বিতর্কের বাহিরে আসুক বাংলা একাডেমি

ওয়াসিম ফারুক
Published : 31 Dec 2016, 09:01 AM
Updated : 31 Dec 2016, 09:01 AM

বেশ কয়েক বছর যাবত অমর একুশে বই মেলা কোন ভাবেই যেন বিতর্কের বাহিরে বের হতে পারছেনা । পাঠক লেখক আর প্রকাশকদের দীর্ঘ এগারো টি মাস অপেক্ষা শুধুই বাঙ্গালীর প্রাণের মেলা অমর একুশের বই মেলার জন্য । ২০০৪ সালে অধ্যপক হুমায়ুন আজাদকে কোপানের পর থেকে ই আমাদের বাঙ্গালীর প্রাণের মেলায় কেমন জানি প্রাণ শূণ্য প্রাণ শূন্য পানশে হয়ে উঠেছে ।বই মেলা এলেই মনের ভিতর কেমন জানি অজানা অতংক ভর করে থাকে ।সবসময় ই মনে হয় চাপাতির আর ধমক শুধুই পিছু করে ফিরছে আমাদের প্রাণের মেলাকে । ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ইরানি লেখক আলি দস্তি'র 'বিশতো সেহ সাল' নামে একটি বইয়ের অনুবাদ প্রকাশের জন্য ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে রোদেলা প্রকাশনী বন্ধ করে দিয়েছিল এবং বইটি নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছিল ।এর কিছু দিন পর ই ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ উগ্রধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠির চাপাতির হামলায় মেলা প্রাঙ্গণে জীবন দিতে হয় বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে সাথে আহত হতে হয় তার স্ত্রী ও বিজ্ঞান লেখক বন্যা আহমেকে ।

২০১৬ সালের বই মেলা ও বিতর্কের বাহিরে বের হতে পারেনি । গত বছরের মেলার অর্ধেক না পেরোতেই, ধর্মীয় উগ্রবাদের অপশক্তিরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর " ইসলাম বিতর্ক " বইটি নিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে চরম বিতর্কের সৃষ্টি করে। আর এই বিতর্কের জের ধরে ই গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বই মেলায় বন্ধ করে দেয়া হয় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল সেই সাথে গ্রফতার করে হয় বইটির সম্পাদক ও প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিক সহ প্রকাশনীর কর্মকর্তা ফকির তসলিম উদ্দিন কাজল এবং লেখক শামসুল আলম চঞ্চল সহ পাঁচজনকে । পরে তাঁদের তিনজনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (২) ধারায় মামলা ও রিমান্ডের ব্যবস্হা করা হয় ৷ সেই ধর্মীয় উগ্রবাদীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ইভেন্ট, গ্রুপ খোলে বইটির সম্পাদক ও প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিকের বাসার ঠিকানা, অফিস ঠিকানা, ফোন নম্বর দিয়ে আক্রমণের জন্য উৎসাহিত করেছে তাদের সহযোগিদের । অথচ এই শামসুজ্জোহা মানিক ষাটের দশকের আইয়ুব আন্দোলনের একজন অগ্রভাগের ছাত্রনেতা এবং সমাজ বিশ্লেষক গবেষক ও বটে । খুনী চোর ডাকাত দুর্নীতিবাজ ধর্ষনকারী কত ই না অপরাধী আদালত থেকে জামিন পেছে গত এক বছরে শুধু জামিন হয়নি লেখক ও প্রকাশ প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিকের ।

