‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত আরজু-আজিবরের জন্য শোকগাথা

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 18 August 2015, 01:26 PM
Updated : 18 August 2015, 01:26 PM

আরজু আর আজিবরকে নানাভাবেই একই ব্র্যাকেটবন্দি করা যায়। দু'জনেই ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনীতি করা 'ছাত্র নেতা'; দু'জনেই দেশজুড়ে হৈ চৈ ফেলে দেয়া চাঞ্চল্যকর হত্যার আসামী; আর কাল দু'জনেরই কপাল খারাপ, অস্ত্র উদ্ধারে বের হওয়া র্যা বকে দেখে তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা 'গুলি চালিয়েছিল', আর তার ফল পেয়েছিল হাতে নাতে ওই দুইজন – 'বন্দুকযুদ্ধে' মৃত্যু; মিল আছে আরও – রাষ্ট্রের ভয়ঙ্কর অবিচারের শিকার হবার পরও দু'জনের মৃত্যুতেই দেশের অসংখ্য মানুষ খুশি হয়েছে।

মাগুরায় মায়ের জরায়ুতে শিশু গুলিবিদ্ধ হবার দেশ কাঁপানো ঘটনার (ওই ঘটনায় একজনের মৃত্যুও হয়েছিল) আসামী আজিবর শেখ কাল রাতে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে মারা যায় (গর্ভস্থ শিশু গুলিবিদ্ধের আসামি আজিবর 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত)। এর কিছুক্ষণ পরেই ক্রসফায়ারে মারা যায় হাজারীবাগে চুরির অভিযোগে কিশোরকে পিটিয়ে মারা আরজু (হাজারীবাগে কিশোর হত্যার আসামি আরজু 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত)। না, এই দুই জনের মৃত্যুতে তাদের পরিবারের মানুষজন ছাড়া আর কারো ক্রন্দন নেই, এমনকি নেই কারো কোন বিবৃতিও। আমাদের কাছে এমনই 'ঘৃণ্য' এই দুজন মানুষ যে এদের অন্যায় মৃত্যুর বিপক্ষে কথা বলার ঝুঁকি নিচ্ছে না কোন মানবাধিকার সংস্থাও। আর আমাদের তো রীতিমত এক মানবাধিকার কমিশন আছে – টু শব্দ করছেন না এর প্রধাণও।

দু'জনের কেউই আদালত কর্তৃক দোষি সাব্যস্ত না হলেও আলোচনার স্বার্থে ধরে নেই ওই দু'জন প্রকৃতই খুনি। এই দুই ভয়ঙ্কর খুনির প্রতি কারো কোন সহানুভূতি না থাকারই কথা। এইসব মর্মান্তিক ঘটনার নিন্দা জানানো স্ট্যাটাসে ছেয়ে গেছে ফেইসবুক আর পোস্টে ছেয়ে গেছে ব্লগ – এটা হবারই কথা। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম এক রাতে দুইজন অভিযুক্তকে বিনা বিচারে হত্যা করা হল, এই প্রতবাদ কেউ করছে না! অনেকেই প্রশংসা করছেন এই হত্যাকাণ্ডের।

এটার প্রতিবাদ করা মানে কি ওই অভিযুক্তদের কৃত অপরাধের পক্ষ নেয়া? মোটেও না। তাদের কৃত অপরাধের প্রতি ঘৃণা জানিয়েও আমি এই দুই অভিযুক্ত খুনীর পক্ষ নিচ্ছি, পক্ষ নিচ্ছি তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের। মানবাধিকার বলে যে বস্তুটা আছে সেটা সবার জন্য প্রযোজ্য, সে যত বড় খুনী হোক না কেন। যদিও এরকম অপরাধীদেরকে আমরা প্রায়শই মানুষের খাতা থেকে নাম কেটে দিতে চাই। কিন্তু আমাদেরকে শোধরাতে হবে এই মানসিকতা।

এরকম কিছু মানুষকে ধরে ধরে মেরে ফেললে এই দেশটা খুব শান্তির জায়গা হয়ে যাবে বলে একটা প্রপাগান্ডা চালানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে, আমাদের মত অনেক মানুষ সেই প্রচারণায় প্রভাবিতও হই, 'ক্রসফায়ার' এর পক্ষে দাঁড়াই – কেউ মনে মনে খুশি হই, কেউ বা এক কাঠি বাড়া হয়ে মিষ্টি বিতরণ করি। শুধু ভুলক্রমে কোন নিরপরাধ মানুষ (যেমন – লিমন বা নারায়ণগঞ্জের সাত খুন) ভুক্তভোগী হলে আমরা কিছুটা আওয়াজ দেই।

কিন্তু একটা রাষ্ট্র কোন পরিস্থিতিতেই যে তার কোন অভিযুক্ত নাগরিককে বিনা বিচারে মেরে ফেলতে পারে না, এটা খুব কম মানুষই বলছে। এটা স্পষ্টভাবেই রাষ্ট্রের সাথে জনগণের কৃত চুক্তির ভয়ঙ্কর লঙ্ঘন। এমনকি আমাদের রাষ্ট্র এটাও ভেবে দেখে না, এরকম জবাবদিহিতাবিহীন একটা ক্ষমতা রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করে। রাষ্ট্র মানে তার একটা বিচার বিভাগ থাকবে, আর সেটা সব অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করবে, আর শাস্তিপ্রাপ্ত তার শাস্তি পাবার আগে বিচারকের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবে। তাই বিনা বিচারে রাষ্ট্র যখন তার কোন নাগরিককে মেরে ফেলে তখন ওটাকে আর রাষ্ট্র বলতে ইচ্ছে করে না; ওটা তখন স্রেফ "মঘের মুলুক"।

