চাল নিয়ে চালবাজি, জনগণের তেলেসমাতি

ওয়াসিম ফারুক
Published : 22 Sept 2017, 05:50 AM
Updated : 22 Sept 2017, 05:50 AM

বাংলাদেশ একটি কঠিন সময় পার করছে। ভারত থেকে আসা পানিতে দেশের অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চল তলিয়ে ছিল বেশ কিছুদিন। সে পানি না কমতেই মিয়ানমার থেকে নেমে এসেছে সে দেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল। আনুমানিক পাঁচ লাখ আরকান রোহিঙ্গা সে দেশের সরকারী বাহিনী ও বৌদ্ধ মৌলবাদীদের গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে নিজেদের ভিটামাটি ছেড়ে জীবন বাঁচাতে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছে আমাদের দেশে। আমরা বাংলাদেশীরা মানবিক, তাই মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি রোহিঙ্গাদের জন্য।

দেশের সবাই যখন রোহিঙ্গাদের নিয়ে ব্যস্ত ঠিক এমন সময় আমাদের চালের বাজারে হঠাৎ করেই আগুন লেগে গেছে। গরীবের মোটা চালের বাজার দাম পঞ্চাশ টাকা পার হয়েছে, আর মধ্যবিত্তের চিকন চাল সত্তর ছাড়িয়েছে।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন চালের বাজারে আগুন লাগালো কারা? প্রতি বছরই আমাদের দেশে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে চালের বাজার কিছুটা লাগামহীন হয়ে পরে। বোরো ও ইরি ধান বলে পরিচিত যেসকল ধান আছে তা সাধারণত আষার ও শ্রাবণ মাসের শেষ নাগাদ কৃষকের গোলা থেকে চলে আসে চালকলের মালিক কিংবা আড়তদারদের গুদামে। মিল মালিক ও আড়তদারেরা অতিমুনাফার লোভে তাদের মজুদ করা চাল বাজারে বিক্রি না করে অবৈধ ভাবে মজুদ করে রাখেন। এতে রাজারে চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেন এক শ্রেণীর অবৈধ ব্যবসায়ী।

অবশ্য এর জন্য আমাদের দেশে নোংরা রাজনীতিও কম দায়ী না। কারণ আমাদের দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা কোন না কোন প্রাভাবশালী রাজনীতিক দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। আর এই রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাই অবৈধ ব্যবসায়ীদের অবৈধ ব্যবসার অন্যতম হাতিয়ার। এর সাথে আছে একে অপরের প্রতি দোষারপের প্রবণতা। যেমন চালের বাজারের কথাই বলি- দাম বাড়ার জন্য খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষ চাপাচ্ছেন পাইকারী ব্যবসায়ীদের, আবার পাইকারী ব্যবসায়ীরা দোষ দিচ্ছেন মিল মালিকদের, আর মিল মালিকরা বন্যা-খরা-বৃষ্টি কত না অযুহাত, আর সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের মিডিয়ায় হুমকি-ধামকি পর্যন্তই শেষ। সব শেষে সব কিছুরই দায়ভার পরে দেশের সাধারণ মানুষের উপর।

বেশ কয়েক বছর যাবতই আমাদের সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে আমাদের দেশ নাকি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এর মাঝে দেখলাম বিদেশেও চাল রপ্তানি করলো সরকার। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন, একটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে হুট করে কিভাবে খাদ্যের অর্থাৎ চালের সংকট দেখা দেয়? যে দেশ মাত্র কিছুদিন আগে চাল রপ্তানি করলো সে দেশকে কেনইবা আশেপাশের দেশ থেকে লাখ লাখ টন চাল আমদানি করতে হচ্ছে? চালের বাজারের আজ যে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা এর জন্য সরকার ব্যবসায়ীদের কাঁধে দোষ চাপিয়ে নিজেরা দায় মুক্তি পেতে চাচ্ছে।

সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কি নাকে তেল দিয়ে ঘুম আসছিলো? তাদের কাছে কি কোন গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল না যে ব্যবসায়ীদের একটি চক্র চালের বাজার কে অস্থির করতে পারে? আমাদের বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী বিরুদ্ধেও কিন্তু অভিযোগের অন্ত নেই। এর আগে আমরা দেখেছি ব্রাজিল থেকে পঁচা গম আমদানীর পর সারা দেশে এ নিয়ে তোলপার সৃষ্টি হয়েছে। এবার আবার ভিয়েতনাম সহ অন্যান্য দেশ থেকে নাকি আতপ চাল আমদানী করতে যাচ্ছে সরকার।

আতপ চালের আমাদের দেশে কোন চাহিদা নাই বললেই চলে। আতপ চাল কারোই পছন্দ না, তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন- কার পছন্দে সরকার আতপ চাল আমদানীর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? প্রতিদিনই সরকারে কর্তাব্যক্তিদের মুখ থেকে শুনতে পাই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে, বাস্তবে বাজার পরস্থিতি পুরোপুরি তার উল্টোটাই দেখছি। সরকার বেগতিক হয়ে শেষ পর্যন্ত চাল কিনতে ছুটে গেছেন বর্তমান সময়ে মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু মিয়ানমারের কাছে।

চালের এই লাগামহীন অবস্থায় দেশের মানুষ আজ দিশেহারা। তাই সরকার সহ চাল ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত সবাইকে আজ ভাবতে হবে দেশের সাধারণ মানুষের কথা। ব্যবসায়ীদের উচিত হবে না অতি মুনাফার লোভে দেশের মানুষের সাথে ছিনিমিনি খেলা। সরকারের করণীয় হবে ব্যবসায়ীদের পাশে নিয়ে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।