ইনু’র কণ্ঠে নিজামী’র সুর: বিচার কেন নয় একইভাবেই?

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 15 June 2016, 06:41 PM
Updated : 15 June 2016, 06:41 PM

জাসদের উদ্দেশ্যে নিকট অতীতে প্রথম তোপটা দাগিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তোপের মুখে জাসদ নেতারা আমতা আমতা করতে শুরু করেছিলেন। তখন একাধিক টক শো'তে জাসদ নেতা এবং এমপি মহিউদ্দিন খান বাদল তাঁর স্বভাবসুলভ ভারিক্কি গলায় বারবার একটা কথা বলতেন, জাসদের প্যান্ডোরার বক্সটি যেন খোলা না হয়, তাহলে নাকি সেটা কারো জন্যই ভালো হবে না। এতো ভয় কেন ওই বাক্স খোলায়?

বাদলের কথায় তো আর সবাই চলেন না, তাই ওই বাক্স আবার খোলার চেষ্টা হলো। এবার এটার প্রতিক্রিয়া হলো অনেক বেশি। 'প্রভাবশালী' নেতা, এবং প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় হয়েও মন্ত্রীত্ব না পাওয়া শেখ ফজলুল করিম সেলিমের কথাকে মনের খেদ থেকে এক ধরণের পলিটিক্যাল স্টান্টবাজি বলে কেউ উড়িয়ে দিতে চাইতে পারেন। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ সেটা নন, তাঁর শত্রুও বলবে না, তিনি ফালতু পলিটিক্যাল স্টান্টবাজি করেন। জাসদের অতীতের ভূমিকার সমালোচনার পাশাপাশি তিনি এটাও যুক্ত করেছেন, জাসদ থেকে এই সরকারে মন্ত্রী নেবার প্রায়শ্চিত্ত ভবিষ্যতে করতে হবে। এবার আরো স্পষ্ট, টার্গেট ইনু।

ইনু-বাদল যাই চান না কেন, জাসদ নামের প্যান্ডোরার বাক্স খুলতে শুরু করেছে কিছুদিন হলো। আমার জন্মের অনেকটা আগের ওই সময় নিয়ে আগ্রহ ছিল বরাবরই। কিছুদিন আগে প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমেদের "জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি" বইয়ে অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছে। না, এটার সব কথাকে বেদ বাক্য হিসাবে মেনে নেই না আমি, আমি চাই এর ওপর আরো অনেক দিক থেকে আলো পড়ুক অন্য লেখকদের লিখা থেকে।

বাংলাদেশের জন্মের পরে জাসদের জন্মের প্রেক্ষাপট, ক্ষমতাসীন দলের প্রতিক্রিয়া, তারপর নির্বাচনে কারচুপি, জাসদকে প্রাপ্য আসন বঞ্চিত করা, এরপর গণবাহিনী করা, সব চাপের মুখেও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা ঠিক হয়েছে কিনা, গণবাহিনীর থানা লুট করা, মানুষ খুন করা, সরকার কর্তৃক তাদেরকে দমন করা, এর জের ধরে দেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রেক্ষাপট/পরিবেশ তৈরী, এরপর জাসদের উল্লাস, তাহেরের বিপ্লবের স্বপ্ন, সেটা বেহাত হয়ে জিয়ার হাতে প্রাণ হারানো – এই সবকিছুই আমাদের ইতিহাস চর্চার অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওই সময় এইসব ঘটনায় জড়িত মানুষ, বা গবেষকদের উচিৎ হবে এসব নিয়ে গভীর আলোচনা করা।

কিন্তু না, ইতিহাস চর্চায় ঘোর আপত্তি আছে ইনু সাহেবদের – অতি বাক্যবাগিশ ভদ্রলোক স্রেফ খামোশ হয়েছিলেন আশরাফের বক্তব্যের পর দুই দিন। আজ তিনি কথা বললেন এবং আমাদের জানালেন, "আমরা মনে করি এই সময়ে ১৪ দলের অভ্যন্তরে কোনো কাদা ছোড়াছুড়ি করা উচিত নয় এবং এটা ইতিহাস চর্চার সময় নয়। এটা জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার সময়, জনগণকে নিরাপত্তা বিধান করার সময়"। (বিস্তারিত দেখুন)

