আশাবাদী বাংলাদেশ, ‘প্যান্ডোরা’স বক্স’ আর যৌক্তিক হতাশাবাদ

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 13 Jan 2016, 08:33 PM
Updated : 13 Jan 2016, 08:33 PM

গতকাল প্রকাশিত আন্তর্জাতিক (উইন–গ্যালাপ) একটা জরিপে দেখা দেখা যায়, ২০১৬ সাল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীতে সবচাইতে আশাবাদী। কাল সন্ধ্যায় বিবিসি বাংলা রেডিওতে এই সংক্রান্ত রিপোর্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমাজবিজ্ঞানীর বক্তব্য শোনানো হয়েছিল (বিস্তারিত শুনুন)। তাঁর বক্তব্যের মূল সুর ছিল যেহেতু গত বছর বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ অনেক কিছু অর্জন করেছে, মানুষ তাই আগামী বছর নিয়ে আশাবাদী। আমি সমাজবিজ্ঞানী নই, কিন্তু বিনয়ের সাথে ওই সমাজবিজ্ঞানীর বিশ্লেষণকে গ্রহণ করছি না। বিবিসির প্রশ্নকর্তাও তাঁর ব্যাখ্যার বিপরীতে নানা যুক্তিতর্ক করেছেন। ওই অনুষ্ঠানের মানুষের মন্তব্যও নেয়া হয়েছিল, এবং আমার বিবেচনায় তাঁদের কথাতেই এসেছিল মূল ব্যাখ্যাটি – সেটায় আসছি পরে।

কাকতালীয়ভাবেই এই ব্লগের তুলনামূলকভাবে একজন নতুন (কিন্তু দারুণ লেখক) ব্লগার কাজী শহীদ শওকত আশাবাদ ব্যক্ত করে একটা পোস্ট লিখেছেন, যেটি এই মুহূর্তে এই ব্লগের ব্যানার হিসাবে আছে। তাঁর আশাবাদী পোস্টার বিপরীতে কিছু কথা লিখায়, তিনি আমার মতামতকে একেবারে বাতিল করেননি, কিন্তু পাল্টা আবার আরও আশার কথা শুনিয়েছেন। শওকত ভাইয়ের এই মন্তব্যের লিঙ্ক আমি পরবর্তীতে দেব, যেটা আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে মানুষ আসলে কখন আশাবাদী হয়।

মজার ব্যাপার হলো ওই জরিপে 'Hope Index' আর 'Economic Optimism Index' এ সর্বোচ্চ স্কোর পাওয়া দেশগুলো একই। যদিও দুই ইনডেক্সে তাদের অবস্থানগত ভীন্নতা আছে। যেমন, বাংলাদেশ 'Hope Index' এ প্রথম হলেও 'Economic Optimism Index' এ দ্বিতীয়। এবার এই দশটা দেশের নাম একটু দেখে নেই – বাংলাদেশ, চীন, ফিজি, সৌদি আরব, নাইজেরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, মরক্কো, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা (বিস্তারিত রিপোর্ট এখানে)। আমরা যারা এই দেশগুলোর আন্তর্জাতিক ঘটনার খোঁজ খবর রাখি, তারা জানি এই দেশগুলোর মধ্যে একটা মিল আছে – মিলটা কী, সেটা পোস্টের শেষ অংশে লিখবো।

গ্রিক মিথোলজিতে খুব আলোচিত চরিত্র প্যান্ডোরা, পৃথিবীর প্রথম মানবী। 'টাইটান' প্রমিথিউস আগুন চুরি করে মানুষকে দেবার কারণে প্রমিথিসের শাস্তি হয়েছিল – শিকলবদ্ধ প্রমিথিউস এর লিভার প্রতিদিন খেয়ে যেতো একটা ঈগল, আর রাতের মধ্যে তার লিভার আবার গজাতো, যেন পরদিন ঈগল আবার সেটা খেতে পারে। আর আগুন পেয়ে মানুষের যে লাভ হয়েছিল, তার প্রতিশোধ নেয়া হয়েছিল জিউস এর আদেশে মানুষের জন্য একটা 'অশুভ উপহার' তৈরী করে। জিউস এর আদেশে কয়েকজন গড নানা রূপ, নানা ক্ষমতা/গুণ যুক্ত করে এই 'অশুভ উপহার' তৈরী করেন, ইনিই হলেন প্যান্ডোরা। তাঁকে পাঠানো হয় প্রমিথিউসের ভাই এপিমেথেউসের কাছে। এমন ঘটনার অনুমান করে প্রমিথিউস তার ভাইকে নিষেধ করে জিউসের কাছ থেকে সে যেন কোন উপহার গ্রহণ না করে। কিন্তু প্যান্ডোরা কে দেখে এপিমেথেউস মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে, ভাইয়ের নিষেধ অগ্রাহ্য করে সে গ্রহণ করে প্যান্ডোরাকে।

