বিনা পরোয়ানায়, সাদা পোশাকে গ্রেফতার: ফিরে দেখা যাক তনু হত্যা

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 24 May 2016, 09:43 AM
Updated : 24 May 2016, 09:43 AM

৫৪ এবং ১৬৭ ধারা নিয়ে গুরুত্বপূর্ন নির্দেশনা দেয়া হাইকোর্ট বিভাগের রায় আজ হাইকোর্টের আপীল বিভাগ বহাল রেখেছে (বিস্তারিত)। দেশের বিচারিক ইতিহাসে এই রায় মাইলফলক হিসাবে আলোচিত হবে ভবিষ্যতেও। প্রাথমিক রায়টির নির্দেশনা গ্রহণ না করে, সরকারের আপীল করা আমাদের দেশে গণতন্ত্রের নামে প্রতিষ্ঠিত সরকারগুলোর ফ্যাসিবাদী চরিত্র দারুণভাবে প্রকাশ করে। সাধারণ জনগণের 'শেষ ভরসাস্থল' আপীল বিভাগ এবার অন্তত জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন – অনেক ধন্যবাদ প্রধান বিচারপতি এবং তাঁর দলকে। এই রায়, এর নির্দেশনা, এর প্রভাব নিয়ে একটা স্বতন্ত্র ব্লগই লিখা উচিৎ, সময় করতে পারলে সেটা লিখবো। আজকের এই ব্লগে বরং দেখে নেই যে সব ভয়ঙ্কর ঘটনা এমন রায়ের প্রেক্ষাপট তৈরী করেছে, তেমন একটি ঘটনা।

কয়েকদিন আগে আলোচিত সোহাগী জাহান তনু হত্যার দুই মাস পূর্তি হলো। দেশের সব মিডিয়ার দৃষ্টির মধ্যেই শুরু থেকেই অবিশ্বাস্য সব বিষয় আমরা দেখেছি; ফিরিস্তি দিয়ে পোস্টের কোলেবর বাড়াবো না। এই খবরে (বাড়ি ফিরেছেন তনুর ছোট ভাইয়ের বন্ধু) দেখা যায় নিহত সোহাগী জাহান তনুর ছোট ভাইয়ের বন্ধু মিজানুর রহমান সোহাগ ১৬ দিন পর মায়ের কোলে ফিরে এসেছে। তনুর লাশ আবিষ্কৃত হয় ২০ মার্চ, ২০১৬ তারিখে। আর তনুর ছোট ভাইয়ের বন্ধু সোহাগকে তার কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের নারায়ণসার গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে একদল লোক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয় দিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ২৭ মার্চ তারিখে। শোনা যায়, তনুর মোবাইলে শেষ ফোনটা নাকি এসেছিল সোহাগের ফোন থেকেই। তাই তনু হত্যা কাণ্ডের সাথে সোহাগের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে অনুমান করা যায়। কিন্তু এ সাথে এটাও অনুমান করা যায় যে, এ ঘটনায় সোহাগ একজন উত্তম সাক্ষী হতে পারে। ঘটনাকে দু'দিক থেকেই বিবেচনা করা যায়।

এজন্য সোহাগকে গ্রেফতারও করা যায়, আবার তাকে সাক্ষী হিসেবে তলবও করা যায়। এখন কথা হল, পুলিশ কোন পথটি বেছে নিবে? যদি সোহাগকে গ্রেফতার করা হয়, গণমাধ্যমের কাছে পুলিশের কর্মতৎপরতার একটি প্রমাণ তৈরি হয়। পুলিশ বলতে পারে, তনু হত্যা ঘটনায় ইতোমধ্যেই একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তনু হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারীগণ এতে আস্বস্ত হবেন। কিন্তু একজন নাগরিক, তিনি যদি আবার নাবালক বা অল্প বয়সের যুবক হয় বিষয়টি নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তার প্রয়োজন আছে।