এভাবে 'ক্রসফায়ার', 'বন্দুকযুদ্ধ' এবং 'এনকাউন্টার' এর নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু করে এই দেশকে "মঘের মুলুক" বানিয়ে ফেলার প্রক্রিয়া বিএনপি সরকার শুরু করলেও এটা দারুণভাবে চলছে এখনো, যদিও ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে ওটা বন্ধ করার কথা আওয়ামী লীগ বলেছিল। কিন্তু না, এটার মজা ছাড়া যায় না, চলছে এখনো দারুন উদ্যমে। অবশ্য সরকার আর নানা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা বলেন কোন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে না, এগুলো আসলেই 'ক্রসফায়ার' বা 'বন্দুকযুদ্ধ' বা 'এনকাউন্টার'। এই ব্যাপারে তাঁদের একটা বয়ান আছে, লিখছি না ওটা, মনে করে নিন, ক্রমাগত শুনতে শুনতে ওটা এখন আমাদের মুখস্ত। মাঝে মাঝে মনে হয় সরকারের উচিৎ কিছু ক্রিয়েটিভ লেখককে নিযুক্ত করা যারা মানুষকে মেরে ফেলার পর আসলেই কী পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে তাদেরকে খুন করতে হয়েছে সেটা নিয়ে নতুন নতুন গল্প তৈরি করবেন। এতে অন্তত একই গল্প বারবার শোনার অত্যাচার থেকে জনগণের রেহাই মিলত।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম এভাবে ক্রসফায়ার করে অপরাধী/সন্ত্রাসী মেরে ফেলাই সমাধান। তো আরজু বা আজিবর কি এই দেশের সবচাইতে বড় সন্ত্রাসী? ছাত্রলীগ এতো বেপরোয়া হবার শক্তি, সাহস কোথা থেকে পায়? এদের কি কোন গডফাদার নেই? তারা কারা? র্যা ব-সরকার জানে না? তাদের ক্রসফায়ার করা হচ্ছে না কেন? এই দেশের 'বড়' দুই দলের অজস্র নেতা, অজস্র উচ্চপদস্থ আমলার অপরাধের তুলনায় আরজু বা আজিবররা একেবারে পূত চরিত্রের মানুষ বলে আমি মনে করি। আরজু বা আজিবররা মরবে আজ, কাল বহু আরজু বা আজিবররা দাঁড়িয়ে যাবেই, কারণ আরজু বা আজিবরদের সৃষ্টিকর্তা কিন্তু ক্রসফায়ার হন না – হবেনও না কোনদিন। আমাদের যাবতীয় ঘৃণা, থুতু আরজু বা আজিবরদের জন্যই বরাদ্ধ। করুণা বোধ করছি আরজু বা আজিবরদের জন্য – তার মরে এভাবে; আর তার চাইতে হাজার গুন বড় অপরাধী এই দেশে এমপি-মন্ত্রী হয়, পতাকাশোভিত গাড়ি দাপিয়ে বেড়ায়!

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কিছুদিন আগে চমৎকার একটা কথা বলেছেন – "রাষ্ট্রের বাহাদুরি দুর্বলের ওপর"। যদিও কথাটি তিনি বলেছেন চা শ্রমিকদের ভূমি অধিগ্রহন প্রসঙ্গে, তবুও কথাটা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও দারুনভাবে প্রযোজ্য। অপরাধীদের মধ্যেও তুলণামূলকভাবে দুর্বল অপরাধীই মরে এভাবে; মূল হোতা, গডফাদাররা থেকেই যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে – গডফাদারদের ওয়পর নেই রাষ্ট্রের বাহাদুরি; আসলে গডফাদাররাই তো এখন রাষ্ট্র। তাই ক্রসফায়ার করে বহুল প্রচারিত অপরাধ কমানোর তত্ত্ব আমাদের সামনে হয়ে যায় স্রেফ ফালতু কথা।

পরিবারের সদস্যদের বাইরে আরজু বা আজিবরদের জন্য শোক জানানোর মত খুব কম মানুষই আছে; এই দেশের প্রায় সবাই স্বস্তি পাওয়া বা খুশি হবার দলে। কিন্তু আমি আরজু এবং আজিবরের এমন মৃত্যুর প্রতিবাদ জানাই, অধিকারহীনভাবে এমনভাবে মারা যাবার জন্য তাদের জন্য শোক জানাই। এভাবে বলার বা লিখার ঝুঁকি কতটা ঠিক জানি না, কিন্তু তারপরও আমি এটা চালিয়ে যেতে চাই ভবিষ্যতেও যেমন বহুকাল আগে লিখেছিলাম 'ডাকাত শহীদ' এর জন্যও – ডাকাত শহীদের আবার মানবাধিকার!