কথাগুলো পড়ার পর ফাঁসিতে ঝুলে মারা যাওয়া মতিউর রহমান নিজামীর মুখ সামনে ভেসে উঠলো। ক্ষমতায় থাকার সময় দারুণ প্রতাপশালী এই লোককে যখনই মুক্তিযুদ্ধের সময় তার এবং জামাতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হতো, তখনই সে বলতো এখন অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করে দেশ গড়ার কাজ করা উচিৎ। শুনে মুহূর্তের মধ্যে মুখে একদলা থুতু আসতো। কী নিয়তি, লোকটা ওই সময়কার বর্বরতার মাশুল দিলো। মজার ব্যাপার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রসঙ্গে পাকিস্তান বা তুরস্কও যখন বিবৃতি দিতো, তখনও তারা ইতিহাসের বিষয় নিয়ে কথা না বলে সামনে তাকাতে বলতো। কী চমৎকার দেখা গেলো – ইনুর গলায় নিজামী-পাকিস্তান-তুরস্কের সুর।

ইতিহাসকে, অতীতকে নিয়ে কথা বলতে তারাই ভয় যাদের ইতিহাস নোংরা – এটা বুঝতে সাধারণ কান্ডজ্ঞানই যথেষ্ট, রকেট সায়েন্টিস্ট হবার দরকার নেই।

জাসদের কর্মকান্ড কি শুধুমাত্র ইতিহাসের বিষয়? ইনু, বাদলকে এবং জাসদের কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীকে বলতে শোনা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে জাসদের ভূমিকা সঠিক ছিল, না ভুল ছিল সেটা একদিন ইতিহাস বিচার করবে। বিষয়টা এতোটা সিম্পল? গণবাহিনী গঠিত হবার পর এর ফৌজদারী অপরাধের দিকটার আলোচনা, সেটার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পদক্ষেপ কই? গণবাহিনী গঠন করে জাসদ কি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেনি? থানা, বিডিআর ক্যাম্প, মন্ত্রীর বাড়িতে হানা থেকে শুরু করে একটা বিদেশী দেশের রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করার চেষ্টা করা সহ অসংখ্য ফৌজদারী অপরাধ বাদ দিলেও গণবাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যাও অসংখ্য। গণবাহিনীর চট্টগ্রাম এর কমান্ডার মহিউদ্দিন খান বাদলকে অন রেকর্ড বলতে শুনেছি – গণবাহিনী করে আমরা মেরেছি, মরেছি। (বিস্তারিত দেখুন)। এই পোস্ট লিখার সময়ও দেখলাম ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির 'আজকের বাংলাদেশ' টক শো'তে বাদল মানুষ গণবাহিনীর হয়ে মানুষ হত্যার স্বীকৃতি দিচ্ছেন। এরপরও এরা বুক ফুলিয়ে হাঁটে এই দেশে! এমপি, মন্ত্রী হয়!

মানুষ হত্যার অপরাধ তামাদি হয় না, হলে জামাতের নেতা এই ক্রিমিনালগুলোকে স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পর ঝোলানো যেতো না। আর জামাতের সর্বোচ্চ নেতাদের ফাঁসির মূল কারণ তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে।

শেষ পর্যায়ে এসে একটা কথা স্পষ্ট করা দরকার, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার জামাতের করা অপরাধের সাথে জাসদের অপরাধকে একই পাল্লায় মাপছি না। কিন্তু জাসদ যা করেছে, সেটাও ভয়াবহ। ইনু-বাদল সহ গণবাহিনীর আর সব নেতাদের নেতৃত্বে যে ভয়ঙ্কর হত্যাগুলো হয়েছে, তার দায়ে এদের বিচার তাহলে হবে না কেন? রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা কি এদেরকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে? বাঁচিয়ে রাখবে ভবিষ্যতেও?