পরের ঘটনা, প্যান্ডোরার নাম যে কারণে আলোচিত, সেটা আমরা অনেকেই জানি। প্যান্ডোরাকে একটা জার (পরবর্তীতে ভুল অনুবাদে এটা বাক্স হয়ে গেছে) দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল, আর বলা হয়েছিলো সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে চাইলে বাক্সটা যেন সে না খোলে। কিন্তু কী আছে সেখানে, এই কৌতুহল প্যান্ডোরার পক্ষে চেপে রাখা সম্ভব হয় না, একদিন জারটার মুখ খোলে সে, আর সেখান থেকে বেরিয়ে যায় রোগ-ব্যাধি-হিংসা-ক্রোধ-ঈর্ষা সহ পৃথিবীর মানুষের জন্য যাবতীয় 'খারাপ' সবকিছু। কিছুক্ষনের মধ্যেই প্যান্ডোরা জারের মুখ বন্ধ করে ফেলে, কিন্তু তখন আর কোন 'খারাপ' বেরিয়ে যেতে বাঁকি থাকে না, পড়ে থাকে শুধু 'আশা'।

খেয়াল করার ব্যাপার হলো, যাবতীয় খারাপ বস্তু ভরে যে পাত্র দেয়া হয়েছিল প্যান্ডোরার হাতে তার ভেতরেই কিন্তু ছিল আশা, এটা স্পষ্টভাবেই ইঙ্গিত করে, 'আশা' বস্তুটা ভালো না। অবশ্য কেউ কেউ এটাকে পোজিটিভলি দেখেন; বলেন, যাবতীয় সমস্যার মধ্যে জীবনযাপনকারী মানুষের জন্য আশাই একমাত্র চালিকাশক্তি। কিন্তু বিখ্যাত দার্শনিক Friedrich Nietzsche তাঁদের সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করে বলেন, "Zeus did not want man to throw his life away, no matter how much the other evils might torment him, but rather to go on letting himself be tormented anew. To that end, he gives man hope. In truth, it is the most evil of evils because it prolongs man's torment." ভালোভাবে খেয়াল করে দেখা যায়, উনি আশাকে বলেছেন "evil of evils"। কারণ হিসাবে বলেছেন, এটা আখেরে মানুষের কষ্ট-যন্ত্রনাকে বাড়িয়েই তোলে। তবে, এটা সত্য, নানা 'খারাপ জিনিষ' এ পরিপূর্ণ এই পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে থাকে আশা নিয়ে, কারণ আমাদেরকে ছোটবেলা থেকে এভাবেই শেখানো হয়।

'Hope Index' আর 'Economic Optimism Index' এ থাকা দেশগুলো গেল বছর নানা রকম ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে গেছে। এজন্যই এই দেশের মানুষরা আশা করে। আশাবাদী হওয়া বঞ্চিত মানুষেরই চরিত্র। অবশ্য ক্রাইসিস একটা পর্যায় অতিক্রম করলে মানুষ আর আশাবাদীও হতে পারে না, এজন্য এই মুহূর্তে ভয়ঙ্কর বঞ্চনার শিকার সিরিয়া এই তালিকায় নেই। বিবিসি বাংলা রেডিওর ওই রিপোর্টে কয়েকজন 'সাধারণ' মানুষকে স্পষ্টভাবেই বলতে শোনা গেছে, যেহেতু তাদের আর কিছু করার নেই, তাই তারা আশা করেন। এবার এর সাথে মিলিয়ে নেই শওকত ভাইয়ের পোস্টে আমার লিখা মন্তব্যের জবাবে তাঁর বক্তব্যটি। তিনিও আসলে চারিদিকের নানা অসহনীয় হতাশা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে আশাবাদী হয়েছেন, আসলে আর কিছু করার নেইও আমাদের। তবে Nietzsche এর কথা সথিক বলে ধরে নিলে এই আশাবাদ আমাদের যন্ত্রণাকে কেবল বাড়াবেই আখেরে।

"আমি খুব আশাবাদী মানুষ" এই সমাজে এটা বহুল চর্চিত একটা কথা। টিভির টক শো'তে অনেক সময়ই দেখি অনেক 'সুশীল' এই কথাটা বলেন। এই ধরণের "Enforced Optimism" কে আমি খুব ক্ষতিকর বলে মনে করি, কারণ এটা আমাদের ওই মুহূর্তের ক্ষোভকে প্রশমিত করে দেয়, এতে পরিবর্তনের পথ রুদ্ধ হয়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই আমাদের মধ্যে থাকা উচিৎ "Rational Pessimism" বা যৌক্তিক হতাশাবাদ। এই হতাশাই একদিন আমাদেরকে দিন বদলের সংগ্রামে মাঠে নামাবে বলে আমার বিশ্বাস। এই দেশে, এই সময়ে জীবনযাপন করে হতাশাবাদী হন না যিনি, আমার মতে তিনি আর যাই হোক দিন বদলের জন্য কাজ করবেন না; তিনি "আশা" করবেন।