সাবাস জামাত-শিবিরঃ ’৭১ দেখিনি, দেখাচ্ছো ’১৩

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 28 Feb 2013, 06:49 PM
Updated : 28 Feb 2013, 06:49 PM

জন্মেছি '৭১ এর বেশ কয়েক বছর পর। ইতিহাসে পড়েছি, সরাসরি যাঁরা যুদ্ধ দেখেছেন তাঁদের কাছে শুনেছি '৭১ এ এই দেশে রাজাকার, আল বদর দের তান্ডবের কথা। পাক হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়ে এই দেশের নিরীহ মানুষদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; তার ফল আমরা জানি আজ সব। প্রচন্ড ক্ষয়ক্ষতি করা গিয়েছিল, কিন্তু ঠেকিয়ে রাখা যায়নি এই দেশের মানুষদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে। ধর্মের নামে ভন্ডামীর গালে কী চমৎকার চপেটাঘাত ছিল সেটা!

এই নোংরা লোকগুলোর বিচার দ্রুত শেষ করার ব্যাপারে স্বাধীনতার ঠিক পরের সরকারটির কিছু ব্যর্থতাতো ছিলই, সাথে পরে জিয়া সরকারের হাতে 'বৈধ' রাজনৈতিক দল হিসাবে গোড়াপত্তন আর এরপর থেকে একের পর সরকারের কম-বেশী মদদে ওই রাজাকার আলবদরের দল জামাত আর তাদের ছাত্র সংগঠন শিবির এক বিরাট শক্তিতে পরিণত হয়েছে – না, জনসমর্থনের ভিত্তিতে শক্তিতে পরিণত হয়নি। আমার ভীষণ ভাল লাগে এটা দেখে যে এই দেশের নিরীহ, ধর্মভীরু মানুষরা ধর্ম নিয়ে জামাত-শিবিরের ভন্ডামী ধরে ফেলেছে চমৎকারভাবে; এজন্য তাঁদেরকে স্যালুট। একা ভোট করে জামাত একটা আসনও পাবে না এটা আমি বাজি ধরে বলতে পারি।

আমি তাদের শক্তি বলতে বোঝাচ্ছি তাদের অর্থনৈতিক শক্তির কথা। তাদের মতোই ধর্মের মুখোশ পরে ভন্ডামী করা মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের মদদে এই দেশে বিরাট আর্থিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে তারা। টাকার জোরে কিছু কর্মী আর কিছু ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে নাশকতার সৃষ্টি করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। তার চূড়ান্ত নমুনা আজ দুপুরের পর থেকে দেখছি আমরা; প্রাথমিক নমুনা দেখছিলাম গত কয়েক মাস থেকেই।

দেলু রাজাকারের ফাঁসির আদেশের পর থেকে সারা দেশে তান্ডব শুরু করেছে তারা। একজন নোংরা লোকের নোংরামীর প্রাপ্য শাস্তির জবাবে এই শুরু করেছে! ওরা এটা ভাবছে না, স্বাধীনতার পর পর বিচার হলে তো ঐ লোক মারা যেতে পারতো চল্লিশ বছর আগেই। এখন যদি এই রায় আপীল বিভাগেও বলবৎ থাকে তবে তার মৃত্যুদন্ড হবে। জামাত-শিবিরের তো আনন্দিত হবার কথা – দেলু রাজাকারের চল্লিশ বছরের 'বোনাস' জীবন প্রাপ্তির আনন্দ।

দেশব্যপী জামাত-শিবিরের তান্ডবের খবর টিভি তে দেখতে দেখতে মন খারাপ হচ্ছিল খুব। এই তান্ডবের জন্য আমি দায়ী করি জামাতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদেরকে, যারা সামনে এসে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে তাঁদেরকে নয়। কিন্তু কী ভীষণভাবে ভুল বুঝিয়ে বা কিছু টাকা দিয়ে এই দেশের সাধারণ কিছু মানুষকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের জানমালের ক্ষতি করে তথাকথিত আন্দোলনে। তথাকথিত রাজনীতির খেলায় চিরকালই মরে এই সাধারণ মানুষগুলো; 'অসাধারণ মানুষ' নেতাদের টিকিটিরও কিছু হয় না। সামনে থেকে যুদ্ধে লিপ্ত মানুষরা তো আদৌ বোঝে না জামাত-শিবিরের ভন্ডামী কত ভয়ঙ্কর! না বুঝে ওদের খেলার ঘুঁটি হচ্ছে তারা। যার মাশুল এখন পর্যন্ত দিল চার জন পুলিশ সদস্য সহ ত্রিশজনের বেশী মানুষ। 'আল্লাহর রাজনীতি' করা দল জামাত আল্লাহ্‌-রাসুলের কোন আইনের সমর্থনে এসব করছে?

