দলীয় ব্যানারে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনঃ স্থানীয় সরকারের কফিনে শেষ পেরেক?

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 4 May 2016, 06:48 PM
Updated : 4 May 2016, 06:48 PM

নিঃসন্দেহে ইউনিয়ন পরিষদ বাংলা ভূখণ্ডে সবচেয়ে পুরাতন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। নানা নাম নিয়ে, নানা ঘটনা পেরিয়ে এখন পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদই দেশের সবচেয়ে স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠানও বটে। নির্বাচনে পার্থীদের প্রতিদ্বন্দিতা, ভোটারদের অংশগ্রহণের স্বতস্ফুর্ততা ও হার ইত্যাদি যে কোন বিবেচনায় ইউনিয়ন পরিষদ এদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় একটি অনন্য অবস্থান দখল করে আছে।

প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই অন্যান্য স্থানীয় পরিষদের মতো ইউনিয়ন পরিষদও ছিল একটি নির্দলীয় প্রতিষ্ঠান। দলীয় রাজনীতির সাথে সংশ্রবহীন স্থানীয় নেতৃত্বগুণসম্পন্ন নাগরিকগণ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হতেন এবং নির্বাচিত হয়ে তাদের দায়িত্ব সুচারুরূপেই পালন করতেন। কিন্তু সমাজের সব খানেই রাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদও বাদ যায়নি। দেখা গেল সরকার স্থানীয় পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের থেকে সকল প্রকার উন্নয়নকর্মে নিজ দলের নেতাকর্মীদেরই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এমনকি নিয়ম বহির্ভূতভাবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাজগুলো দলীয় নেতাকর্মীদের উপর ছেড়ে দিচ্ছেন।

এমতাবস্থায়, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান-মেম্বারগণ দলীয় পরিচয় না থাকার ফলে উন্নয়নকর্মে গৌণ হয়ে পড়ছেন। এ থেকে উত্তরণের জন্য অনেকে সরকারি দলে ঘটা করে যোগদানও করছেন। আবার এমনও হচ্ছে যে প্রত্যেক দল তাদের স্থানীয় নেতাদের এসব প্রতিষ্ঠানে অফিসিয়ালি না হলেও আনঅফিসিয়ালি মনোনয়নও দিচ্ছেন। ইউনিয়ন পরিষদসহ অন্যান্য স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থীদের অংশগ্রহণের ধরনটা তখন এমনি দাঁড়াল যে এগুলোকে জনগণ কার্যত দলীয় নির্বাচন বলেই ধরে নিতে শুরু করে।

এই প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন বলতে শুরু করল, হয় এসব নির্বাচন থেকে রাজনীতি দূর করেন, কিংবা এগুলোকে পুরোপুরি রাজনৈতিক তথা দলীয়ভাবে শুরু করেন। সরকার দেখল, দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত তাদের ক্ষমতার ভিত্তি শক্তিশালী হবে, তাই তারা শেষ পর্যন্ত স্থানীয় পরিষদগুলোকে দলীয় রাজনীতির অংশ করতেই মত দিল। প্রথমে হল পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচন এখন হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ।

এই প্রথম দলীয় ব্যানারে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন ৬টি ধাপে এ নির্বাচন শেষ করবে বলে জানা গেছে। যার মধ্যে এখন পর্যন্ত তিনটি ধাপ শেষ হয়ে চতুর্থ ধাপে চলছে নির্বাচন।

কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত প্রথম ধাপে ৫৪ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৩৪ জন, তৃতীয় ধাপে ২৫ জনের পর চতুর্থ ধাপে ৩৩ জন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া খুব অস্বাভাবিক ঘটনা না হলেও স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াটা অনেকটাই ব্যতিক্রমী ঘটনা। রাজনীতিকে সচেতনভাবে অনুসরণ করছি খুব কম দিন হয়নি, সচেতন ভাবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও দেখেছি। আমার ইউনিয়নে কোন দিন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের ঘটনা ঘটেনি। আর অন্যান্য স্থানেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের খবর ছিল বলে মনে পড়ে না। হতেও পারে তেমন নির্বাচন। কিন্তু সেটা নিয়ম নয়, নিয়মের ব্যতিক্রম মাত্র। কিন্তু দলীয় ভিত্তিতে প্রথমবারের এ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াটা কোন ক্রমেই স্বাভাবিক ঘটনা বলা যায় না। তাহলে কেন এমন প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন হচ্ছে এ নির্বাচন? কারণগুলো নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করে যাক:

১. দলীয়ভাবে হওয়ায় প্রত্যেক দলই একক প্রার্থী দেবার চেষ্টা করছে। এতে প্রার্থীর সংখ্যা এমনিতেই কমবে। যেখানে দলীয় সমর্থন ছাড়া জয়লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ সেখানে যারা দল করেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তারা যে জয়লাভ করতে পারবেন না এটা মনে করেই স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হচ্ছেন না।

২. বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতির চরিত্র দ্রুত দ্বিমেরুকরণের দিকে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই কোর্টেই কেবল গড়া গড়ি করছে এ নির্বাচন বা দলের বলটি। তাই এ দুই দলের বাইরে কোন প্রার্থী উৎসাহতি হচ্ছে না।

