ফেইসবুক ধর্ম ও ধর্ম অবমাননা

ওয়াসিম ফারুক
Published : 4 Nov 2017, 04:10 AM
Updated : 4 Nov 2017, 04:10 AM

ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর পোস্ট বা ছবি প্রচার নিয়ে প্রায়ই আমাদের দেশে কোথাও না কোথাও নানা ধরনের আঘটন ঘটছে। যে অঘটনগুলি কোন এক পর্যায়ে আমাদের সভ্যতাকে প্রশ্ন ও হুমকির মুখে ফেলে। অতি সম্প্রতি ফরিদপুরের সদরপুরের ঘটনা আমাকে এমনটাই মনে করিয়ে দিল। ফরিদপুরের সদরপুরে ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর ছবি পোস্ট করার অভিযোগে বিষ্ণু মালো নামের এক তরুণকে আটক করেছে পুলিশ। স্থানীয় হাটকৃষ্ণপুর বাজারে তরুণ কম্পিউটার সার্ভিসিং নামের একটি দোকান নিয়ে ব্যবসা করে আসছিলেন বিষ্ণু মালো। যেখানে কম্পিউটারের বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি মুঠোফোনে গান ভর্তি করার ব্যবসা করতেন তিনি। ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর ছবি পোস্ট করার ঐ অভিযোগে স্থানীয় প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তি হাটকৃষ্ণপুর বাজারে বিষ্ণুর দোকানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। পরে হামলাকারীরা ওই বাজারসংলগ্ন মালোপাড়ায় গিয়ে বিষ্ণুর বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পাশাপাশি পূর্বের ঘটনা গুলিই প্রশাসনকে কিছুটা সজাগ করার কারনে ঐ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করতে হয় প্রশাসনকে। যদিও বিষ্ণু মালোর দাবী, বিষ্ণু কুমার মালো নামে যে ফেসবুক আইডি থেকে ঐ পোস্টটি করা হয়েছে সেটি তার নয়। তার নিজের আইডির নাম রাহুল বিষ্ণু এবং এটি তিনি তার নিজের মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করে খুলেছেন।

ভাংচুর করা হয়েছে ওই যুবকের মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানটি

এর আগেও আমরা দেখেছি একই আভিযোগে কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লীতে কি ভয়াবহ হামলার ঘটনাই না ঘটেছিল! রামুর সেই ঘটনায় সমগ্র দেশই সামান্যতম ঝুঁকি খেয়েছিল। উত্তম বড়ুয়া নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী কক্সবাজারের রামুর ১২টি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার ও ৩২টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় আরও ছয়টি বৌদ্ধ বিহার ও শতাধিক বসতঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। পরদিন উখিয়া-টেকনাফে আরও কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে ঐ একই ঘটনা ঘটে। রামুর ঐ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং নাগরিক সমাজে এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনা যেমন হয়েছে রাজনৈতিক মায়দানও কম উত্তপ্ত ছিলনা। একে অপরকে দোষারোপ করলেও শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আমাদের রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের প্রায় সব জায়গায় ভিন্নমত ও কাঁদা ছোরাছুরি থাকলে ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমন ও তাদের জায়গা সম্পত্তি দখলে সবাই ভাই ভাই।

