ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংখ্যালঘুদের দায়

ওয়াসিম ফারুক
Published : 16 Nov 2017, 03:27 AM
Updated : 16 Nov 2017, 03:27 AM

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। মাঝেমাঝেই কিছু ঘটনা আমাদের সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করে। প্রতিটি ঘটনার প্রেক্ষাপটেই দেখা যায়, কোন এক ধর্মীয় সংখ্যালঘু যুবকের বিরুদ্ধে ফেইসবুক তথা সোস্যাল মিডিয়ায় ধর্ম অবমাননার আভিযোগ, তারপর ধর্মের মানসম্মান রক্ষার জন্য হাজারো মানুষের মিছিল সবাবেশ, এরপর ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট। গত কয়েক বছরে কক্সবাজারের রামু, কুমিল্লার হোমনা, পাবনার সাথিয়া, সাতক্ষীরার ফতেহপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, ফরিদপুরের সদরপুর, সর্বশেষ শিরোনাম হলো রংপুর সদর উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রাম।

ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে শুক্রবার রংপুরের সদর উপজেলায় খলেয়া ইউনিয়নের ঠাকুরপাড়া গ্রামে শুক্রবার হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়।

গত সপ্তাহে ফরিদপুরের সদরপুরের হাটকৃষ্ণপুর এলাকায় ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে বিষ্ণু মালো নামের হিন্দু সম্প্রদায়ের এক যুবকের বাড়ী ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় স্হানীয় ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। এর রেশ না কাটতেই গত ১০ নভেম্বর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো রংপুর সদর উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামে। গত ৫ নভেম্বর আলমগীর হোসেন নামের এক মুদি দোকানদার টিটু রায় নামের এক হিন্দু যুবকের বিরুদ্ধে ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননাকর পোস্টের অভিযোগ এনে থানায় মামলা করেন। এরপর থেকেই স্থানীয় ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে ফেইসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্টের কথা প্রচার করে হিন্দুদের প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ সৃষ্টির পায়তারা চালানো হয়। পাঁচ দিনে যা তিল থেকে তালে পরিণত হয়। এই তালেরই বিষ্ফোরণ ঘটে ১০ নভেম্বর শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর।

যেই টিটু রায়ের বিরুদ্ধে আভিযোগ এনে থানায় মামলা, এরপর এতো কিছু সেই টিটু রায় দীর্ঘ সাত বছর যাবৎ দেনার দায়ে পরিবার পরিজন নিয়ে এলাকা ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ এসে স্ত্রী সহ কোন এক পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। টিটু রায়ের স্বজনদের দাবি, তিনি কোন লেখা পড়াই জানেন না। সংবাদ মাধ্যমে আরো যে ভয়ংকর তথ্যটি আমরা পেয়েছি তা হলো, টিটু রায়ের ছবি ব্যবহার করে যে ফেইসবুক আইডি থেকে ধর্ম অবমাননার পোস্ট দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে সেখানে ইংরেজিতে তার নাম টিটু রায় না লিখে মো. টিটু (এমডি টিটু) লেখা ছিল।

সম্প্রতি করা ফেইসবুক কর্তৃপক্ষের দাবী অনুযায়ী ফেইসবুকে প্রায় ২৭ কোটি ভুয়া আইডি আছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন একটি, ফেইসবুক আইডি থেকে কে বা করা তথাকথিত ধর্ম অবমাননাকর কি লিখলো বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই ক্ষেপে গেল আমাদের ধর্মপ্রাণ মানুষগুলি। প্রতিটি এই ধরনের ঘটনার পর দেখি হাজার হাজার মানুষ একত্রে হামলা চালায়। স্বাভাবিক ভাবেই আমার প্রশ্ন ঐ হাজার হাজার মানুষ সবাই কি ঐ পোস্টটি দেখেছেন নাকি কোন বিশেষ মহল নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ গুলিকে ধর্ম অবমাননার কথা বলে উস্কিয়ে দিচ্ছে?

পূর্বের এই ধরনের ঘটনা থেকে আমরা যতটুকু শিখেছি তাতে রংপুরের এই ঘটনার জন্য কিন্ত সেখানকার হামলাকারীদের পাশাপাশি প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ কেউ কম দায়ী নন। উত্তেজনাটা চলছিলো কয়েক দিন ধরেই। তবে কেন সেখানকার প্রশাসন জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদ কারো মনেই রামু নাসিরনগর বা সদরপুরদটনা সহ অন্য আরো ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি আসলো না?

ধর্ম তো এতোটাই ঠুনকো নয় যে ফেসবুকে কে কি লিখলো আর তাতেই ধর্মের অবমাননা হয়ে গেল। ধর্মের বিশ্বাসীদের তো বিশ্বাসই ধর্ম এসেছে স্রষ্টার কাছ থেকে। মুসলমানদের তো বিশ্বাসই ইসলাম হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠার ধর্ম, যা স্বয়ং আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য পাঠিয়েছেন। তাই যে বিধান স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা নিজে দিয়েছেন তার সামন্য সৃষ্টির আচরণে কি কখনোই সেই বিধান হেয় প্রতিপন্ন হয়?

ধর্ম হচ্ছে মানুষকে কল্যাণ, সত্য ও ন্যায়ের দিকে ডাকার একটি পথ। আর এটাই সত্য। এই সত্যকে যারা বিশ্বাস করেন তাদের পক্ষে কি সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করা, নিরীহ মানুষের বাড়ি-ঘড়ে হামলা করা, আগুন দেয়া, ধর্ষণ-লুট করা কিংবা সাধারণ মানুষকে হত্যা করা সম্ভব? আজ আমাদের সমাজ তথা রাষ্ট্রে একশ্রেণীর মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করছে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে দখল করার হাতিয়ার হিসেবে। আর এতে তারা ব্যবহার করছে আমাদের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষদের ধর্মীয় অনুভুতি। যা আমরা দেখেছি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। হেফাজতে ইসলাম নামক তথাকথিত ধর্মীয় সংগঠনটি সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সমগ্র দেশে কি ভয়ংকর পরস্হিতি ই না তৈরি করেছিল। ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে জামাত-শিবিরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের চেষ্টাও আমরা কম দেখিনি। বিভিন্ন অযুহাতে একশ্রেণীর কায়েমী-স্বার্থপরেরা ধর্মকে ব্যবহার করে আমাদের দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের জান-মালের উপর নানাভাবে হামলা করছে। সমাজ তথা রাষ্ট্রে নানা ধরনের বিশৃংখলা সৃষ্টি করছে যা কোন সভ্য সমাজের বাসিন্দাদের কাম্য নয়। তাই আমরা চাইবো আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে যারাই এ ধরনের বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে, রাষ্ট্র তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করবে।

লেখক: ওয়াসিম ফারুক, কলামিস্ট