এবারের একুশের বই মেলা শুরুর আগেই মহাবিতর্কের জন্মদিয়েছে শ্রাবণ প্রকাশনীকে বই মেলায় দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে । শ্রাবন প্রকাশনীর অপরাধ এর স্বত্তাধিকারী রবিন আহসান গত বইমেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর 'ইসলাম বিতর্ক' নামের একটি বই নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ ও বইটি প্রকাশের দায়ে গ্রেপ্তার প্রকাশক শামসুজ্জামান মানিকের মুক্তির আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন ।শ্রাবণ প্রকাশনীকে একুশের বই মেলা থেকে নিষিদ্ধ করায় প্রতিবাদের ঝড় উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ নানা মাধ্যমে । অবশেষে গত ২৭ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির সামনে এক বিক্ষোভ সমাবেশ করেন লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীরা । নানা সমালোচনা সহ দীর্ঘদিন পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে ।শামসুজ্জামান খান তার বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে সাংবাদিকদের মূর্খ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা লেখাপড়া জানে না বলে ও মন্তব্য করেন । পরে অবশ্য নানা প্রতিবাদের মুখে শ্রাবণ প্রকাশনীর ব্যাপারে কিছুটা নড়ে চড়ে বসতে বধ্য হয়েছে বাংলা একাডেমির কর্তাব্যক্তিরা ।সম্প্রতি এক সভায় বাংলা একাডেমি কতৃপক্ষ বিশেষ কিছু শর্ত মানার অঙ্গীকারনামা দিলে একুশে বইমেলায় শ্রাবণ প্রকাশনীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায় তারা । বাংলা একাডেমি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার অন্যতম স্হান । আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার চেতনায় ই অমর একুশের বই মেলা । তবে বিগত কয়েক বছরে বাংলা একাডেমি তাদের কর্মকান্ডের ভিতরে একটি বিতর্কিত মনোভাবের জন্ম দিয়েছে । কোন লেখকের কোন বই যে কোন কারনেই হউক তা নিষিদ্ধ হতে ই পারে এবং বিশ্বের অনেক স্হানেই এমন টি ঘটে তার জন্য সমগ্র প্রকাশনী সংস্হাকে নিষিদ্ধে করে দেয়া বা বন্ধকরে দেয়ার নজির বোধ হয় তেমন কোথা ও নেই । কারন একটি প্রকাশনী সংস্হা থেকে শুধু মাত্র এক জন লেখকের ই বই প্রকাশ হয় না । তাই যদি কোন মেলা থেকে কোন প্রকাশনীর স্টল বন্ধ বা নিষিদ্ধ করা হয় তা হলে কিন্তু ঐ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত অন্যান্য লেখকদের প্রকাশিত বই বিক্রি বন্ধ করে তাদের সথে চরম অবিচার ছাড়া কিছুই করা হয় না ।

'বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩' এর দশ নম্বর ধারায় 'একাডেমির কার্যাবলি' অংশের প্রথমেই বলা হয়েছে– "জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সঙ্গতি রাখিয়া বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়ন, লালন ও প্রসার সাধন।" স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে বাংলা একাডেমি আদৌ কি জাতীর আশা-আকাঙ্ক্ষান প্রতিফলন ঘটাতে স্বক্ষম হয়েছে ? যে দমন নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমাদের মহান মুক্তি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম সে খানে ও যদি অন্যয়ের প্রতিবাদ করার জন্য নিজের অধিকার ধ্বংস হয় তার চেয়ে লজ্জা ও দুঃখের অবশিষ্ট আর কি থাকতে পারে ? ধর্মীয় উগ্রবাদ তথা মৌলবাদের অপশক্তি আজ সমগ্র জাতিকে ধ্বংসের পায়তারায় লিপ্ত । যে ভাবেই পারছে ঐ অপশক্তি আমাদের আঘাত করে যাচ্ছে । আমাদের এই কঠিন সময়ে বাংলা একাডেমীর মত প্রতিষ্ঠান ও মৌলবাদের অপশক্তির কাছে মাথা নত করে তা হলে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখো মুখি হবে । আমরা চাইবো বাহান্নর একুশের চেতনা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেনায় বলীয়ান হয়ে বাংলা একাডেমী তার নিজস্ব ধারায় এগিয়ে যাবে । কোন মানিক কে যেন আর জেলে যেতে না হয় রোদেলা বা ব-দ্বীপ কাউকে যেন বন্ধের ঝাপ না লাগাতে হয় আর কোন শ্রাবন কে যেন শর্তের বোঝা মাথায় নিয়ে মেলায় না আসতে হয় । আগত একুশের বই মেলা হবে আনন্দের মেলা মিলনের মেলা এটাই প্রত্যাশা ।