৩. বিএনপি জোটের মধ্যে ঐক্য থাকলেও তাদের নেতা কর্মীরা এখন কেবল মাঠ ছাড়াই নয়, ঘর ছাড়াও বটে। বিরোধী জোটের খুব কম সংখ্যক প্রার্থীই পাওয়া যাবে যাদের নামে এক বা একাধিক মামলা নেই। তাই তারা গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে যাদের নামে মামলা নেই তারাও রয়েছেন গ্রেফতারের ঝুঁকিতে। কারণ সরকারের হাতে এত বেশি মুলতবি মামলা আছে যে পুলিশ চাইলে যে কোন রাজনৈতিক কর্মীকে যে কোন সময় গ্রেফতার করে তদন্তাধধীন মামলায় ঢুকাতে পারে। আর এ অনুশীলনটি পুরোমাত্রায় চালু আছে। তাই বিরোধী শিবিরের নেতাকর্মী যাদের নামে কোন মামলা ছিল না কিংবা যারা এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হননি, নির্বাচনের তোড়জোড় শুরুর সাথে সাথেই তাদের মনে গ্রেফতার ভীতি ঢুকানো হয়েছে। আর বিরোধী দলের সাংগঠনিক ক্ষমতা বর্তমানে এতটাই নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে যে কোন নেতা কর্মী গ্রেফতার হলে তাদের মুক্তির জন্য আনোদলন তো দূরের কথা, এটাকে নিন্দা জানানোর মতো ক্ষমতাও তাদের নেই। তাই তৃণমূলের নেতা কর্মীগণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতার পরিবর্তে গ্রেফতার এড়ানোকেই প্রথম কর্তব্য বলে মনে করছেন।

৪. সরকারি দলের নেতাকর্মীগণ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনকে অনেকটা নিজেদের একক জমিদারি বলে মনে করছেন। টেন্ডারের ক্ষেত্রে যেমন সিন্ডিকেট তৈরি হয়ে সরকারি দলেরে নেতা-কর্মী-সমর্থকগণ ঠিকাদারীসহ অন্যান্য ব্যবসা হাতিয়ে নিচ্ছেন তেমনি ইউপি নির্বাচনের চলছে সিন্ডিকেট পদ্ধতি। সরকারি দলের একমাত্র প্রার্থী তার দলের বিদ্রোহী প্রার্থীসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীদের ভয়-ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা থেকে দূরে রাখছেন।

৫. একক প্রার্থীতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রার্থীতা থেকে বিরত রাখার জন্য সরকারি দলের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা, গুম ও অপহরণের ভয় দেখাচ্ছেন এবং অনেক স্থানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অপহরণ ও গুম হওয়ার খবর পত্রিকাতেও প্রকাশিত হচ্ছে। তাই একটি বড় সংখ্য ইচ্ছুক প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বীতার ইচ্ছা অংকুরোদগমই করতে পারছে না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোন খারাপ নজির পরিত্যাগ করা হয় না। রাজনৈতিকভাবে লাভজনক হলে কোন নজির যত খারাপই হোক না কেন তারা লালনপালন ও অনুশীলন চলে দিনের পর দিন। আওয়ামী লীগের খারাপ নজির বিএনপি বর্জন করেনি, বিএনপির নজির বর্জন করেননি স্বৈরাচারী এরশাদও। আবার একানব্বই থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশ নতুন করে যাত্রা শুরু করলেও স্বৈরাচারের দোষগুলোর ধারাবাহিকতা পরবর্তী সরকারগুলো নিরলসভাবেই বহন করে চলছে।

দেশে স্থানীয় পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদসহ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জয়ী হবার যে অপকৌশল শুরু হয়েছে, আমার মতে সেটা আগামীতে আরো বেগবান হবে। আর কোন দিন যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যূত হয়, বিএনপি কিংবা অন্যরাও এই সংস্কৃতির মশালবাহী হবেন বলেই নিশ্চিত থাকা যায়। আর এটা যদি চলতেই থাকে তাহলে দেশের গণতন্ত্র চর্চার প্রাথমিক অনুশীলন নির্বাচনগুলো বড় ধরনের প্রহসনে পরিণত হবে।

দেশের স্থানীয় সরকারের ইউনিটগুলো ভেঙে পড়াটা দেশের ভবিষ্যতের জন্য এক বিরাট হুমকি। এককেন্দ্রিক একটা রাষ্ট্রের স্থানীয় সরকার যদি যথেষ্ট শক্তিশালী না হয়, সেটা সরকারকে আরও বেশি স্বৈরাচারী করে তুলবে। এমনিতেই নির্বাচিত স্থানীয় সরকারকে পাশ কাটিয়ে দলীয় লোকজন দিয়ে এলাকা চালানোর অভিযোগ তো ছিলোই, এখন থেকে সেটা আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলো, এর জেরেই যুক্ত হয়েছে বহু মানুষ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া। এটা কি আখেরে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাটাকেই ধ্বংস করে দেবে না? তাই এর মধ্যেই মধ্যযুগীয় সম্রাটদের মতো ক্ষমতা উপভোগ করা প্রধানমন্ত্রীর আরো ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠাকে কোন উপমায় প্রকাশ করবো আমরা?