রামুর ঘটনার পর ৬ই অক্টোবর ২০১২ দৈনিক প্রথম আলোর "৪০ হামলাকারী শনাক্ত, মূল শক্তি অজানা" শিরোনামে এক সংবাদ পরিবেশন করেন। তাতেই আমরা প্রমাণ পাই রামুর ঘটনায় জামাত-শিবিরের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা যেমন তৎপর ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা কর্মীরাও কম তৎপর ছিলেন না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে কথাই ধরুন, সামান্য লেখাপড়া জানা জেলে পরিবারের সন্তান রসরাজ দাস ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননার নাম করে কত আত্যাচারই না সহ্য করতে হয়েছিল রসরাজ সহ নাসির নগর এলাকার নিরীহ হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কে। পরে জানা গেল ফেইবুক কিভাবে ব্যবহার করে তা-ই রসরাজের জানা নেই। অথচ কে বা কারা রসরাজ দাসের নাম ব্যবহার করে ফেইসবুক আইডি খুলে তথাকথিত ধর্ম অবমাননার পোস্ট দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সহ সমগ্র দেশেই অস্থিরতার জন্ম দিয়েছিল। আগেও আমরা দেখিছি বাগের হাটের মোরেলগঞ্জের চপল কুমার পোদ্দার, সদর থানার পাপন বিশ্বাস, নোয়াখালীর হাতিয়ার স্কুল শিক্ষক দেবব্রত দাস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়ন মজুমদার, মাগুরার শালিখার দিপু বিশ্বাস, লালমনিরহাট সদর থানার শ্যামল চন্দ্র রায় শিমুল, ময়মনসিংহ শহরের ছাত্রলীগ নেতা বিমল পাল সহ হাজারো নিরীহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে শুধুমাত্র ফেইসবুকে তথাকথিত ধর্ম অবমাননার আভিযোগে জেলজুলুম নির্যাতনের শিকার হতে। পরে অবশ্য প্রত্যেকটই প্রমাণ হয়েছে যে এর কোনটার সাথে অভিযুক্ত কেউই জড়িত না। সাধারণত ফেইসবুক বা কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথাকথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে একজন নীরিহ মানুষকে নির্যাতন বা বাড়ি ঘড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর অগ্নিসংযোগ কিংবা আইন-শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার আদৌ কি কোন সভ্য সমাজ সমর্থন করে?

ফেইসবুক বা অন্য যে কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতগুলি ভুয়া আইডি আছে তার কি কোন সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছে আছে? যে কেউ চাইলে অন্য কারো নাম ছবি ব্যবহার করে ফেইসবুক সহ যেকোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি আইডি খুলত পারে। সেই আইডি ব্যবহার করে শত্রুতা উদ্ধারের জন্য যদি কোন অপরাধ সংগঠিত হয় এর দায় ভার কার? আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যার ছবি ও নাম ব্যবহার হয়েছে তারই উপর চাপানো হচ্ছে পুরো দায়ভার। আমাদের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কোন বিচার বিবেচনা ছাড়াই গ্রেফতার করছে তথাকথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে। অথচ ধর্মীয় সংখ্যাগুরু যারা তথাকথিত ধর্ম অবমাননার নামে একজন নিরীহ মানুষের জান-মালের উপর আঘাত করছে তারাই থেকে যাচ্ছে বীরের বেশে। এ ধরনের ঘটনা যে শুধু আমাদের বাংলাদেশেই ঘটছে তা না, ভারতেও আমরা দেখেছি গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে বা গরু কোরবানির অপরাধে সেখেনকার উগ্র হিন্দু মৌলবাদীরা পুরিয়ে মারছে নিরীহ সংখ্যালঘু মুসলমানদের।

পাকিস্তানে ধর্মনিয়ে তথাকথিত অবমাননার অভিযোগে ইটের ভাটায় পুরিয়া মারা হচ্ছে খৃস্টান দাম্পত্তিকে ব্লাসফেমি আইনের গেরাকলে পরে ফাঁসির দড়িতেও ঝুলতে হয়েছে অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে। আমাদের দেশে অবশ্য এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুরো দায় ভারই তথাকথিত অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল ও জামাতে ইসলাম কে রক্ষার জন্য রাস্তায় নেমে এই সংগঠনি টি আমাদের দেশে সকল ধর্মের ভাতৃপতিম সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছে এবং হিংসার বিষবৃক্ষ রোপন করেছে। আজও আমাদের দেশের এ ধরনের প্রতিটি ঘটনার মুলেই হেফাজতে ইসলাম। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার একটি ছিল ধর্ম নিরপেক্ষ স্বাধীন দেশ। কিন্তু আজও আমাদের সেই চেতনার বাস্তবে রূপ নিতে পারেনি। আজও আমাদের দেশে ধর্মীয় সংখ্যা গুরুদের দ্বারা নানা ভাবে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে আমাদের বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কে যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার পরিপন্থী। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সত্যিকরের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা।