভাবে টাকা পাঠাবেন, কি ভাবে দেশে যোগাযোগ করবেন ইত্যাদির ট্রেনিং দিন। এই ট্রেনিং এর ব্যবস্থা রিক্রুটিং এজেন্সিই করতে পারে। সরকার শুধু আইন তৈরী ও মনিটরিং করবে।

৩। প্রতিটা এজেন্ট কাকে কাকে, কোন রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে নিয়ে যাচ্ছে – তার রেকর্ড রাখার ( কাগজ ও অনলাইনে) ব্যবস্থা করুন।

৪। প্রতিটা শ্রমিক যখন বিদেশে যায় – তখন সেই শ্রমিকের পরিচয়ের পূর্ণ বিবরণ, যেমন —

ক) নাম
খ) ঠিকানা
গ) ছবি
ঘ) ব্যাংক একাউন্ট এর তথ্য
ঞ) তার পরিবারের তথ্য-পরিচয়, যোগাযোগের ঠিকানা, টেলিফোন, ছবি
চ) যার মাধ্যমে রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে গেছে তার তথ্য- পরিচয়, যোগাযোগের ঠিকানা, টেলিফোন, ছবি, লাইসেন্স নম্বর
ছ) রিক্রুটিং এজেন্সির তথ্য-নাম, অফিসের ঠিকানা, টেলিফোন, লাইসেন্স নম্বর
জ) যেই কোম্পানিতে কাজ করতে যাচ্ছে সেই কোম্পানির পরিচয়- নাম, অফিসের ঠিকানা, টেলিফোন, লাইসেন্স নম্বর
ঝ) যে কাজ করতে যাচ্ছে তার বর্ননা-পদ, দায়িত্বের বিবরণ, বেতন, শর্তসমূহ

উপরের সমস্ত তথ্যে এক কপি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় সমূহ, এক কপি রিক্রুটিং এজেন্সি ও এক কপি সেই দেশের দূতাবাসে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

এই তথ্যগুলো যাচাই ও সম্পন্নের জন্য এয়ারপোর্টে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অফিস, কম্পিউটারের শিক্ষায় শিক্ষিত কর্মী রাখার ব্যবস্থা করুন। — দেশের অন্য কোথাও যদি কেউ মিস হয়েও যায় – অন্তত এয়ারপোর্টে , প্লেনে উঠার আগে তাকে ধরার এবং সাহায্য করার ব্যবস্থা করুন।

৫। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হলে ভিসা দেওয়া হবে না।

৬। শ্রমিকদের ডিজিটাল পরিচয় পত্র দিন যেখানে ৪ নম্বরের সমস্ত তথ্য ঐ ডিজিটাল কার্ডের চিপে সংরক্ষিত থাকবে। যে কোন প্রশাসন কার্ড রিডারের মাধ্যমে এই তথ্য যে কোন সময় এক্সেস করতে পারবেন। এয়ারপোর্টে এই কার্ড দেখিয়ে , তথ্য যাচাই করে প্লেনে উঠার অনুমতি দেওয়া হবে, নইলে নয়।

আজকের টেকনোলজির যুগে নিয়ম করে এই সামান্য কাজ টুকু করা কোন ব্যাপারই না।