যদি পুলিশ তাকে সন্দেহমূলকভাবে গ্রেফতার করে, আর শেষ পর্যন্ত ঘটনায় তার জড়িত থাকার কোন প্রমাণই পুলিশ সংগ্রহ করতে না পারে, তবে এ গ্রেফতার কর্মে পুলিশের জন্য আইন রক্ষা হলেও পেশাগত নীতি কিংবা মানবাধিকার রক্ষিত হয় না। কারণ যে তরুণটিকে একটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে তার নির্দোষতা কেবল অভিযোগপত্রে নাম অন্তর্ভুক্ত না করা কিংবা তারো পরে বিচারে ছাড়া পাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের তদন্তের অপরপিক্কতা ও বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, কোন মামলায় সন্দিগ্ধ হয়ে কেউ গ্রেফতার হলে আর সেটা যদি হত্যার মতো অপরাধের অভিযোগ হয়, তাহলে তদন্ত পর্যায়েও সে ছাড়া পেলেও তাকে অন্তত ছয়মাস হাজতবাস করতে হবে। আর যদি সে অভিযোগপত্রভুক্ত হয়, তাহলে হলে তো পাঁচ থেকে ১০ বছরের আগে তাকে মামলামুক্ত করার কোন সুযোগই থাকবে না।

এখন দ্বিতীয় অপশনটিতে আসা যাক। এতে মনে করা হল, সন্দিগ্ধ ব্যক্তি ঘটনায় জড়িত না থাকলেও ঘটনা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য বা যোগসূত্র দিতে পারে। এর মানে হল তিনি মামলায় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হতে পারেন। এক্ষেত্রে তাকে গ্রেফতার না করেও তদন্তকারীগণ দিনের পর দিন থানায় ডেকে কিংবা সন্দিগ্ধের বাসায় গিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। এক দিনে পুলিশের সন্দেহ দূর না হলে কিংবা তারা কিছু দিন পর নতুন তথ্য পেলে আবার তাকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে। তদন্তে তা হাতে জিজ্ঞাসাবাদে যদি ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় তাকে গ্রেফতার করা যেতে পারে অন্যথ্যায় থাকে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে। এ পদক্ষেপের ফলে সন্দিগ্ধ ব্যক্তির সর্বাধিক কল্যাণ যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি মামলার তদন্তও সুষ্ঠূ হবে।

কিন্তু সোহাগী জাহান তনুর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে মিজানুর রহমান সোহাগের ক্ষেত্রে আমাদের তদন্তকারীগণ এর কোনটিই করেননি। এরা যা করেছেন সেটা রীতিমত একটি ফৌজদারি অপরাধ। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পরিচয় দিয়েই তারা সোহাগকে বাসা থেকে তার আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। তারপর তাকে ১৬ দিন ধরে হাত-পা ও চোখ বেঁধে গোপন স্থানে রাখা হয়েছে। তাকে তনুর ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু কোন তথ্যই আদায় করতে পারেনি। তার মানে হল, তনু হত্যার ক্ষেত্রে সোহাগ নির্দোষ।

সোহাগকে তার বাসা থেকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাকে যে ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়ক দিয়ে ঢাকায় কোন এক আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর অফিসে বা সেইফহোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা সোহাগের স্বীকারোক্তি থেকেই বোঝা যায়। যদিও সোহাগের বাবা বুড়িচং থানায় জিডি করেছিল, তবুও এটা যে কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের কর্মকাণ্ড ছিল না, সেটা বুদ্ধিমান মাত্রই বুঝতে পারবে।

দেশের মানুষ জানে বা বোঝে এই কাজটি পুলিশের কোন ইউনিটটি করেছিল। কিন্তু কেউই মুখ ফুটে তা বলছেন না কিংবা বললেও তা প্রচার মাধ্যমের সামনে গোপন করছেন। এখন চোর ধরতে চোর নিয়োগ করার রীতিকে যদিও আমরা সমর্থন করতে পারি, চোর ধরতে চুরি করার মতো অপরাধকে অনুমোদন দিতে পারি না। একটি অপরাধ উদ্ঘাটন করতে পুলিশ যদি আর একটি অপরাধ করে, তবে সেই পুলিশের দরকার কি?

ভয়ঙ্কর একটা ঘটনার পর অতি কৌতূহলী মিডিয়ার চোখের সামনেও এসব ঘটনা যখন ঘটতে পারে, তখন আমাদের অগোচরে কতো সব ঘটনা ঘটে যায়, সেটা সহজেই অনুমেয়। গত কয়েক বছর ধরে গুমের ঘটনা এক ভয়ঙ্কর ব্যাধি হয়ে আছে আমাদের সমাজে – সেসব ক্ষেত্রেও জানা যায়, কোন গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়াই সাদা পোষাকের পুলিশ গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এবং যথারীতি পুলিশ সেটা অস্বীকার করতো। আমাদের সরকারের কাছে আমরা দৃঢ়ভাবে চাই, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যাতে ভবিষ্যতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে মানুষের ন্যুনতম মানবাধিকারকে স্বীকার করে, মর্যাদা দেয়।