অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক পাঠ্যবই

ওয়াসিম ফারুক
Published : 19 Jan 2017, 04:01 AM
Updated : 19 Jan 2017, 04:01 AM

বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় যার জন্ম। যুগ যুগ ধরে এ দেশের নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের একই ঘটের জল খেয়ে বেড়ে উঠেছে একে অপরের সুখ দুঃখের সঙ্গীও হয়েছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ধর্ম বর্ণের বিভেদ ভুলে দেশমাতৃকার অস্তিত্ব রক্ষায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবন বাজি রেখে সবাই ঝাঁপিয়ে পরেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। এরই ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি একটি লাল সবুজের পতাকা, পেয়েছি বিশ্বমানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। তবে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বাধীন মাতৃভূমি পেয়েছি সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা কেন জানি আজও ধুকে ধুকে মরছে। ব্যক্তি স্বার্থের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যই অসাম্প্রদায়িক ও সাম্প্রদায়িক চেতনাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। কোন কোন রাজনৈতিক গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতা তথা ধর্মকে পুঁজি করে নিজেদেরকে রাজনৈতিক ময়দানে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় লিপ্ত আবার কেউ অসাম্প্রদায়িকতা কে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ যাদের নেতৃত্বে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে বরাবারই আমারা জেনে আসছি তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। কিন্তু বাস্তবতা আমাদের বিশ্বাস থেকে অনেক দূরে।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বরাবরই সাম্প্রদায়িকতা প্রাধান্য পেয়ে আসছিল। কোমলমতি শিশুদের পাঠ্য বইই সাম্প্রদায়িকতার মূল শিকার। শিশুদের পাঠ্য বইয়ে আমরা যেমন দেখেছি "ঋ" তে ঋষি বাক্য শিরধার্য "ঈ" তে "ঈশ্বর কে বন্দনা করো", তেমনি দেখছি "ও" তে ওড়না চাই, "ঈ" তে ঈদ ইত্যাদি।

যেখানে আমদের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার মূল চেতনাই ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া সেখানে কেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধুকে ধুকে মরছে? শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দাবি মেনে নিয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে অমুসলিম ও প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে। যার প্রমাণ সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো হেফাজতে ইসলামের বিবৃতি থেকে। হেফাজতে ইসলামের বিবৃতিতে বলা হয় তাদের দাবি মেনে স্কুলের পাঠ্যবই থেকে 'নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দু তত্ত্বের বিষয়বস্তু' বাদ দেওয়া হয়েছে এই জন্য তারা সরকারের প্রশ্রংসায় মঞ্চমুখও। তাদের দাবি সরকার মেনে নেয়ায় নাকি ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠীর গায়ে জ্বালা ধরেছে বলে মন্তব্য করেছেন সংগঠনটির আমির শাহ আহমদ শফী। এখানে ইসলামবিদ্বেষী বলতে হেফাজতে ইসলামের আমির বিশেষভাবে দেশের প্রগতিশীল শক্তিকেই বুঝিয়েছেন যারা বরাবই সাম্প্রদায়িকতা তথা ধর্মীয় উগ্রবাদের ঘোর বিরোধী।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ একটি মহাশক্তি হিসেবে দাড়িয়ে আছে। ২০১৩ সালে ৫ মে সমগ্র ঢাকা শহরে এক নারকীয় তান্ডবের মাধ্যমে তাদের শক্তি পরীক্ষা দেখিয়েছেন। যদিও সেদিন সরকার সু-কৌশলে হেফাজতে ইসলামকে তাড়াতে পেরেছেলেন কিন্তু তাদের সেই তান্ডবের ভয় সরকার আজও মন থেকে মুছতে পারেনি। সেদিন হেফাজতে ইসলাম সরকারের কাছে ১৩ দফা সম্বলিত একটি দাবি নামা দিয়েছিলেন। সরকার ক্রমান্বয়ে তাদের সে দাবি পূরণের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের মতো আমারও ধারণা। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাই বড় নিয়ামক। যেকোন মূল্যে দেশ ও জাতীর স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকতেই হবে। তাই আমরা নানা সময় জাতীয় নির্বাচনের পর ক্ষমতা হারানো রাজনৈতিক দলগুলির কাছ থেকে শুনেছি ওমুকের ওমুক দাবি আমরা পূরণ করিনি বলে সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে আমাদের ক্ষমতা থেকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি আমাদের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলিকে নানা সময় তাদের সমস্যাগুলি নিয়ে ক্ষমতাধর বিদেশী রাষ্ট্রগুলির কর্তাব্যক্তিদের কাছে নালিশ ও করতে দেখেছে অথচ তারা মুখে শিকার করছেন আমরা জনগণই নাকি সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস!

আমাদের দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হওয়ায় প্রত্যেক রাজনৈতিক দলই চায় ইসলামিক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠিকে যে কোন মূল্যে খুশি রাখতে। এই জন্য বিএনপি যেমন স্বাধীনতা বিরোধী জামাত-শিবির সহ বেশ কিছু ইসলামিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সাথে জোট বেঁধেছে তেমনি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আওয়ামীলীগ ও আল্লামা আজিজুল হকের সাথে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল যদিও পরে সেই চুক্তি আর বাস্তবায়ন হয়নি। এর পর আওয়ামীলীগ হেফাজতে ইসলামকে খুশি রাখতে রেলের জমি সহ নানা কিছু দিয়ে প্রাণপন চেষ্টা করছেন হেফাজতে ইসলামকে খুশি রাখতে।

এই মুহূর্তে আমাদের দেশে সহ সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেরই অন্যতম সমস্যার একটি হলো জঙ্গিবাদ তথা ধর্মীয় উগ্রবাদ। আমাদের সরকারও তার আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী জীবন বাজি রেখে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্হান নিয়েছে। হেফাজতে ইসলাম সহ বিভিন্ন ইসলামিক দল ও গোষ্ঠীর দাবি অনুযায়ী সরকার শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে সহজপাঠের নামে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বৈষম্যমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্তি ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর অপকৌশল লিপ্ত হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। আমরা চাইবো আমাদের শিশুরা উদার, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে বড় হবে। যদি তাদেরকে ছোটবেলা থেকেই পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে ধর্মীয় বৈষম্যে শিক্ষা দেয়া হয় তা হলে আমাদের শিশুরা কখনোই অসাম্প্রদায়িক উদার মনোভাব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধে বড় হতে পারবে না।