আজকের এই তান্ডবে কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটেছে, অনেকেই হয়তো খেয়াল করেননি সেটা – নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে বেশ কটি হিন্দু বাড়িতে আগুন আর মন্দিরে ভাংচুর করা হয়েছে। ওদিকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় একটি বৌদ্ধমন্দিরে আগুন দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য আশা করি বুঝছি সবাই – দেশে একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে তোলা। কোন ইসলাম বলে এসব? আবার এদের মুখেই ইসলামের কথা! আল্লাহ্‌ আর রাসুলের কথা! এটা পরিস্কার মোনাফেকি। আর কে না জানে ইসলামে মোনাফেকের স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।

এই মোনাফেকদের নেতা দেলু রাজাকার আবার শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নাম দিয়েছিল 'জাহান্নামের ইমাম'! তাঁর 'অপরাধ', তিনি বিচার চেয়েছিলেন এই পিশাচগুলোর। কী ভীষণ স্পর্ধা হয়েছিল এই লোকগুলোর! এই স্পর্ধা তৈরির জন্য বর্তমান দুই 'বড়' দল কম বেশী দায়ী। এদেরকে নিয়ে রাজনৈতিক খেলা খেলতে খেলতে এদেরকে এই স্পর্ধা তৈরির পথ করে দিয়েছে। যা হোক সেটা অন্য আলোচনা, আরেকদিন করা যাবে।

আজ সারাদিন জামাত-শিবিরের তান্ডবের খবর দেখতে দেখতে একটা ব্যাপার ভেবে কষ্টের সাথে মনের কোণে একটু আনন্দও হয়েছে। যারা '৭১ এ জন্মেনি, যারা ওদের তান্ডবের কথা পড়েছে, শুনেছে শুধু, তারা আজ দেখছে সব, চিনে নিচ্ছে এদেরকে। এরা কী করেছিল, কী করতে পারে সেটা আজ আরো স্পষ্ট। এজন্যই জামাত-শিবিরকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ। নিজের অস্ত্রেই নিজেকে ঘায়েল করেছে তারা। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি এই কয়েক মাসের তান্ডব (যার চূড়ান্ত পরিণতি হল আজ) দেখে এই দেশের নতুন প্রজন্মের মনে এদের প্রতি যে ঘৃণা ছিল সেটা বেড়ে গেছে শতগুন। যারা ঘৃণা করত না, ঘৃণা তৈরি হয়ে গেছে তাদের মনে। আমি মনে করি রাজনৈতিকভাবে জামাত 'কোমা'য় চলে গেছে, কবর খুঁড়ে ফেলেছে নিজের। এখন এদের এদের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটিয়ে কবর দিয়ে দেয়ার দায়ীত্ব আমাদের 'বড়' দুই দলের।

বিএনপি এখনও কি বুঝবে না, এদের সংশ্রব না ছাড়লে জামাতের প্রতি আপামর জনসাধারণের ঘৃণার আগুনে একই সাথে পুড়বে তারাও? আর আওয়ামী লীগকে বন্ধ করতে হবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আর জামাতকে নিয়ে সব 'রাজনৈতিক খেলা' (এমন কিছু আছে বলে আমি বিশ্বাস করি এবং সেটা যৌক্তিক কারণেই; সময় করতে পারলে লিখবো)। আর আওয়ামী লীগ যদি এই খেলা বন্ধ না করে তাহলে জামাত-শিবিরের প্রতি মানুষের ঘৃণার আগুন ছাড়বে না তাদেরকেও। আমার রাজনৈতিক জ্ঞান বলে এই দুই দল জামাতকে নিয়ে খেলা ছাড়বে না। কিন্তু ওদেরকে নিয়ে খেলা বন্ধ করার জন্য দুই দলের ওপর নাগরিকদের পক্ষ প্রচন্ড চাপ জারী রাখতে হবে।

শেষ করছি জামাত-শিবিরকে আবারো ধন্যবাদ দিয়ে – নিজের অজান্তেই তাদের প্রকৃত চেহারাটা মানুষের সামনে উন্মুক্ত করার জন্য। আসলে ভেতরে, অন্তরে প্রকৃত ইসলাম না থাকলে 'ইসলামের মুখোশ' খসে পড়ে এভাবেই। এই দেশের ইতিহাসের ভয়ঙ্কর কিছু অপরাধীর বিচার বন্ধের জন্য এমন তান্ডব চালিয়ে তারা প্রমাণ করে দিয়েছে তাদের ভন্ডামী, মোনাফেকী।

পুনশ্চঃ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের জন্য গঠনতন্ত্র থেকে আল্লাহর নাম একেবারে মুছে দিয়েছে তারা। ঘৃণ্য রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এরা করতে পারে না, এমন কোন কাজ নেই। এদের মুখেই আল্লাহ-রাসুলের কথা! ছি!!